বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১০ অপরাহ্ন

করোনার থাবা বীমার ৭ লাখ কর্মীর ওপর

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

প্রায় দুই যুগ ধরে মেটলাইফে কমিশনের ভিত্তিতে কাজ করছেন বিউটি আক্তার (ছদ্মনাম)। সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন পথ পাড়ি দিয়ে এখন তিনি একটি ব্রাঞ্চের ইউনিট ম্যানেজার। পদবি পরিবর্তন হলেও এখনো গ্রাহকের কাছে পলিসি বিক্রি করে যে কমিশন পান সেটাই তার আয়ের উৎস। কমিশন ভিত্তিতে বীমা কোম্পানিতে চাকরি করলেও প্রতি মাসেই মোটা অংকের আয় হতো বিউটির। কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাস তার আয়ের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনার থাবায় তার মাসিক আয় অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে।
এ বিষয়ে বিউটি আক্তার বলেন, ‘১৯৯৯ সাল থেকে মেটলাইফে কাজ করছি। পলিসি বিক্রির ক্ষেত্রে আগে কখনো এমন বাধার মুখে পড়িনি। করোনার কারণে মানুষের সঙ্গে আগের মতো অবাধ যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে অনেকে বেকার হয়ে গেছেন। অনেকের আয় কমে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের পলিসি বিক্রি কমে গেছে। আর পলিসি বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে কমিশনও কমে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘করোনার আগে প্রতি মাসে যে আয় হতো তাতে বেশ ভালোভাবেই জীবনধারণ করতে পারতাম। কিন্তু এখন আয় কমে অর্ধেকের নিচে চলে আসায় স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। আগের জমানো অর্থ ভাঙতে হচ্ছে। তবে আশার কথা, চলতি মাসে পলিসি বিক্রি একটু বেড়েছে।’ শুধু বিউটি আক্তার নয়, মহামারি করোনাভাইরাসের থাবা পড়েছে সাত লাখের বেশি বীমা কর্মীর ওপর। বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) ২০১৮ সালের হিসাব অনুসারে, দেশের ৩২টি জীবন বীমা কোম্পানিতে এজেন্ট ছিল চার লাখ ২৬ হাজার ৬৫১ জন। আর এমপ্লয়ার অব এজেন্ট ছিল দুই লাখ ৭ হাজার ১৭৮ জন।
অবশ্য বিভিন্ন কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এজেন্ট এবং এমপ্লয়ার অব এজেন্ট দুই বিভাগেই কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোতে এজেন্ট এবং এমপ্লয়ার অব এজেন্টের সংখ্যা সাত লাখের ওপরে হবে বলে দাবি তাদের। এদের সবাই কমিশন ভিত্তিতে কাজ করেন। অর্থাৎ বীমা পলিসি বিক্রি করতে পারলে আয় আছে। আর পলিসি বিক্রি করতে না পারলে আয় বন্ধ। আইন অনুযায়ী, বীমা পলিসি বিক্রির নির্ধারিত কমিশনের বাইরে তাদের কোনো বেতন-ভাতা নেই। বীমা কোম্পানিতে বীমা প্রতিনিধি বা বীমা এজেন্ট যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন তাদের কোনো বেতন দেয়া হয় না, শুধু কমিশনের ওপর ভিত্তি করে তাদের জীবন চলে। ২০০৮ সাল থেকে একটি জীবন বীমা কোম্পানিতে এজেন্ট হিসেবে কাজ করা আমিরুল ইসলাম নামের একজন বলেন, ‘ছাত্রজীবনে পার্টটাইম কাজের অংশ হিসেবে কোম্পানিতে যোগ দিই। প্রথমদিকে খুব একটা পলিসি বিক্রি করতে পারতাম না। তবে বছর ঘুরতেই পরিস্থিতি বদলে যায়। বীমা পলিসি বিক্রি করে প্রতিমাসেই বেশ ভালো আয় হতো। যে কারণে আর পেশা বদলায়নি।’
তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে বিয়ে করেছি। তারপর থেকেই ঢাকায় পরিবার নিয়ে থাকি। ভালোভাবে সংসার চালিয়ে গ্রামের বাড়িতে কিছু জমি কিনেছি। বেশ হাসি-খুশিতে আমাদের জীবন চলছিল। কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাস সব ওলট-পালট করে দিয়েছে। মে মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত একটি পলিসিও বিক্রি করতে পারিনি। গত মাসে মাত্র দুটি পলিসি বিক্রি হয়েছে। পলিসি বিক্রি না থাকায় আয় নেই বললেই চলে। আগের জমানো টাকাও শেষ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে গ্রামের বাড়িতে পরিবার পাঠিয়ে দিয়েছি।’ বীমাকর্মী আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষ এখন আগের থেকে বেশি বাইরে বের হচ্ছে। কিন্তু তারপরও আগে আমরা যেভাবে আফিসে বা বাসায় গিয়ে মানুষের কাছে বীমা পলিসি বিক্রির প্রস্তাব দিতে পারতাম, এখন সেই পরিস্থিতি নেই। অপরিচিত মানুষের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বলতে বেশিরভাগ মানুষ এখনো ইতস্তত বোধ করে। এমনকি পরিচিত মানুষরাও এখন আগের মতো সময় দেয় না।’ এদিকে বীমাকর্মীদের প্রণোদনা দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দু’দফায় আবেদন জানিয়েছে বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বি আইএ)। এর মধ্যে গত ৩১ আগস্ট সংগঠনটির সভাপতি শেখ কবির হোসেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউসের কাছে এ-সংক্রান্ত একটি আবেদন পাঠান। এর আগে ২২ মে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়ে আবেদন জানায় বি আইএ। বি আইএর আবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বীমা ব্যবসা মূলত এজেন্ট নির্ভর। এজেন্টরা কমিশন ভিত্তিতে ব্যবসা সংগ্রহ করে এবং তার বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে জীবন নির্বাহ করে থাকে। দেশের প্রায় সাত লাখ এজেন্ট ও এমপ্লায়ার অব এজেন্ট রয়েছে। মহামারি করোনার কারণে বিগত তিন মাস এজেন্টরা কর্মহীন হয়ে পড়ায় তাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে তারা অনাহারে অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
বৈশ্বিক এই দুর্যোগের সময় এজেন্টদের মানবেতর জীবনযাপন থেকে রক্ষা করা, সর্বোপরি বীমা শিল্পে দক্ষ জনবলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সরকারের যেকোনো খাত থেকে বীমা কোম্পানিগুলোতে কর্মরত এজেন্টদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করার অনুরোধ করা হয়েছে বি আইএর আবেদনে। এতে বলা হয়েছে, বিআিইএর পক্ষ থেকে কোম্পানিগুলোকে তাদের এজেন্টদের বেতন-ভাতাদি পরিশোধের অনুরোধ করা হয়েছে। কয়েকটি কোম্পানি ব্যতীত প্রায় ৭০ শতাংশ কোম্পানির আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক এবং কয়েকটি কোম্পানি অস্তিত্ব সংকটে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে নতুন ও দুর্বল কোম্পানিগুলোকে এ আর্থিক সহযোগিতার বিষয়ে অগ্রাধিকার প্রদান করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে জেনিথ লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান বলেন, ‘করোনার কারণে আমাদের এজেন্টরা আগের মতো মানুষের কাছে যেতে পারছেন না এবং বীমা পলিসি বিক্রি করতে পারছেন না। আর বীমা পলিসি বিক্রি না হওয়ার কারণে তাদের আয়ও নেই। ফলে বীমা কোম্পানির এজেন্টদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘কিছু পুরাতন কোম্পানি অনৈতিক কৌশল নিয়ে বীমা পলিসি বিক্রি করছে। যেমন- বীমা পলিসির মেয়াদ শেষে দাবির টাকা দেয়ার আগে গ্রাহকের অজান্তে নতুন একটি পলিসি চালু করে দিচ্ছে। এটা অনৈতিক। এর মাধ্যমে তাদের প্রথম বর্ষের প্রিমিয়াম আয় কিছুটা বাড়ছে।’
পপুলার লাইফের একজন ডিএমডি বলেন, ‘করোনার কারণে মে-জুন মাসে পলিসি বিক্রির ক্ষেত্রে বেশ সমস্যা হচ্ছিল। তবে এখন পরিস্থিতি আগের থেকে ভালো। আমাদের সিইও নিজেই মাঠে গিয়ে কর্মীদের খোঁজখবর নেন। ফলে কর্মীরা কাজ করতে উৎসাহিত হন। করোনার কারণে প্রিমিয়াম আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও আমরা আশা করছি, বছর শেষে মোটামুটি ভালো প্রিমিয়াম সংগ্রহ করতে পারব।’




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com