১. প্রাচীন প-িত, গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ছিলেন বহুবিদ্যায় পারদর্শী। যুক্তিবিদ্যা থেকে জীববিজ্ঞান, রাজনীতি থেকে নীতিশাস্ত্র, নন্দনতত্ত্ব থেকে নাট্যচর্চা ও কাব্যতত্ত্ব পর্যন্ত মানব জ্ঞানের প্রায়-প্রতিটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য এবং স্থায়ী অবদান রেখেছেন তিনি। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী সময়ের দার্শনিক সক্রেটিস ও প্লেটোর জ্ঞানচর্চার উত্তরাধিকারী। অ্যারিস্টটলের লেখাগুলো আজ পর্যন্ত অবিশ্বাস্যভাবে প্রভাবশালী। যে কারণে তিনি কেবল প্রথম শিক্ষক নামেই পরিচিত নন, নমস্য দার্শনিক রূপেও স্মরণীয়।
২. অ্যারিস্টটল ছিলেন তৎকালের গ্রিক নগররাষ্ট্রের বাসিন্দা। রাষ্ট্র তখন আজকের মতো বিশাল অবয়ব লাভ করেনি, এথেন্স, স্পার্টা প্রভৃতি ছোট্ট ছোট্ট নগরকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রিস দেশের প্রাচীন নগর রাষ্ট্রের রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ‘সরকারের দ্রুত পরিবর্তন। এই পরিবর্তন গ্রিক রাজনৈতিক জীবনে চরম হতাশার সৃষ্টি করেছিলাে। নগর রাষ্ট্রসমূহের এই হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা অবলােকন করে অ্যারিস্টটল ব্যাপক অনুসন্ধান কার্যে নিয়ােজিত হন। আর এই অনুসন্ধানের অব্যবহিত ফলই হচ্ছে তার বিপ্লব সম্পর্কিত মতবাদ, যা ‘বিপ্লবতত্ত্ব নামে পরিচিত।
৩. অ্যারিস্টটল তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ পলিটিক্স-এ বিপ্লব সম্পর্কিত মতবাদের ব্যাখ্যা এবং বিপ্লবের প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যা আজকের বাস্তবতাতেও প্রাসঙ্গিক।
তাঁর মতে বিপ্লবের কারণসমূহ দুই প্রকারের। কিছু আছে সাধারণ কারণ আর কিছু বিশেষ কারণ। মোটামুটিভাবে অ্যারিস্টটল বর্ণিত বিপ্লবের প্রধান কারণগুলো হলো:
ক) অসমতা: রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যদি ব্যাপক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসমতা বিদ্যমান থাকে এবং যােগ্যতম ব্যক্তিরা যখন মনে করেন যে, তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের চাইতে যােগ্যতার দিক দিয়ে কোনও অংশে কম নয়, অথচ তারা রাজনৈতিক অধিকার ভােগ করতে পারছেন না, তখন তারা রাজনৈতিক-অংশগ্রহণের অধিকার আদায়ের দাবিতে বিপ্লব করে।
খ) ক্ষমতার অপব্যবহার: তিনি মনে করেন যে, বিপ্লব সংঘটিত হয় রাষ্ট্রীয় তথা সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে। শাসক যখন জনকল্যাণ বাদ দিয়ে সরকারি তহবিল নিজের ইচ্ছামতাে ব্যবহার করেন এবং অসৎ মুনাফা অর্জন করেন, তখন জনগণ বিপ্লবী হয়ে ওঠে।
গ) অবজ্ঞা: সমাজে স্থায়িত্ব এবং ভারসাম্য রক্ষাকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণি অবজ্ঞার শিকার হয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজ থেকে অনুপস্থিত বা দূরে থাকতে বাধ্য হলে তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনও শ্?েণি যদি অন্যান্য শ্রেণির চাইতে বৃহৎ ও সুযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও অবহেলিত হয়, তবে বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
ঘ) ভিন্ন ভিন্ন ন্যায়বিচার: সমাজে বিচার সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা বিভিন্ন প্রকার বিপ্লবী মনােভাবের সূচনা করে। কোনও সমাজের উল্লেখযােগ্য অংশ যখন মনে করে যে, তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হচ্ছে না, তখন তারা বিপ্লবী হয়ে ওঠে।
ঙ) উপাধি প্রদান: সমশ্রেণির কোনও ব্যক্তির মধ্যে সরকার যদি কাউকে সম্মানসূচক উপাধি প্রদান করে আর কাউকে বঞ্চিত করে, তবে যাকে বা যাদেরকে বঞ্চিত করা হলাে, তিনি বা তারা বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটাতে পারেন।
চ) মুনাফা লাভের বাসনা: মুনাফা ও সম্মান অনেক সময় বিপ্লবের মাধ্যমে সৃষ্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাওয়া যায়। তাই অনেকে মুনাফা ও সম্মান লাভের আশায় বিপ্লব ঘটায়।
৪. অ্যারিস্টটলের বিপ্লবের কারণগুলো যুগে যুগে বিশ্বের প্রায়-সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সমভাবে গৃহীত হয়েছে। কালের গতি একে ম্লান করতে পারেনি, বরং তাঁর ‘বিপ্লবতত্ত্ব সর্বকালে সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গ্রহণীয় হয়েছে। বিশেষত, যে সমস্ত কারণে বিপ্লব হয় বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, সেগুলো অনেকাংশেই এখনও নানা দেশে ও সমাজে বাস্তব বলে বিবেচিত। একইভাবে, তিনি বিপ্লব প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন, তা-ও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বিপ্লব প্রতিরোধের জন্য যা বলেছেন, তাহলো: ক) শাসন ব্যবস্থায় যারা অংশগ্রহণ করে তাদের নিজেদের মধ্যে আচরণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে।
খ) আইনহীনতার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
গ) গণতন্ত্রে নাগরিকদের প্রতি সুবিবেচনা প্রদর্শন করতে হবে।
ঘ) সমাজের নীতি ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ সম্পর্কে যারা সন্তুষ্ট নয়, তাদের মনোভাবের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।
ঙ) গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করতে হবে এবং সেগুলোকে আইনানুগ পন্থায় পরিচালিত করতে হবে।
চ) ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা যাতে গজিয়ে উঠতে না পারে এবং শ্রেণিগুলোর মধ্যে বিশেষ কোনও গোষ্ঠী যাতে মাত্রাতিরিক্ত সম্পদ লাভ করতে না পারে, সে ব্যাপারে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে।
৫. অ্যারিস্টটল বিপ্লবের কারণ বিশ্লেষণের পর তা নিবারণের পন্থা নির্দেশ করতে গিয়ে যেসব ধারণাকে একত্রে ‘বিপ্লবতত্ত্ব বলা হয়। তাঁর মতামত যদিও তৎকালীন গ্রিক নগররাষ্ট্র গুলোর অবস্থার প্রেক্ষিতে ছিল, তথাপি এর উল্লেখযোগ্য অংশ বর্তমানেও কার্যকর রয়েছে এবং প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি। আধুনিক কালে যে কয়টি বৃহৎ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোর পর্যালোচনায় বিশ্লেষকগণ বিপ্লবতত্ত্ব-এ অ্যারিস্টটল বর্ণিত কারণগুলোর উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন। যেমন, বিপ্লবের সাধারণ কারণ হিসেবে ধরা হয়, সামাজিক বৈষম্য। সম্পদের অসম বণ্টন।
আর একপক্ষের অফুরন্ত সম্পদ লাভ। একপক্ষ ক্ষমতা ব্যবহার করে হাজার কোটি টাকার পাহাড় গড়ে। পক্ষান্তরে জনতার বিশাল অংশ সাধারণভাবে জীবন-জীবিকার সন্ধান পায় না। অধিকাংশের নিত্যদিনের জীবনপ্রবাহ পরিণত হয় জীবনযুদ্ধে। আবার কখনও হঠাৎ করে অনুগত লোকজন বিশাল সম্মানের অধিকারী হয়ে ওঠে। একসময় যাকে রোজ চক্কর কাটতে হতো, সে লোক যদি সবাইকে ডিঙিয়ে সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাথায় চড়ে বসে, তাহলে ক্ষোভ ও অস্থিরতা হওয়াই স্বাভাবিক। অযাচিত সম্মান ও ক্ষমতাবান নিজেকে সামলাতে না পেরে স্বৈরাচারী হবে এবং বিপুল সংখ্যক বঞ্চিত মানুষ ক্ষিপ্ত হবে। তারপর আসে নিরাপত্তার ভীতি। লোকজন শান্তি চায়, সারাদিন কষ্ট করে রাতের শান্তির ঘুম চায়। যদি এটা মানুষ না পায়, তাহলেও বিপ্লব বা অস্থিতিশীলতা অনিবার্য। উপরন্তু নিয়মের ব্যতিক্রম করে স্বৈরতার প্রসার ঘটানে হলেও মানুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
৬. অ্যারিস্টটল যে বিপ্লবের কথা বলেছিলেন, তা শুধু বৃহত্তর রাষ্ট্র বিপ্লব, যেমন রুশ বিপ্লব (১৯১৭), ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯), সিপাহী বিপ্লব (১৮৫৭) ইত্যাদিকে বুঝায় না। বরং অধিকাংশ সময় বিপ্লব শব্দটি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের তথা ক্ষমতার একটি পরিবর্তনকেও সূচিত করে। বিপ্লব হচ্ছে সামাজিক সম্পর্কসমূহের গুণগত পরিবর্তন আর রাজনৈতিক বিন্যাসের পালাবদল। বিবর্তনের মাধ্যমে তা প্রতিনিয়ত চলমান থাকে। কিন্তু যখন তা তীব্র গতিবেগে আঘাত হানে, তখন সেটাকে বিপ্লব আখ্যা দেওয়া হয়। ইতিহাস মূলগতভাবে গতিময় এবং এই গতিময়তার উৎস হলো সমাজের বিভিন্ন সম্পর্কের, বিশেষত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্রমাগত পরিবর্তন। তা যদি স্থবির হয় ও গুণগত বা ইতিবাচক পথে না চলে, তখন বিপ্লব ধাক্কা দিয়ে অকাম্য অবস্থাকে কাম্য অবস্থায় পরিবর্তন ঘটায়।
৭. এইসব বিষয় বিশ্বের সকল সময়ের সকল শাসকেরই জানা। তারা স্পষ্টভাবে জানেন, কেন এবং কীভাবে বিপ্লব, অসন্তোষ, অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা হয় বা হতে পারে। একইভাবে তা প্রতিরোধের পথ এবং পন্থাও তাদের অজানা নয়। তবে, বিচক্ষণ শাসকগণ আগেভাগে সতর্ক পদক্ষেপ নিয়ে কারণগুলোকে বীজ থেকে অঙ্কুরিত হতে দেন না। মানুষকে অস্থির ও ক্ষিপ্ত না করে শান্ত রাখেন। আবার অনেকেই শক্তিপ্রয়োগের পথে অগ্রসর হয়ে পরিস্থিতি খারাপ করে ফেলেন।
৮. বিপ্লব আর নৈরাজ্য বর্তমান সময়ে অনেকটাই সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেকোনও পরিবর্তন যখন স্বাভাবিকভাবে না হয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে আবর্তিত হয়, তখন পরিস্থিতি বিপ্লবাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। এমন পরিস্থিতিকে তুলনা করা হয় বারুদের স্তূপের সঙ্গে। তখন সামান্য একটি দেশলাই কাঠিই যথেষ্ট দাবানল তৈরি করার জন্য। কে জানতো, আসাদের মৃত্যু ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ঘটাবে? ডা. মিলনের মৃত্যু এরশাদের পতনকে নিশ্চিত করবে? মাগুরার উপনির্বাচন সরকার পতনের টার্নিং পয়েন্ট হবে? কেউ জানে না, কোন ঘটনা থেকে জন্ম নেবে অভাবনীয় পরিস্থিতি।
৯. রাজনীতি একটি জটিল প্রক্রিয়া, যার সমান্তরালে বহু বিপদ ও ঝুঁকি সবসময়ই ক্রিয়াশীল থাকে। এই সত্যকে মেনেই মানুষ রাজনীতি করে। নেতারা সরকার ও দল চালান। চেষ্টা করেন স্থিতিশীলতা ও শান্তি বজায় রাখতে। পরিস্থিতি যাতে বিপ্লবাত্মক না হয়, সেটা কৌশলী নেতৃত্ব অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিশ্চিত করেন। চেষ্টা করেন মানুষের ক্ষোভ, অসন্তোষ যেন বারুদের স্তূপে পরিণত না হয় এবং সেখানে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে কেউ যেন দাবানলের সৃষ্টি করতে না পারে।
১০. আজকাল বিভিন্ন রোগের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে তথ্যপ্রযুক্তির সুবাদে সকলেই কমবেশি অবগত। কিন্তু অবহিত হওয়া কিংবা জানাই যথেষ্ট নয়। কারণগুলোকে দূর করা এবং প্রতিকার বিধান করাই হলো সুস্বাস্থ্যের আসল কথা। তা না করে রোগমুক্ত থাকা অসম্ভব। বিপ্লব, অসন্তোষ, অস্থিরতা ইত্যাদির কারণ ও প্রতিকার সর্বজনবিদিত বিষয়। আড়াই হাজার বছর আগে সেই অ্যারিস্টটলের আমল থেকে বিষয়গুলো আলোচিত ও চর্চিত। আজকের বাস্তবতাতেও এইসব বিষয় দৃশ্যমান এবং প্রাসঙ্গিক। বরং কখনও কখনও এসব বৃদ্ধি পেতে পেতে বিস্ফোরণমুখী হয়ে পড়ে। তথাপি কারণগুলোকে দূর করা এবং প্রতিকার বিধান করার লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় না। পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে ঘটতে তা বারুদের স্তূপে রূপান্তরিত হয়। কেউ কেউ তখন হয়তো দাবানল জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য দেশলাই কাঠির সন্ধান করে। সঙ্কুল পরিস্থিতিতে তীব্র গতিতে চলতে থাকে নিপীড়ন, নৈরাজ্য, রক্তারক্তি। বাড়তে থাকে সমাজের ক্ষত ও মানুষের বিপদ।
অ্যারিস্টটলের বিপ্লবতত্ত্বর আলোকে আজকে যে বাস্তবতার চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা মোটেও আশাপ্রদ নয়।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশ্লেষক।