প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহের দিক থেকে শীর্ষস্থান ভারতের দখলে। ২০২১ সালেও এ খাত থেকে দেশটির আয় ছিল ৮৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছর রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসী ভারতীয়রা ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২২ সালে ভারতের রেমিট্যান্স আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করবে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হবে ১২ শতাংশের বেশি। যদিও প্রতিবেশী দেশটির বিপরীত চিত্র বাংলাদেশের। ২০২১ সালে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে ২২ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলেও চলতি বছরে এসে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত প্রবাসীরা ১৯ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন। ডিসেম্বরের হিসাব যুক্ত হলেও তা ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস।
বিদেশে জনশক্তি রফতানির ধরনে গত কয়েক বছরে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে ভারত। আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছিল তাদের অভিবাসী শ্রমিকদের প্রধান গন্তব্য। এদের বড় অংশই ছিল স্বল্পশিক্ষিত ও অদক্ষ। কিন্তু বর্তমানে ভারতীয়দের প্রধান গন্তব্য হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশ। শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমিক রফতানি করায় উচ্চ আয়ের দেশগুলোয় বেশি বেতনে চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন তারা। এ কারণে দেশটির রেমিট্যান্স প্রবাহ দ্রুতগতিতে বাড়ছে বলে বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরা হয়েছে। চলতি বছরে ডলারের বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রা রুপির অন্তত ১০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। প্রতিবেশী দেশটির রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নও ভূমিকা রাখছে বলে উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক।
ডলারের বিপরীতে চলতি বছর বাংলাদেশী মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। টাকার রেকর্ড এ অবমূল্যায়নও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারেনি। অথচ চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্তই ৮ লাখ ৭৪ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক অভিবাসী হয়েছেন। ২০২১ সালেও বিদেশ গিয়েছেন ৬ লাখ ১৭ হাজারের বেশি শ্রমিক। বিদেশের শ্রমবাজারে নতুন শ্রমিক যুক্ত হওয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার কথা। কিন্তু দেখা যায়, যেসব দেশে বেশি শ্রমিক গিয়েছেন সে দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স কমেছে সবচেয়ে বেশি। দেশ থেকে অর্থ পাচার প্রতিরোধের পাশাপাশি হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রবাসীরা ঠিকই দেশে থাকা তাদের স্বজনদের কাছে অর্থ পাঠাচ্ছেন। ব্যাংকিং চ্যানেলে না পাঠিয়ে তারা মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন অবৈধ হুন্ডিকে। ডলারের বিনিময় হার নিয়ে অস্থিরতার পাশাপাশি হুন্ডির বাজার জমজমাট থাকার কারণেই অভিবাসী বাংলাদেশীরা অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোয় উৎসাহিত হচ্ছেন। এতে তাদের স্বজনরা উপকৃত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। রিজার্ভে ডলার যুক্ত হচ্ছে না। হুন্ডির বাজার চাঙ্গা হওয়ার কারণে দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গিয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশে ডলারের বিনিময় হার নিয়ে বড় ধরনের অস্পষ্টতা রয়েছে। রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের সর্বোচ্চ দর এখন ১০১ টাকা। এক্সচেঞ্জ হাউজের রেমিট্যান্সের দর ১০৭ টাকা। আবার খুচরা বাজারে ডলারের দর ১১৩-১১৫ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে ৯৭ টাকায়। এক বাজারে ডলারের এত ধরনের দর হুন্ডি তৎপরতাকেই উৎসাহিত করছে। প্রবাসী আয় সংগ্রহে ডলারের দর বেঁধে না দিয়ে ব্যাংকগুলোকে স্বাধীনতা দিলে রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেক বাড়ত।’
প্রবাসী আয়ের উৎস দেশগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের ধরন প্রায় একই। প্রতিবেশী দেশটির রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস ছিল গলফ করপোরেশনভুক্ত পাঁচ দেশ তথা সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান ও কাতার। বাংলাদেশেরও রেমিট্যান্স আহরণের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে এ পাঁচটিরই নাম রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্সের উৎসে বেশ পরিবর্তন এসেছে ভারতের। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্য বলছে, এতদিন ভারতের রেমিট্যান্স আহরণের শীর্ষ দেশ ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। এখন সেই স্থানে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুর থেকে ভারতের রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৬ থেকে ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। বিপরীতে গলফভুক্ত পাঁচ দেশ থেকে তাদের রেমিট্যান্স আহরণ কমেছে ২৮ থেকে ৫৪ শতাংশ পর্যন্ত। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো উচ্চ আয়ের দেশগুলো থেকেও ভারতে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বাংলাদেশীদের অভিবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী শ্রমিক রফতানি বহুগুণ বেড়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের ধরনে তেমন পরিবর্তন আসেনি। এখনো অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত ও অদক্ষ লোকেরাই বিদেশ যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে প্রধান গন্তব্য হলো সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে। সেখানেও অদক্ষ শ্রমিকরাই বেশি অভিবাসী হচ্ছেন। এ কারণে প্রবাসী বাড়লেও প্রধান শ্রমবাজারগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে তা বেড়ে ২২ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। কিন্তু চলতি বছর এসে আবারো রেমিট্যান্স প্রবাহ বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। চলতি ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস বলছে, ডিসেম্বর মাস যুক্ত হলেও চলতি বছর বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ২১ বিলিয়ন ডলারেই সীমাবদ্ধ থাকবে। অর্থবছরের হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছর রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৫ শতাংশেরও বেশি কমে গিয়েছিল। সেটা চলতি অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে। এক মাসে কিছুটা বাড়লে অন্য মাসেই তা পতন হচ্ছে। সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে কেবল ২ দশমিক ১৪ শতাংশ।
ভারতের মতো বাংলাদেশেরও অবশ্য রেমিট্যান্সের উৎস দেশে পরিবর্তন এসেছে। এতদিন বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ের প্রধান উৎস ছিল সৌদি আরব। চলতি বছর প্রধান উৎস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নাম উঠে এসেছে। নভেম্বরেও দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৩০ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। একই মাসে সৌদি আরব থেকে ২৯ কোটি ৫১ লাখ ডলার এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য থেকেও বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। বিপরীতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডাও ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্বাহী পরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের মধ্যে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠাতে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রবাসী বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। এ কারণে রেমিট্যান্সের পাশাপাশি দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধিও কিছুটা কমে যায়। তবে প্রবাসীদের মধ্যে আবারো আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। গত সোমবার এক দিনেই তারা ১২২ মিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। আবার ব্যাংক খাতে আমানতেরও প্রবৃদ্ধি হতে শুরু করেছে।’-কণিকবার্তা