ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের ওয়েবিনার
সংবিধানের প দশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। তত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অশান্তি সৃষ্টিকারী রায়। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় প্রদানকারী প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে পরপর তিন দফায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দিয়ে সে রায়ের জন্য মূলত পুরস্কৃত করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে অপরাজনীতি হয়েছে। আইনকে অস্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। এমতাবস্থায় বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে (বিজয়ীর নিকট) ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রয়োজন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বর্তমান সংকট যতোটা না সাংবিধানিক, তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক৷
গতকাল শনিবার (২৮ জানুয়ারি) ‘ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ’ আয়োজিত “সংবিধান সংশোধনের (অপ)রাজনীতি” শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। আলোচক হিসেবে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক৷ এছাড়াও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র আইন কর্মকর্তা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. রিদওয়ানুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শহীদুজ্জামান, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ব্যারিস্টার আদিবা আজিজ খান।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত নেওয়া হয় নি, যা অসাংবিধানিক।” সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে অপরাজনীতি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আইনকে অস্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ বলে পরবর্তী দুই মেয়াদের জন্য সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে- এমন কথাকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেন ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অশান্তি সৃষ্টিকারী রায়। সেইসাথে এটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর রায়ও বটে। তিন মাসের জন্য বৃহত্তর স্বার্থে নির্বাচনকালে কিছু অনির্বাচিত ব্যক্তি থাকলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না।”
অধ্যাপক ড. রিদওয়ানুল হক বলেন, “যারা তত্বাবধায়ক সরকার তুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন সেইসব বিচারপতিদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। আর যারা ‘তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক ‘ বলেছেন, তাদের প্রধান বিচারপতি হওয়া থেকে বি ত করা হয়েছে। অন্যদিকে, আদালত অতি উৎসাহী হয়ে রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে মন্তব্য করে অধ্যাপক শহীদুজ্জামান বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সবাই একমত। কিন্তু, বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এই সরকার কিংবা সংসদের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।” ব্যারিস্টার আদিবা আজিজ খান বলেন, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে এবং বিপক্ষে কথা বলেছে। দর্শকদের মধ্য থেকে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “বর্তমান অবস্থা বহাল থাকলে গাড্ডা ছাড়া দেশের পরিস্থিতি কিছু আমরা দেখছি না। কিভাবে সাংবিধানিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থায় জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি করা যায় সেজন্য বাংলাদেশের সকল নাগরিকেরই এখন চিন্তার দিক থেকে এগিয়ে আসাটা কর্তব্য।”
বর্তমান সংকট যতোটা না সাংবিধানিক, তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক এমন মন্তব্য করে ওয়েবিনারে উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, “বর্তমান বাস্তবতায় দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঠিক করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেরামত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে, শুরুতেই সকলের অংশগ্রহণের জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। আর সেক্ষেত্রে একটি অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন সবকিছু না হলেও এটাই হলো প্রথম পদক্ষেপ।”