বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০২:৫০ পূর্বাহ্ন

অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ঈমানি দায়িত্ব

মুফতি ইমামুদ্দীন সুলতান:
  • আপডেট সময় সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২

আমাদের চার পাশে দৈনন্দিন কত অন্যায়-অপরাধ সংঘটিত হয়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সর্বত্রই নানা অপরাধের সাক্ষী আমরা। অনেকেই এসব অপরাধের কেবল নীরব দর্শক হয়। তা নির্মূলে কোনো ভূমিকা রাখে না বা রাখার চেষ্টা করে না। ইসলাম এমন নীরব ভূমিকা সমর্থন করে না; বরং নিজ সাধ্য ও সামর্থ্যরে আলোকে এসব অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করা ও তা নির্মূলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা ঈমানের অপরিহার্য দাবি। একজন মুসলিমের এটি ঈমানি দায়িত্ব। এমনকি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় মুসলিম সম্প্রদায় শ্রেষ্ঠতম হওয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে’ (সূরা আলে ইমরান-১১০)।
হাদিস শরিফে রাসূল সা: সাধ্যানুযায়ী অন্যায়ের প্রতিবাদ করার আদেশ করেছেন এবং প্রতিবাদের ধরন অনুযায়ী ঈমানের স্তর ঘোষণা করেছেন। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, আবু সাঈদ রা: বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছি, তোমাদের কেউ যদি অন্যায় কাজ দেখে, তাহলে সে যেন হাত দিয়ে এর সংশোধন করে দেয়। যদি এর ক্ষমতা না থাকে, তাহলে মুখ দিয়ে, যদি তাও সম্ভব না হয় তাহলে অন্তর দিয়ে (ওই কাজকে ঘৃণা করবে আর নির্মূলের ফিকির ও দোয়া করবে), আর এটিই ঈমানের নি¤œতম স্তর। (মুসলিম-৮৩)।
অনেকে মনে করে, আমি যেহেতু অপরাধ করছি না, আমার সমস্যা নেই, আমি তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, এই ভেবে সে অন্যায়-অপরাধ দেখেও পাশ কাটিয়ে যায়, নিজের লাভ-ক্ষতির দিক বিবেচনা করে কিছু বলে না। এমন স্বার্থান্বেষী চিন্তা প্রকৃত অর্থে নিজের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কেননা, কোনো সমাজে অপরাধীকে বাধা না দিলে বা প্রতিবাদ করা না হলে আল্লাহর আজাব সবাইকে গ্রাস করে নেয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে নীরব ভূমিকা পালনকারীও আল্লাহর সেই আজাব থেকে রেহাই পায় না। পক্ষান্তরে অপরাধ নির্মূল না হলেও শুধু সাধ্যমতো প্রতিবাদ জানানো মানুষগুলো আল্লাহর আজাব থেকে বেঁচে যায়। বনি ইসরাইলের এক কওমকে আল্লাহ তায়ালা নির্দিষ্ট দিনে নদী থেকে মাছ ধরতে নিষেধাজ্ঞা দেন। তাদের সমাজে একদল তখন এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মাছ ধরে। পক্ষান্তরে সমাজের বাকি মানুষগুলো থেকে কতক তাদের এ অন্যায় থেকে বাধা দিয়েছেন আর কেউ নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। পরিশেষে আল্লাহ তায়ালা অপরাধী ও নীরব ভূমিকা পালনকারীদের আজাব দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘটনাটির ব্যাপারে ইরশাদ করেন- ‘অতঃপর যখন তারা সে সব বিষয় ভুলে গেল, যা তাদেরকে বোঝানো হয়েছিল, তখন আমি সেসব লোককে মুক্তি দান করলাম যারা মন্দ কাজ থেকে বারণ করত। আর পাকড়াও করলাম, গোনাহগারদের নিকৃষ্ট আজাবের মাধ্যমে তাদের নাফরমানির কারণে (সূরা আরাফ-৬৫)।
তাই সামগ্রিক আজাব থেকে বাঁচতে হলে শুধু নিজে অন্যায়-অপরাধ থেকে বেঁচে থাকা যথেষ্ট নয়; বরং এর পাশাপাশি সাধ্য মতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সামগ্রিক আজাব থেকে সতর্ক করে ইরশাদ করেন- ‘আর তোমরা এমন ফ্যাসাদ থেকে বেঁচে থাকো যা বিশেষত শুধু তাদের ওপর পতিত হবে না যারা তোমাদের মধ্যে জালেম এবং জেনে রেখো যে, আল্লাহর আজাব অত্যন্ত কঠোর’ (সূরা আনফাল-২৫)। এ আয়াতে স্পষ্ট বোঝা যায়, একজন মুসলিমের দায়িত্ব কেবল নিজেকে শরিয়তের অনুসারী বানানোই শেষ হয়ে যায় না। সমাজে যদি কোনো মন্দ কাজের বিস্তার ঘটতে দেখে, তবে সাধ্যমতো তা রোধ করাও তার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে যদি অবহেলা করে ও সেই মন্দ কাজের দরুন কোনো বিপর্যয় দেখা দেয়, তবে মন্দ কাজে যারা সরাসরি জড়িত ছিল কেবল তারাই সেই বিপর্যয়ের শিকার হবে না; বরং যারা নিজেরা সরাসরি মন্দ কাজ করেনি, কিন্তু অন্যদের তা করতে বাধাও দেয়নি, তাদেরও বিপর্যয়ের শিকার হতে হবে। হাদিস শরিফে বিষয়টিকে খুব সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝানো হয়েছে। নুমান ইবনে বাশির রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘যে মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং যে সীমা লঙ্ঘন করে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই যাত্রীদলের মতো, যারা কুরআনের মাধ্যমে এক নৌযানে নিজেদের স্থান নির্ধারণ করে নিলো। তাদের কেউ স্থান পেলো উপর তলায় আর কেউ নিচ তলায় (পানির ব্যবস্থা ছিল উপর তলায়) কাজেই নিচের তলার লোকেরা পানি সংগ্রহকালে উপর তলার লোকদের ডিঙিয়ে যেত। তখন নিচ তলার লোকেরা বলল, উপর তলার লোকেদের কষ্ট না দিয়ে আমরা যদি নিজেদের অংশে একটি ছিদ্র করে নিই (তবে ভালো হয়) এমতাবস্থায় তারা যদি এদেরকে আপন মর্জির ওপর ছেড়ে দেয় তাহলে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তারা এদের হাত ধরে রাখে (বিরত রাখে) তবে তারা এবং সবাই রক্ষা পাবে (বুখারি-২৪৯৩)।
অতএব, আল্লাহর আজাব ও সমাজে ঘটমান অন্যায়-অপরাধের দরুন আসা বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের সবাইকে সাধ্যমতো সমাজের সর্বস্তরের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে যেকোনো অপরাধ নির্মূলে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ইমদাদিয়া আরাবিয়া, শেখেরচর, নরসিংদী




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com