ধর্মচিন্তা
জুমু’আহ শব্দটি আরবি। এর অর্থ একত্রিত হওয়া, সম্মিলিত হওয়া, কাতারবদ্ধ হওয়া। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে (শুক্রবার) প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান একটি নির্দিষ্ট সময়ে একই স্থানে একত্রিত হয়ে জামা’আতের সঙ্গে সে দিনের যোহরের সালাতের পরিবর্তে এই সালাত ফরজরূপে আদায় করেন, সে জন্য এই সালাতকে জুমা’আর সালাত বলা হয়। জুম’আ নামে পবিত্র কুরআনে একটি স্বতন্ত্র সূরা নাজিল হয়েছে। জুম’আর সালাত ফরজ হয় প্রথম হিজরিতে। রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরতকালে কুবাতে অবস্থান শেষে শুক্রবার দিনে মদিনা পৌঁছেন এবং বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় পৌঁছে যোহরের ওয়াক্ত হলে সেখানেই তিনি জুম’আর সালাত আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুম’আর সালাত।
ঢাকা শহরের মসজিদগুলোতে বিশেষত জুমআর নামাজে বেহিসাব মুসল্লি উপস্থিত হন, আলহামদুলিল্লাহ। এমন কোন মসজিদ পাওয়া যাবে না- যেখানে মসজিদ ভরে আশপাশের বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট এবং রাস্তায় মানুষ না দাঁড়িয়েছেন। সারাদেশের চিত্রও প্রায় একই রকম হবে। জুম’আর সালাত আদায়ের জন্য মুসলমানদের এই বাঁধভাঙ্গা জোয়ার দেখলে আবেগে মন ভরে যায়। সত্যিই জাতি হিসেবে আমরা ইসলামপ্রিয়, ধর্মপ্রাণ। ইসলাম আমাদের নি:শ্বাসে-বিশ্বাসে এবং গোটা অস্তিত্বের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
সালাতুল জুম’আ মুসলিম উম্মাহর সাপ্তাহিক এক ঐতিহাসিক মহামিলন মেলা। আল্লাহ তা’আলা সালাতুল জুম’আ মুসলমানদের জন্য আবশ্যক করেছেন। তিনি বলেন, “হে ঐ সব লোক, যারা ঈমান এনেছো, জুম’আর দিন যখন নামাযের জন্য তোমাদের ডাকা হয় তখন আল্লাহর যিকরের দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা ছেড়ে দাও। এটাই তোমাদের জন্য বেশী ভাল যদি তোমাদের জ্ঞান থাকে”। জুম’আর দিনের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যার ওপর সূর্য উদিত হয়েছে, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হলো জুম’আর দিন। এই দিনে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাঁকে জান্নাতে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং এই দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে (সহিহ মুসলিম)।’ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বাহিরে সালাতুল জুম’আ বিষয়ে কুরআন মাজিদের স্বতন্ত্র একটি সূরা অবতীর্ণ করা এবং রাসূল (সা.) বর্ণিত অনেকগুলো হাদীস থেকে জুম’আর সালাত ও খুতবার উদ্দেশ্য, গুরুত্ব-তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়।
আজকের আলোচনায় জুম’আর সালাত ও খুতবা নিয়ে ভিন্নধর্মী কিছু কথা তুলে ধরতে চাই। আমার দেখা মতে- বাংলাদেশের মসজিদগুলোর অধিকাংশ ইমাম ও খতিব একটি নির্দিষ্ট ডিসিপ্লেইনের। আর প্রায় সকল মসজিদের মসজিদ কমিটি বর্তমানে এমন লোকদের দ্বারা গঠিত, যারা নামাজ কায়েমকারী নন বরং লোক দেখানো নামাজ আদায়কারী। তারা ইসলাম এবং সালাতের সামাজিক ও রাজনৈতিক কল্যাণ সম্পর্কে খুম কম ধারণা রাখেন। যতটুকু ধারণা রাখেন তার সিংহভাগই ভেজালমিশ্রিত এবং অস্বচ্ছ। মসজিদ যে সামাজিক ন্যায় বিচার এবং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে তা এসব মানুষজন জেনেশুনে বা না জেনে এড়িয়ে চলেন। বলা বাহুল্য, ক্ষেত্রবিশেষ তারা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অন্যায়-অবিচার এবং অসামাজিক কার্য কলাপের সাথে জড়িত। সুদ-ঘুষ, মিথ্যাচার, অনাচার-অশ্লীলতা, জবর দখল এবং মানুষের অধিকার নষ্ট করার কাজে তারা সিদ্ধহস্ত হিসেবে সমাজে যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেন। এহেন চরিত্রের লোকদের মাধ্যমেই মসজিদগুলোতে ইমামের মত এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তির নিয়োগ হয়। কমিটির লোকজন যেহেতু সালাতের কুরআন-হাদীস বর্ণিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন না তাই তাদের নিয়োগগুলোও ক্ষেত্রবিশেষ সঠিক হয় না। তাদের দৃষ্টিতে ইমাম হওয়ার জন্য- লম্বা দাঁড়ি-পাগড়ি, গোল জামা, উচ্চ কণ্ঠস্বর ইত্যাদির পাশাপাশি রাজনৈতিক দিকটি প্রাধান্য পায় বেশী। তারা নেতিবাচভাবে খেয়াল করেন যে, লোকটি হক কথা বলতে কতটা পারদর্শী, সমাজের অসঙ্গতি-জুলুম সম্পর্কে কতটা জ্ঞান রাখেন, কোন ধরণের রাজনৈতিক জ্ঞান রাখেন কি-না, বা দাঁড়ি-টুপি, লেবাসে তিনি একটি নির্ধারিত গোষ্ঠীর বাহিরের লোক কি-না ইত্যাদি। এসবের কোনকিছু পেলে তাকে পয়লা নম্বরে বাদ দিয়ে দেন। এভাবে ছাকতে ছাকতে শেষে এমন লোক পান যারা- খয়ের খাঁ, তোষামোকোরী, হক কথা বলতে অক্ষম, ফায়দা-ফিকির, দান-সাদকা ও জিকিরের ওয়াজে পারদর্শী এবং সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে যাদের মাথায় কোন চিন্তা ভাবনা নাই। তারা দাওয়াত খেয়ে, হাদিয়া-তোহফা গ্রহণ করে এবং কমিটির লোকদেরকে সালাম-কালাম করে পদ টিকিয়ে রাখতে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। কমিটির লোকদের চেখের দিকে তাকিয়ে বক্তব্যের মোড় ঘুরিয়ে দিতে তারা হন পারঙ্গম। তাই এসব চাকরি হারানোর ভয়ে সদা কম্পমান থাকা ইমাম সাহেবানদের জবান ও বয়ান থেকে কখনও হক কথা বের হতে পারে না। মসজিদের বাহিরে তার মসজিদের মুসল্লিদের হাজারো অপকর্ম তিনি দেখেও না দেখার ভান করেন। কখনও কালক্রমে কোন দরবারে উপস্থিত হলেও চাকরি হারানোর ভয়ে ইসলামের উপর অবিচল থেকে নিরপেক্ষ বিচার-ফয়সালা করতে পারেন না। বিশেষত, জুম’আর খুতবায় অবাস্তব ও কাল্পনিক কিচ্ছা কাহিনী বলে, চিৎকার করে তারা মুসল্লিদেরকে সাময়িকভাবে মোহাবিষ্ট করে রাখেন। মুসল্লিরাও আধা ঘুমঘুম চোখে বয়ান শুনেন ও মাঝেমধ্যে সোবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ জিগির তুলেন। এসব জিগিরে লক্ষ-কোটি সওয়াব পাবার কথা তারা পূর্বেই জেনেছেন!
আসলে দীন ইসলামে মসজিদের ভূমিকা ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। শুধু ফায়দা, জিকির ও সওয়াবের ওয়াজ করে সেই মহান উদ্দেশ্য সাধন হতে পারে না। মসজিদের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা অন্যতম উদ্দেশ্য। সেজন্য প্রতি জুম’আর খুতবায় এসব বিষয়ে কুরআন-হাদীস এবং ইসলামের সোনালী যুগ থেকে অথেনটিক আলোচনা ধারাবাহিকভাবে হতে পারে। হালাল-হারাম নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা হতে হবে। কবিরা গুনাহ্ নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা হওয়া জরুরী। সমাজে মানুষের উপর মানুষের যে অন্যায় কর্তৃত্ব-জুলুম তা নিয়ে কার্যকর আলোচনা হওয়া দরকার। সকল পর্যায়ে সচ্ছতা ও জবাবদিহির অনুভূতি জাগ্রত করা জুম’আর খুতবার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এমন মানুষ তৈরির জন্য জুম’আর খুতবাকে কাজে লাগানো যায়, যারা নিজের কর্তব্য এবং অপরের অধিকারের ব্যাপারে হবেন সজাগ-সচেতন। তারা কল্যাণকামী হবেন, নিজে কম নিয়ে এবং অপরকে তাদের প্রাপ্যেও চেয়ে বেশী দিতে থাকবেন সদা প্রস্তুত। এগুলোই জুম’আর খুতবার উদ্দেশ্য। ইমাম সাহেব তার মহল্লার মুসল্লিদেরকে উপদেশ দিবেন, নসীহত করবেন। সমাজ সংশোধনের কথা বলবেন। এক জুম’আ থেকে আরেক জুম’আ পর্যন্ত কী দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে তা বিস্তারিত এবং প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরবেন। আরবী-বাংলার সংমিশ্রণে খুতবা দেওয়া বাঞ্ছনীয়। খুতবা যেন দুর্বোধ্য না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। দীর্ঘ সময় ধরে কালেকশনের ওয়াজ করলে মানুষের মধ্যে মসজিদে আসার ব্যাপারে আগ্রহ কমে যেতে পারে- ইমাম সাহেব সেদিকে নজর রাখবেন। ইমামের খুতবা যেন সংশ্লিষ্ট জনপদের মানুষদের সুশৃঙ্খল, পরহেজগার ও পরোপকারী হতে সাহায্য করে। এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) এর একটি হাদীস উল্লেখযোগ্য। ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন খুতবা দিতেন তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে যেত, তাঁর কণ্ঠস্বর উঁচু হতো এবং তাঁর ক্রোধ কঠিন হতো। এমনকি মনে হতো তিনি যেন আসন্ন শত্রুসেনার আক্রমণের সতর্ককারী। (মুসলিম, আস-সহিহ ২/৫৯২)। এ হাদিস থেকে বুঝা যায়, ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ এবং দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর খুতবাই হচ্ছে রাসূল (সা.) এর খুতবার বৈশিষ্ট্য। হালকা কথাবার্তা এবং হাসির উদ্রেককারী ওয়াজ কাম্য নয়। হিকমতের সাথে সমাজ ও মানুষের জন্য করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ে সমযোপযোগী বক্তব্য রাখাই হোক জুম’আর খুতবার উদ্দেশ্য।
পরিশেষে বলা যায়, ইসলামী সমাজে মসজিদ, সালাতুল জুম’আ এবং খুতবার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সীমাহীন। মসজিদের ইমাম হবেন জনগণের নেতা। আর জনগণের নেতা বা নির্বাচিত প্রতিনিধি যখন হবেন মসজিদের ইমাম তখন সমাজের কী চিত্র হবে তা একবার ভেবে দেখুন তো!
লেখকঃ সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক।