বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১২ অপরাহ্ন

জুমার খুতবার গুরুত্ব

সাইফুল্লাহ রুবেল :
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

সালাতুল জুমা মুসলিম উম্মাহর সাপ্তাহিক এক মহামিলন কেন্দ্র। জুমার খুতবার মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্ক যেমন মজবুত হয় তেমনি আত্মিক উন্নয়নও সাধিত হয়। জুমার নামাজ ফরজ হয় প্রথম হিজরিতে। রাসূলুল্লাহ সা: হিজরতকালে কুবাতে অবস্থান শেষে শুক্রবার দিনে মদিনায় পৌঁছেন এবং বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় পৌঁছে জোহরের ওয়াক্ত হলে সেখানেই তিনি জুমার নামাজ আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুমার নামাজ।
জুমার নামাজ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন সালাতের জন্য আহ্বান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো, এটিই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা উপলব্ধি করো।’ (সূরা জুম’আ ৬২:৯) এ আয়াতে আল্লাহর ‘জিকর’ (স্মরণ) বলতে কী বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে কয়েকটি মত রয়েছে। কেউ বলেছেন, এখানে জিকর বলতে জুমার সালাত বুঝানো হয়েছে, কেউ বলেছেন, জিকর বলতে জুমার খুতবা বুঝানো হয়েছে, কেউ বলেছেন সালাত ও খুতবা উভয়কেই বুঝানো হয়েছে। আল্লামা কুরতুবি বলেন : ‘জিকর’ অর্থ সালাত। সাঈদ ইবন যুবাইর বলেন, ‘জিকর’ অর্থ খুতবা ও ওয়াজ। জুমার নামাজের জন্য ডাকা হলে দুনিয়াবি সব প্রকার ঝাই-ঝামেলা, কাজ-কর্ম ও ব্যস্ততা বাদ দিয়ে আগে আগে মসজিদে যাওয়ার বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে।
আমরা কি কখনো গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি কেন অন্যান্য ওয়াক্তিয়া নামাজের চেয়ে জুমার নামাজ ব্যতিক্রম? কেন এ নামাজের গুরুত্ব অনেক বেশি? এ নামাজের রয়েছে অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। তা হলো খুতবা। আল্লাহর প্রশংসা, তাঁর গুণ বর্ণনা, রাসূলুল্লাহ সা:-এর ওপর সালাত, মুসলিমদের জন্য দোয়া ও তাদের নসিহত ও স্মরণ করানোর নামই হলো খুতবা। খুতবায় ইমাম উপস্থিত মুসল্লিদের উপদেশ দিয়ে থাকেন, নসিহত করে থাকেন, সমাজ সংশোধনের কথা বলে থাকেন। আজকের জুমা থেকে আগামী জুমা পর্যন্ত মধ্যকার সময়ে কী করণীয় আছে এসব বিষয়ে ইমাম দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। লক্ষণীয় যে, আমাদের অনেক ইমাম বাংলায় যা বলে থাকেন তার সাথে আরবি খুতবার তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ এমনটা সমীচীন নয়। বরং বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে, আরবি-বাংলার সংমিশ্রণে অর্থবহ ও রাসূল সা:-এর সুন্নাহ মোতাবেক খুতবা প্রদানই শ্রেয়। খুতবা যাতে দুর্বোধ্য না হয়; খুতবা যেন সামাজিক ও ধর্মীয় কল্যাণে হয়ে থাকে সে দিকে দৃষ্টি রাখা উচিত। ইমামের খুতবা যেন সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী বা জনপদের মানুষের চলার পথকে সুগম ও সুশৃঙ্খল করে তোলে সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।
যেমন রাসূল সা:-এর খুতবাদানের ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ সা: যখন খুতবা দিতেন তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে যেত, তাঁর কণ্ঠস্বর উঁচু হতো এবং তাঁর ক্রোধ কঠিন হতো। এমনকি মনে হতো তিনি যেন আসন্ন শত্রুসেনার আক্রমণের সতর্ককারী। (মুসলিম, আস-সহিহ ২/৫৯২) এ হাদিস থেকে বুঝা যায়, ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ এবং দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর খুতবাই হচ্ছে রাসূল সা:-এর খুতবার বৈশিষ্ট্য। তাই খুতবা হওয়া উচিত সামাজিক পরিস্থিতি, সমসাময়িক ঘটনা, সামাজিক ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য এবং ধর্মীয় অনুশাসনে ভরপুর। সে জন্য রাসূল সা: প্রদত্ত খুতবা, সাহাবি, তাবেয়ি, তাবে-তাবেয়িদের খুতবা আমাদের জন্য উত্তম খুতবার নমুনা। জুমার দিনের খুতবা যেন সমাজ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে তাহলে জাতি, সমাজ উপকৃত হবে আর সে দিকে লক্ষ রেখেই খুতবা দেয়া জরুরি।
গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে যুগ-জিজ্ঞাসার আলোকে খুতবা উপস্থাপন সময়ের দাবি। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি ২৫০৩৯৯টি জামে মসজিদ আছে (১৯ ফেব্রুয়ারি-২০১৮, জাতীয় সংসদে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের দেয়া তথ্য)। প্রত্যেক মসজিদে গড়ে ২০০ করে মুসল্লি হলে মোট মুসল্লির সংখ্যা ৫০০৭৯৮০০ জন। পাঁচ কোটির বেশি মুসলিম সারা বাংলাদেশে একযোগে জুমার নামাজ আদায় করে থাকে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু সব ভেদাভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ রেখে একই ইমামের পিছনে আনুগত্য প্রকাশ করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নামাজ আদায় এ যেন মুসলিম সংস্কৃতির এক মহামিলন কেন্দ্র। তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ সব শ্রেণিপেশার লোক সমবেত হয়ে ইসলামী ভাবধারায় উজ্জীবিত হয়ে মসজিদকে পরিপূর্ণ করে তোলে। আমজনতার মাঝে ইসলামের কথাগুলো তুলে ধরার জন্য এটি একটি সহজ, সাবলীল ও সামষ্টিক মাধ্যম। ইসলামী দাওয়াহ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে জুমার খুতবাকে হিকমতপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
এক সপ্তাহের বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষকে এমনভাবে নার্সিং করা যাতে পরবর্তী জুমা আসা পর্যন্ত মানুষ আগের জুমার আলোচনা বাস্তব জীবনে মেনে চলে। এ ক্ষেত্রে আলোচনা নির্ধারণের বিষয়ে ইমামদের বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। আলোচনায় যেন সমসাময়িক ঘটনাবলি স্থান পায়; ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা ও সম্ভাবনাসমূহ যেন উঠে আসে। মানুষ যেন জুমার খুতবা থেকে পরিবর্তন ও আত্মশুদ্ধির পথ খুঁজে পায়। নৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে জুমার খুতবা যেন পরিবর্তন বয়ে আনতে সক্ষম হয়।
একটি ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইতিবাচক ফলাফল ও নৈতিকগুণে সমৃদ্ধ পরিবেশ তৈরি করা ইমামের দায়িত্ব। কেননা হাদিসে এসেছে রাসূল সা: যখন খুতবা দিতেন তখন তিনি বলতেন, ‘আমি তোমাদের জাহান্নাম থেকে সতর্ক করছি! আমি তোমাদের জাহান্নাম থেকে সতর্ক করছি! আমি তোমাদের জাহান্নাম থেকে সতর্ক করছি!’ (আহমদ, আল-মুসনাদ) কাজেই ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে জুমার খুতবার যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। সমাজ জীবনে খুতবার ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারের জন্য যুগোপযোগী ও সৃজনশীল খুতবার কোনো বিকল্প নেই। লেখক : এমফিল গবেষক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com