বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৮:৩৬ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
কয়রায় সড়কের কাজ ফেলে ঠিকাদার লাপাত্তা, জনদুর্ভোগ চরমে ধনবাড়ীতে বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকি মৌলভীবাজার জেলার ৫ উপজেলা ও ৫ পৌর শাখা বিএনপির আহবায়ক কমিটি অনুমোদন নড়াইলে তারুণ্যের উৎসবে বালক-বালিকাদের সাইক্লিং প্রতিযোগিতা লোহাগাড়া প্রেসক্লাবের উদ্যােগে পত্রিকার হকার ও অসহায়দের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ কালকিনিতে জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুর্ধ্ব ১৭ এর ফাইনাল ম্যাচ নবাগত নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াজেদকে ফুলেল শুভেচছা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান শ্রীমঙ্গলে কৃষি জমি থেকে মাটি কাটার অপরাধে লাখ টাকা জরিমানা শিক্ষকের দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং সাবেক এমপি’র তারাকান্দায় তারুণ্যের ভাবনায় আগামীর বাংলাদেশ শীর্ষক কর্মশালা

টেড হিউজ: আলোচিত-সমালোচিত এক কবি

রিফাত ফারিহা অন্তরা
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৪ নভেম্বর, ২০২২

ইংরেজি সাহিত্যের যে কয়েকজন কবির কবিতার পাশাপাশি তাদের ব্যক্তিজীবন নিয়েও সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখ্যযোগ্য হলেন টেড হিউজ। এই কবির কবিতা যেমন সাহিত্যাঙ্গনে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে, তেমনি পাঠকদের নজর কেড়েছে তার বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিজীবন। বিশেষ করে দুঃখ-জাগানিয়া কবি সিলভিয়া প্লাথের জীবনের সাথে হিউজের সম্পৃক্ততাই যেন সবার দৃষ্টি আকর্ষণের মূল কারণ।
সিলভিয়া প্লাথের রহস্যময় আত্মহনন আর হিউজের অন্য নারীর সাথে সম্পৃক্ততার কারণে এই কবি সমালোচনায় মুখরিত হয়েছেন বারবার। নারীবাদীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাকেই দায়ী করেছেন দুই স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য। কিন্তু আসলে কি কবিই দায়ী ছিলেন তার জীবনে আসা নারীদের করুণ পরিণতির জন্য? নাকি তার সাথেও ঘটে গেছে ভাগ্যের লীলাখেলা? এই প্রশ্নগুলোর শতভাগ নিশ্চিত ও নির্ভরযোগ্য উত্তর পাওয়া হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু তাই বলে টেডের কবিতার জগত এই প্রশ্নবাণে জর্জরিত বা নিয়ন্ত্রিত হয়নি কখনোই। ব্যক্তিজীবনের ঘটনার প্রভাব থেকে বেশিরভাগ সময়ই কবির লেখনী মুক্ত থাকতো। তার সাহিত্যের দুনিয়া নিজের গতিতে ঘূর্ণায়মান থেকেছে সবসময়। আর সেজন্যই মনে হয় টেড হিউজ তার সময়কার ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন হয়ে উঠতে পেরেছেন, পেয়েছেন ইংরেজি সাহিত্যের সবসময়কার অন্যতম উজ্জ্বল কবি হতে।
টেড হিউজ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার রাজ্যের পশ্চিমদিকের ছোট্ট শহর মিথলম্রোয়েডে ১৯৩০ সালের ১৭ অগাস্ট। তার পুরো নাম ছিলো এডওয়ার্ড জেমস হিউজ, কিন্তু টেড হিউজ নামেই এই কবি অধিক পরিচিতি লাভ করেন। কবির ছোটবেলাও বেশ ঘটনাবহুল ছিলো, বিশেষ করে তার বাবার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তাকে প্রভাবিত করে সারাজীবন। কবির কবিতায় প্রকৃতি ও যুদ্ধের প্রতি যে প্রাধান্য দেখা যায়, তা তার শৈশবেরই ছায়া ছাড়া আর কিছু নয়।
বাবা উইলিয়াম হিউজ ছিলেন একজন ছুতার, তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯১৫ সালের এপ্রিলে গালিপলি পেনিনসুলাতে যুদ্ধ করেন। সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উইলিয়ামের ব্যাটালিয়নের মাত্র সতেরোজন সৈন্য ফিরে আসতে পেরেছিলেন। টেড হিউজের বাবা ছিলেন সেই সতেরো ভাগ্যবানের একজন। পরবর্তীকালে তার দেওয়া যুদ্ধের কষ্ট ও রক্তপাতের বর্ণনা কবির শিশুমনে বেদনার গভীর ছাপ রেখে যায়। সেই গভীর প্রভাবেরই প্রমাণ হলো যুদ্ধের ধ্বংস, কষ্ট আর মৃত্যু নিয়ে লেখা টেড হিউজের অসংখ্য কবিতা।
Wind, Hawk Roosting,ÔJaguarÕ, Pike এর মতো কবির বিখ্যাত সব কবিতা প্রকৃতির প্রতি তার গভীর অনুরাগ ও মুগ্ধতা প্রকাশ করে। প্রকৃতির প্রতি এই আকর্ষণ কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। যান্ত্রিক যুগে এসে প্রকৃতি নামের এই সোনার খনি খুঁজে পাওয়ার কবির গল্পটা ছিলো যেন এক গ্রাম্য কিশোরের নাড়ি ছিড়ে শহরে আসার গভীর বেদনার মতোই কষ্টের।
ক্যালডার ভ্যালি নামক এক উপত্যকা সন্নিবেশিত প্রাকৃতিক অঞ্চলে হয়েছিলো কবির জন্ম ও বেড়ে ওঠা। প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠতে উঠতে সেই প্রকৃতির সাথেই এক গভীর মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে যান কবি। সেখানকার পশুপাখি, গাছপালাসহ সবকিছুকে সেই কোমল মনের বালক চেয়েছিলো নিজের খেলার সাথী হিসেবে। কিন্তু ভাগ্যের খোঁজে সাত বছরের হিউজকে পরিবারের সাথে চলে আসতে হয় দক্ষিণ ইয়র্কশায়ারের ম্যাক্সবোরাহ শহরে। আজন্ম পরিচিত প্রকৃতির সাথে এই বিচ্ছেদই কবির মনে প্রকৃতির প্রতি মমতার এক স্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। তাই তো কবির সৃষ্টিসমূহের মধ্যে এক বিশাল অংশ জুড়ে আছে প্রকৃতির নানা সৃষ্টির প্রতি তার মুগ্ধতার নিদর্শন। এখানে বলা যায় কবির অনন্য সৃষ্টি দুটি কবিতার বই Remains of ElmetÕ I ÔThe River  এর কথা। এই বই দুটিতে কবি বলে গেছেন তার জন্মস্থানের বর্ণনা, ক্যাডলার ভ্যালির পশুপাখি, নদী আর সাধারণ গ্রাম্য মানুষের জীবনের গল্প।
শিক্ষাজীবনের শুরুতে ম্যাক্সবোরাহ স্কুলে পড়েন হিউজ। স্কুলের গ-ি পার হয়ে বৃত্তি পেয়ে পা দেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে ইংরেজি সাহিত্যকে উচ্চশিক্ষার জন্য বেছে নিলেও পরে নৃতত্ত্ববিদ্যা ও প্রাচীন সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনাতে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। তাই ভবিষ্যত পড়াশোনার জন্য ইংরেজি সাহিত্য ছেড়ে বেছে নেন নৃতত্ত্ববিদ্যা ও প্রতœতত্ত্ববিদ্যা। অবশ্য হিউজের কর্মজীবন শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করার আগে। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে ইংল্যান্ডের সরকারি বিমানবাহিনীতে দু’বছর কাজ করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তী জীবনে নিজের কর্মের তালিকাতে কবিতাকেই প্রাধান্য দেন সবচেয়ে বেশি। তার অসাধারণ সব সৃষ্টিকর্মের জন্য তাকে ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজনই শুধু বলা হয় না, তিনি ছিলেন তার সময়ে ইংল্যান্ডের প্রধান কবি, আমৃত্যু তিনি এই অবস্থান ধরে রেখেছিলেন।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়টা বিভিন্ন কারণে কবির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই পরিচয় হয় সাহিত্যের আরেক নক্ষত্র সিলভিয়া প্লাথের সাথে। সৃষ্টিশীলতায় পরিপূর্ণ এই দুটি প্রাণ আকর্ষিত হয় একজন আরেকজনের দিকে, তারা ভালোবেসে ফেলেন একে অপরকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার দু’বছর পর, ১৯৫৬ সালে তারা বিয়ে করেন। যদিও এই বিয়ে স্থায়ী হয়নি, তবু তারা দুজন একে অপরের জীবনে যে স্থান দখল করে ছিলেন, তা আর অন্য কাউকে কখনোই দিয়ে পূরণ হয়নি। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত টিকে থাকা বিয়েতে এই দম্পতির দুটি সন্তান হয়।
সিলভিয়া প্লাথ ১৯৬১ সালে হিউজ থেকে আলাদা হয়ে অন্য একটি ফ্ল্যাটে সন্তানসহ বসবাস করতে থাকেন। অন্যদিকে এই সময়ের মধ্যে হিউজ অন্য এক নারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যান। ১৯৬২ সালে সিলভিয়া প্লাথ নিজ ফ্ল্যাটে আত্মহত্যা করলে তাদের দাম্পত্যজীবন সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সিলভিয়ার আত্মহত্যার জন্য হিউজের সাথে তার ভেঙে পড়া দাম্পত্যজীবন ও হিউজের পরবর্তী সম্পর্ককে দায়ী করা হতে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে তার ব্যক্তিজীবন ও চারিত্রিক দিক নিয়ে।
সিলভিয়া আগে থেকেই হতাশাগ্রস্ত ও মানসিকভাবে ভঙ্গুর একজন মানুষ ছিলেন, আর বিয়ের পরেও তার এই হতাশার কোনো কূল-কিনারা হয়নি। তিনি নিজের পুরো জীবনে কখনোই তার মানসিক সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি বলে তার চিকিৎসক ও কাছের মানুষেরা জানান। তাই সিলভিয়ার মৃত্যুর জন্য আদৌ হিউজ দায়ী ছিলেন কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে আজও নারীবাদীরা সিলভিয়ার জীবনের করুণ পরিণতির জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হিউজের দিকেই আঙুল তোলেন। এই বিতর্ক আরো জোরালো হয়, যখন হিউজের দ্বিতীয় সম্পর্কও তার বান্ধবীর আত্মহত্যার মাধ্যমে এক দুঃখজনক পরিণতি পায়। টেড হিউজের ব্যক্তিজীবন নিয়ে নানা খোঁড়াখুঁড়ি ও তর্ক-বিতর্ক এখনো সাহিত্যমহলে অনেক জোরদার। এখান থেকে আরো বোঝা যায়, হিউজের জীবনকালেও সাহিত্যের পাশাপাশি তার ব্যক্তিজীবনও কতটা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিলো।
সিলভিয়ার সঙ্গ কবির জীবনে, বিশেষ করে লেখকজীবনে এক অনস্বীকার্য প্রভাব রেখে যায়। সিলভিয়ার সাথে বিয়ের এক বছর পরে হিউজ প্রকাশ করেন তার প্রথম কবিতার বই The Hawk in the Rain। ১৯৬০ সালে প্রকাশ করেন তার দ্বিতীয় কবিতাসংগ্রহ Lupercal। সিলভিয়ার আত্মহত্যার পরে তিন বছর পর্যন্ত হিউজ সামান্য কিছু পত্রিকার কলাম ও বই রিভিউ ছাড়া কোনো সৃজনশীল লেখা লিখতে পারতেন না।
ব্যক্তিজীবনের সেই বিশাল ধাক্কা তিনি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন ১৯৬৬ সালে আইল্যান্ড ভ্রমণের পর। ১৯৬৭ সালে তিনি প্রকাশ করেন তার পরবর্তী কবিতার বই ‘ডড়ফড়ি’। ১৯৭০ সালে ক্যালর অরকার্ড নামের এক নারীকে বিয়ে করেন হিউজ। তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘গড়ড়ৎঃড়হি’, ‘ঈৎড়’ি, ‘ঝবধংড়হ ঝড়হমং’, ‘ঈধাব ইরৎফং’। এর মধ্যে তার প্রথম প্রকাশিত কবিতার বইটিই তাকে কবি হিসেবে পরিচিতি ও সম্মান এনে দেয়। এছাড়া, হিউজ আরো কিছু লেখকের সাথে সম্মিলিতভাবে ‘দ্য আরভন ফাউন্ডেশন’ নামে নতুন লেখকদের জন্য কাজ করা একটি কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৯৮ সালের ২৮ অক্টোবর, ৬৮ বছর বয়সে এই প্রতিভাধর কবি মৃত্যুবরণ করেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com