১৯৯৭ সালে অংশীদারদের কাছে পাঠানো প্রথম চিঠিতে অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস লিখেছিলেন, এটি এখনো তার প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘প্রথম দিন’। পরে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, দ্বিতীয় দিনের অর্থ হবে স্থবিরতা, তারপরে অপ্রাসঙ্গিকতা। আত্মতুষ্টি এড়াতে বেজোসের সেই উচ্ছ্বসিত আহ্বান আজ যথার্থ বলেই মনে হয়।
সিলিকন ভ্যালির পাঁচ টেক জায়ান্ট অ্যালফাবেট, অ্যামাজন, অ্যাপল, মেটা এবং মাইক্রোসফট। অনেকদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার ও অর্থনীতির মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা। আশ্চর্যজনকভাবে নির্ভরযোগ্য প্রবৃদ্ধি ও মুনাফার সমন্বয় ঘটিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু একটি ঝঞ্ঝাটপূর্ণ তৃতীয় প্রান্তিকের পরে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সম্মিলিতভাবে তাদের বাজার মূলধন ৩৭ শতাংশ কমে গেছে। সংখ্যায় হিসাব করলে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার উধাও হয়েছে।
ল’জ অব লার্জ নাম্বার বা বৃহৎ সংখ্যার আইন বলছে, টেক জায়ান্টরা পরিপক্ব হবে, তা অবধারিত। গত প্রান্তিকে তাদের বিক্রয় বৃদ্ধির হার কমে নয় শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে সামান্য বেশি। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠান একটি অর্থনৈতিক চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। স্মার্টফোন, ডিজিটাল বিজ্ঞাপন ও স্ট্রিমিং দুনিয়ায় অনুপ্রবেশের হার বেড়েছে। অর্থাৎ, মূল ব্যবসায় ধীরগতির পাশাপাশি টেক জায়ান্টরা একে অপরের ব্যবসায় অনুপ্রবেশ করছে এবং প্রতিযোগিতা বাড়াচ্ছে।
বলা যায়, তারা ‘কংলোমেরাইটিস’-এর হুমকির সম্মুখীন। এই রোগের উপসর্গ হলো স্ফীতি ও ইগোম্যানিয়া (মাত্রাতিরিক্ত অহমিকা)। টেক জায়ান্টদের নিয়োগ, পরীক্ষামূলক উদ্যোগ, অন্তঃসারশূন্য প্রকল্প এবং ডেটা সেন্টার তৈরিতে ব্যয়ের সাম্প্রতিক প্রবণতা বিবেচনা করুন। গত মার্চ মাসে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত বার্ষিক ব্যয় প্রথমবারের মতো এক ট্রিলিয়ন ডলার এবং কথিত ‘হালকা ব্যবসা’র বস্তুগত কারখানাগুলোর মূল্য ৬০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা পাঁচ বছর আগের তুলনায় তিনগুণ বেশি। বর্ধিত খরচের ফলে মূলধনের ওপর রিটার্ন পাঁচ বছর আগের ৬০ শতাংশ থেকে কমে মাত্র ২৬ হয়েছে।
সফল প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য মনোযোগ হারানো বা খরচ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার নজির খুব কমই দেখা যায়। ১৯৮০’র দশকে আরজেআর নাবিস্কোর নির্বাহীরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে জেট প্লেন ও গলফে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। টানাটানিতে পড়েছিল জেনারেল ইলেকট্রিকও। ২০০৮-০৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময় সরকারি সহায়তা নিতে হয়েছিল তাদের। এ ধরনের বিশৃঙ্খলা আটকানোর সর্বোত্তম উপায় হলো পর্ষদ ও বিনিয়োগকারীদের সক্রিয়তা। যখন সফল পরিচালকরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তারা সবার চেয়ে ভালো বোঝেন, তখন তাদের লাগাম টেনে ধরা পর্ষদের কাজ। কিন্তু এখানে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি ঝামেলা রয়েছে। প্রায়ই সেগুলো প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও প্রতিষ্ঠাতাদের কাছে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ করে থাকে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ ভোটাধিকার ভোগ করেন, যা তাদের প্রায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়। এ ধরনের কর্মকর্তারা প্রায়ই স্বপ্নদর্শী হিসেবে একটি ইমেজ তৈরির চেষ্টা করেন, যা বহিরাগত বিনিয়োগকারীদের ভীত করে তোলে।
এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটায়। এই টেক জায়ান্টের মূল্যমান এ বছর ৭৪ শতাংশ কমে গেছে। তাদের মূল ব্যবসা টালমাটাল। এতে অনেক বেশি তিক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে, খুব কম তরুণ গ্রাহক ও বিজ্ঞাপন আকর্ষণ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
এটি এরই মধ্যে স্পষ্ট যে, মেটার প্রধান মার্ক জুকারবার্গ প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ হিসেবে মেটাভার্সের ওপর বাজি ধরেছেন। ব্যবসায় সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভরতা থেকে বৈচিত্র্য আনার এই প্রচেষ্টায় অ্যাপল প্রথম আইফোন তৈরি করতে যা খরচ করেছিল, তার চেয়ে ২০ গুণ বেশি ব্যয়ের পরিকল্পনা করছেন ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা। আর এসবই সম্ভব হচ্ছে জুকারবার্গের দ্বৈত শেয়ারের কারণে। এটি তাকে ৫৪ শতাংশ ভোটাধিকার দেওয়ায় বাইরের বিনিয়োগকারীদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন মেটা প্রধান।
গুগলের মালিক অ্যালফাবেট এ বছর ভালো পারফরম্যান্স করলেও তা পুরোপুরি সন্তোষজনক নয়। এর প্রতিষ্ঠাতারা ৫১ শতাংশ ভোটাধিকার ধরে রেখেছেন, যা তাদের অন্য অংশীদারদের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করার অনুমতি দেয়। এর মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে অ্যামাজন। এখনো এর নির্বাহী চেয়ারম্যান থাকা জেফ বেজোসের কাছে ভোটাধিকার রয়েছে ১৫ শতাংশেরও কম। তাই তাকে বিনিয়োগকারীদের কাছে কিছুটা হলেও প্রতিক্রিয়াশীল হতে হয়।
এই প্রবণতার সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে অ্যাপল ও মাইক্রোসফট। উভয় প্রতিষ্ঠানই বেশ পুরোনো এবং নিয়ন্ত্রণকারী অংশগুলোতে আর কোনো প্রতিষ্ঠাতা নেই। জায়ান্ট দুটি ‘এক শেয়ার এক ভোট’ নীতিতে পরিচালিত হয়। উভয়ই বাইরের বিনিয়োগকারীদের কথা শোনে। এ বছর পাঁচ জায়ান্টের মধ্যে সবচেয়ে ভালো পারফর্ম করেছে এ দুটি প্রতিষ্ঠান। আপনি যখন শিল্পে প্রভাব বিস্তার করছেন এবং শত শত কোটি ডলারের সম্পদ তৈরি করেছেন, তখন আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও বাইরের সমালোচনা মেনে নেওয়া কঠিন। তা সত্ত্বেও বড় প্রযুক্তি ব্যবসায়ীদের আরও নম্রতা ও আরও ভালো পারফরম্যান্স দেখানো প্রয়োজন। অন্যথায় ‘তৃতীয় দিনে’ তাদের ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বড় দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট