সমাজের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণকে ইসলাম গুরুত্ব দিয়ে থাকে। একটি সুখী-সমৃদ্ধ কল্যাণমুখী সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। তাই মানুষকে সমাজবোধ এবং সমাজের জন্য ত্যাগী হতে উজ্জীবিত হয়ে মানবকল্যাণ ও সৎকর্মে উদ্যোগী হওয়ার জন্য বারবার উৎসাহী করেছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে- সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করা, প্রত্যেকের প্রাপ্য অধিকার ভোগ নিশ্চিত করা, অনধিকার চর্চা থেকে বিরত রাখা এবং কর্তব্য পালনে ও দায় বহনে বাধ্য করা। অপর দিকে ইসলাম হচ্ছে এমন একটি জীবনব্যবস্থার নাম যেখানে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আর এ দু’য়ের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জীবনকে কল্যাণময় করা। ইসলাম এক দিকে স্র্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক সমুন্নত করে, অন্য দিকে সৃষ্টির সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক অটুট অব্যাহত রাখে। এসব কারণে ইসলামে সামাজিক ন্যায়বিচার একটি ব্যাপক ও বিস্তৃত বিষয়। পবিত্র কুরআনের নি¤েœাক্ত আয়াতদ্বয় থেকে ইসলামী জীবনদর্শন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমাজের কল্যাণভাবনা পরিস্ফুটিত হয়। ইরশাদ হচ্ছে- ‘তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল। তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য। তোমরা নেকির হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো। এই আহলি কিতাবরা ঈমান আনলে তাদের জন্যই ভালো হতো। যদিও তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ঈমানদার পাওয়া যায়, কিন্তু তাদের বেশির ভাগই নাফরমান।’ (আল কুরআন, সূরা আলে ইমরান-১১০) ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মধ্যে তারাই উত্তম যারা মানবকল্যাণে বেশি উপকারী। এভাবে ইসলাম আত্মকেন্দ্রিকতা বা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের ঊর্র্ধ্বে উঠে মানুষের মধ্যে সমাজবোধ জাগ্রত করার ও সমাজের জন্য ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছে। এটিও সামাজিক ন্যায়বিচার ধারণার সামগ্রিক রূপ। আর ইসলামে এটিকে আরো ব্যাপক পরিসরে ব্যাখ্যা করা হয়। এর মধ্যে তাওহিদ, সৃষ্টিজগৎ ও মানুষের সার্বিক জীবনসম্পৃক্ত। কারণ ইসলাম একটি অবিভাজ্য পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন। এর প্রত্যেকটি শাখা-প্রশাখা একটির সাথে অপরটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্রষ্টা, সৃষ্টিজগৎ, মানুষ, ব্যক্তি, সমষ্টি, রাষ্ট্র- সবকিছুই সামাজিক ন্যায়বিচারের অন্তর্ভুুক্ত। সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়ে আল কুরআনে বহু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। আল কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘আল্লাহ ন্যায়নীতি, পরোপকার ও আত্মীয়-স্বজনদের দান করার হুকুম দেন এবং অশ্লীল-নির্লজ্জতা ও দুষ্কৃতি এবং অত্যাচার-বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষালাভ করতে পারো।’ (আল কুরআন, সূরা নাহল-৯০)
আরো ইরশাদ হচ্ছে- ‘আল্লাহ তোমাদেরকে যাবতীয় আমানত তার হকদারদের হাতে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। আর লোকদের মধ্যে ফায়সালা করার সময় আদল ও ন্যায়নীতি সহকারে ফায়সালা করো। আল্লাহ তোমাদের বড়ই উৎকৃষ্ট উপদেশ দান করেন। আর অবশ্যই আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও দেখেন।’ (আল কুরআন, সূরা নিসা-৫৮)
অন্যত্র বলা হয়েছে- ‘হে ঈমানদাররা! ইনসাফের পতাকাবাহী ও আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যাও, তোমাদের ইনসাফ ও সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের ব্যক্তিসত্তার অথবা তোমাদের বাপ-মা ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে গেলেও। উভয়পক্ষ ধনী বা অভাবী যা-ই হোক না কেন, আল্লাহ তাদের চাইতে অনেক বেশি কল্যাণকামী। কাজেই নিজেদের কামনার বশবর্তী হয়ে ইনসাফ থেকে বিরত থেকো না। আর যদি তোমরা পেঁচালো কথা বলো অথবা সত্যকে পাশ কাটিয়ে চলো, তাহলে জেনে রাখো, তোমরা যা কিছু করছ আল্লাহ তার খবর রাখেন।’ (আল কুরআন, সূরা নিসা-১৩৫)
আল কুরআনের সূরা আর রাহমানের ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘ইনসাফের সাথে সঠিকভাবে ওজন করো এবং ওজনে কম দিও না’। এখানে ওজন বলতে সামগ্রিকভাবে ইনসাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার কথায় বলা হয়েছে।
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রসঙ্গে নবী করিম সা:-এর অসংখ্য হাদিস রয়েছে। এসব হাদিসে তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে দায়িত্বশীল আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে সহিহ বুখারি থেকে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: হতে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা জেনে রাখো তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল। তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব, যিনি সমাজের নেতা, তিনি তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল, সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির ওপর দায়িত্বশীল, সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কোনো ব্যক্তির দাস তার মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল, সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব, জেনে রাখো- তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, তোমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সহিহ বুখারি-৬৬৫৩)
ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে মহানবী সা: নিজেই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত আরবসমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ঘটনাটি হচ্ছে- বনি মাখযুম গোত্রের একজন সম্মানিত মহিলা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। ইসলামী আইন অনুযায়ী চুরির শাস্তি হাত কাটা। এই শাস্তিটি যেমন কষ্টদায়ক, তেমনি অভিশপ্তও। এ কারণে ওই গোত্রের লোকেরা এ ব্যাপারে রাসূল সা:-এর কাছে সুপারিশ করার জন্য উসামা ইবন জায়েদ রা:-কে পাঠান। উসামা ইবন জায়েদ রা: রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে এসে এ ঘটনা বলার পর রাসূল সা: একটি গুরুত্বপূর্ণ খুতবা পেশ করেন। খুতবায় তিনি মহান রাব্বুল আলামিনের প্রশংসা ও প্রশস্তি বর্ণনার পর বলেন, ‘হে মানুষ, অতীতে মানুষকে শুধু এ জন্য ধ্বংস করা হয়েছে যে, তাদের মধ্যকার অভিজাত লোকেরা যখন কোনো অপরাধ করত তখন তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হতো, আর যখন সাধারণ লোকেরা অপরাধ করত, তখন তাদেরকে শাস্তি দেয়া হতো। কসম সেই সত্তার যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করত তাহলে তার হাত আমি কেটে দিতাম।’ (ইবনে মাজাহ) মহানবী সা:-এর পর তাঁর খলিফারা বরাবরই তাঁর নীতি অনুসরণ করেছেন। দ্বিতীয় উমর বলে খ্যাত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রা:-এর জনৈক গভর্নর শহরের বেষ্টনী প্রাচীর তৈরির জন্য তার অনুমতি প্রার্থনা করেন তখন উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রা: তার কাছে লিখেন, এটি করার দরকার নেই, বরং শহরটিকে ন্যায়বিচার দিয়ে মজবুত ও সুদৃঢ় এবং এর রাস্তাগুলোকে জুলুম-অত্যাচার থেকে মুক্ত করো। আব্দুল্লাহ ইবনে জাহির একদা তার আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের এই রাজত্ব আর কতদিন বাকি থাকবে? তিনি উত্তর দিলেন, যতদিন এর বিচারালয় ন্যায়বিচার দিয়ে ঢাকা থাকবে, ততদিন এই রাজত্ব বিদ্যমান থাকবে। এখানেই প্রতিফলিত হয়েছে ইসলামের সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।