বালি খেকোদের আগ্রাসনে ক্ষত-বিক্ষত চকরিয়া উপজেলার হারবাং ছড়াখালের বুক। হারবাং ছড়াখালটিতে অন্তত ১০টি পয়েন্ট থেকে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে প্রতিদিন তোলা হচ্ছে কমপক্ষে ২০০ ট্রাক বালি। তাতে চকরিয়া উপজেলার হারবাংয়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকায় ছড়াখালের দুই পাড় ভেঙে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছে। নদীতে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি। ভাঙনের কারণে উজান থেকে বালি নেমে ভরাট হচ্ছে ভাটি অঞ্চল। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বালু খেকোদের বিরামহীন ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে বলে জানা গেছে। বালি উত্তোলনের বিষয়টি চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেপি দেওয়ান এর নজরে আনলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আরো কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে অবগত করেছে। বালু উত্তোলনের স্থানগুলোতে গত কয়েকদিন আগেও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। তবে হারবাং ছড়াখালের কিছু অংশে ইজারা দেওয়া হয়েছে। এবিষয়ে সরেজমিন গিয়ে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসময় প্রতিবেদক, ছড়াখাল থেকে বেলচা দিয়ে বালি উত্তোলনের জন্য ইজারা দেয়া হলেও শ্যালোমেশিন বসিয়ে নদীর পাড় বা ফসলি জমিতে পানি মারার পর পাড় ভেঙে শরবত বানিয়ে সেখান থেকে বালি উত্তোলনের কোন এখতিয়ার আছে কী এমন প্রশ্নে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, ফসলি জমি বা ছড়াখালের পাড় ভাঙার কোন এখতিয়ার নেই। যদি তারা এমন কিছু করে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে, স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রতিদিন হারবাং ছড়াখাল থেকে অবৈধভাবে শতশত ট্রাক বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। সারাবছরই হারবাং ছড়াখালের পাড়ে এ ধ্বংসযজ্ঞ চলে আসলেও প্রতিকারে এগিয়ে আসছে না কেউই। ফলে পাড় ভেঙে বর্ষা মৌসুমে ছড়াখালে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি। ভারী ট্রাক চলাচলের কারণে অনেকটা বিধ্বস্ত গ্রামীণ সড়কসমূহ। বালি উত্তোলনের উন্মুক্তের সুযোগ নিয়ে উন্মত্ততায় মেঠে ওঠেছে শতাধিক বালি খেকো। সংঘবদ্ধ বালি খেকোরা প্রতিদিন প্রায় ২০০ ট্রাক বালি বিক্রি করছে। এ বালি চকরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও যাচ্ছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা ও শহরে। আর এসব বালু খেকোদের নেতৃত্বে রয়েছে হারবাং ইউনিয়নের মোঃ শওকত নামের এক আওয়ামি লীগ নেতা। এবিষয়ে প্রতিবেদক তার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি এ ছড়াখালটি জেলা প্রশাসক থেকে ইজারা নিয়ে বালি উত্তোলন করছে বলে জানান। সেই সাথে তিনি বলেন, হারবাং ছড়াখাল থেকে কেউ বালি উত্তোলন করলে তাকে ম্যানেজ করেই বালি উত্তোলন করতে হয়। যার জন্য তাকে দিতে মোটা অংকের টাকা। সাংবাদিকরা সরেজমিন গেলে, নিজেদের বালি উত্তোলনকারী পরিচয় দিয়ে হারবাং চরপাড়া এলাকার আবু বক্করের ছেলে মোহাম্মদ খোরশেদ, ইদ্রিসের ছেলে রিদুয়ান, নুর আলমের ছেলে সাজ্জাদ বলেন, চকরিয়া উপজেলার হারবাং ছড়াখালের দুই পাড়ে ৪ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ১০টি পয়েন্টে শ্যালো মেশিন রয়েছে। এসব শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় দুইশ’ ট্রাক বালি উত্তোলন করা হয়। এসব বালি ৬০০ ফুট ধারণ ক্ষমতার প্রতি ট্রাক ৬ হাজার টাকা এবং ৪০০ ফুট ধারণ ক্ষমতার প্রতি ট্রাক ৪ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। জায়গার দূরত্ব অনুযায়ী ট্রাক ভাড়া আলাদাভাবে নেওয়া হয়। এছাড়াও মসজিদ মুরা এলাকার বাসিন্দা আকতার আহমেদের ছেলে মোঃ ছোটন, আব্দুল মজিদ মনু নামের ২জন বালু উত্তোলনকারী বলেন, হারবাং ছড়াখাল থেকে নির্দিষ্ট কোন মাসে নয়, সারাবছরই বালি উত্তোলন করা হয়। তুলনামূলক মান ভাল হওয়ায় হারবাং ছড়াখালের বালির চাহিদাও রয়েছে অনেক বেশি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, হারবাং ছড়াখালের প্রতিটি পয়েন্ট থেকে দৈনিক ১৫ থেকে ২০ ট্রাক বালি উত্তোলন করা হয়। অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কারণে নদীর দুই পাড় ভেঙে ছড়াখালে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এতে গভীরতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি নদীর বিভিন্ন অংশে ভরাট হয়ে পড়ছে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ ট্রাক বালি বিক্রির কারণে স্থানীয় সড়কগুলোর অবস্থাও ভঙ্গুরদশা, যানবাহন চলতে পারে না। এ বিষয়ে স্থানীয় পরিবেশবাদীরা বলেন, ‘হারবাং ছড়াখাল থেকে ব্যাপকভাবে বালি উত্তোলনের কারণে নদীর আকার ও ভৌত গঠন ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে ছড়াখালের পানির ঘোলাটেভাব। পাহাড়ের মাটি ধসে ভরাট হচ্ছে ছড়াখালটি। একই সাথে ছড়াখালের দুই পাড়ের জমি ভেঙে যাচ্ছে। সেই সাথে কমছে গভীরতাও। অপরদিকে মাছের প্রজনন ক্ষেত্রের কুম ভরাট এবং ছড়াখালের পানির ঘোলাটেভাব বেড়ে যাওয়ায় দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তাতে মাছের প্রজনন আবাসস্থলের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে হারবাং এলাকার সচেতনমহল বলেন, হারবাং ছড়াখালে কোনভাবে সরকারিভাবে বালি মহাল ইজারা দেওয়া যাবে না। তবে শ্রমিকদের মাধ্যমে ম্যানুয়ালি বালি তুলে পরিবহন করলে বালির চাহিদা যেমন পূরণ হবে, তেমনি ছড়াখালটির ইকোসিস্টেমের তেমন ক্ষতি হবে না। কিন্তু, তা না মানার কারণে মরে যাচ্ছে হারবাংয়ের ছড়াখালটি। অবাধে বালি উত্তোলনের কারণে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে এ ছড়াখালটির। সরেজমিন পরিদর্শনের পর প্রতিবেদক বালি উত্তোলনের বিষয়ে হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেরাজ উদ্দিন মিরাজের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবৈধ বালি উত্তোলনের কারণে হারবাং ছড়াখালটি নাব্যতা সংকটে রয়েছে। এমনকি বালুখেকোরা ছড়াখালের পাশাপাশি শ্যালোমেশিন বসিয়ে ছড়াখালের পাড় ও ফসলি জমি কেটে উত্তোলন করছে। যার কারণে যেমন কমছে ফসলি জমির পরিমাণ তেমনি ভাঙনের কবলে পড়েছে গ্রামীণ জনপদ। তবে গত কয়েকদিন আগে বালুখেকোদের বিরুদ্ধে হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু বালি উত্তোলনের সরঞ্জাম ধ্বংস করা হয়েছে এবং তাদেরকে শ্যালোমেশিন বসিয়ে বালি উত্তোলন বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। এরপরও তারা বালি উত্তোলন করে যাচ্ছে। বালুখেকোদের নেতৃত্বে রয়েছে এক স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামি লীগ নেতা। তারা কাউকে পরোয়া না করেই হারবাং ছড়াখালের উপর এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে।