দেশে দিন দিন কমছে গমের আবাদ। সে জায়গা দখল করে নিচ্ছে ভুট্টা। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির উৎপাদন বাড়ায় ভুট্টার চাহিদা বাড়ছে। প্রাণিখাদ্য তৈরিতে প্রচুর ভুট্টা প্রয়োজন হচ্ছে। সে কারণে বাজারে তুলনামূলক গমের থেকে দাম বেশি পাওয়ায় কৃষকেরা ঝুঁকছেন ভুট্টা চাষে।
একই সময় যে গমের চাহিদা কমেছে তা কিন্তু নয়। উৎপাদন কমায় বাড়তি চাহিদা পূরণে বেড়েছে আমদানি। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভুট্টার তুলনায় বেশি সেচ খরচ, ভালো বীজের অভাব, ফলন কম, শ্রমিক সংকট ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে গম চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষকেরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সারাদেশে গত সাত বছরে গমের আবাদ কমেছে তিন লাখ একর জমিতে। এতে উৎপাদন কমেছে আড়াই লাখ টনেরও বেশি। একই সময়ে কৃষকেরা ঝুঁকছেন ভুট্টা চাষে। সাত বছরে ভুট্টা চাষ বেড়েছে তিন লাখ ১৫ হাজার একর জমিতে। তাতে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ টন।
তথ্য বলছে, সারাদেশে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০ লাখ ৯৯ হাজার একর জমিতে গমের আবাদ হয়েছিল। ওই বছর উৎপাদন হয়েছিল ১৩ লাখ ৪৮ হাজার টন, যা ক্রমান্বয়ে কমে গত অর্থবছর (২০২১-২২) এসে আবাদি জমির পরিমাণ আট লাখ দুই হাজার একরে ঠেকেছে। এ সময় উৎপাদন নেমেছে ১০ লাখ ৮৫ হাজার টনে।
যেখানে একই সময়ের ব্যবধানে (২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২) ভুট্টার জমির পরিমাণ ৮ লাখ ২৭ হাজার একর থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ লাখ ৪২ হাজার একর। উৎপাদন ২৪ লাখ ৪৫ হাজার টন থেকে হয়েছে ৪১ লাখ টন।
তবে এর মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে বিবিএসের থেকেও ভুট্টার উৎপাদন বেশি দেখানো হয়েছে। অধিদপ্তর বলছে, গত অর্থবছর ভুট্টার উৎপাদন হয়েছে ৫৬ লাখ ২৯ হাজার টন।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক গাজী এম এ জলিল বলেন, কৃষকরা লাভজনক ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছে। সেক্ষেত্রে গম থেকে ভুট্টাকে তারা সঠিক মনে করছে। কারণ তুলনামূলকভাবে ভুট্টার উৎপাদন খরচ কম, বাজারে দামও বেশি। বেশ কয়েক বছর ধরে ভুট্টার দামের ক্রমবর্ধমাণ প্রবণতা কৃষকদের সেগুলো চাষে উৎসাহিত করেছে।
অন্যদিকে গমের জন্য দীর্ঘমেয়াদি শীতের প্রয়োজন বেশি। এখন শীতের সময়কাল দিন দিন কমছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে গম চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষকেরা বলে জানিয়েছেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অরেক অধ্যাপক।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে এই অধ্যাপক বলেন, গমের চেয়ে কম পরিচর্যা ও কম সেচ খরচে ভালো ফলন হয় এবং দামও ভালো পাওয়া যায় ভুট্টায়। কয়েক বছর ধরে ভুট্টায় বিঘাপ্রতি খরচের দ্বিগুণ মুনাফা হচ্ছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে ভুট্টার উৎপাদন বাড়ছে।
বাংলাদেশে গম উৎপাদন বৃদ্ধির স্থবিরতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. গোলাম ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘গমের উৎপাদন না বাড়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। বর্তমানে জলবায়ুগত বৈশ্বিক সমস্যা, বিভিন্ন ফসলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, উপযুক্ত জাতের সীমাবদ্ধতায় একই সময়ে অন্যান্য শস্যের সঙ্গে পেরে উঠছে না গম। একই সময়ে গমের জমিতে ভুট্টা চাষে ঝুঁকছে কৃষক। এতে তারা লাভবান হচ্ছেন।’
গমের ন্যায্যমূল্য একটি বড় সমস্যা জানিয়ে এই গবেষক বলেন, ‘গম চাষ করে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক। সরকার দাম নির্ধারণ করলেও বাস্তবে দাম পাচ্ছেন ১৫ থেকে ১৬ টাকা কেজি, যা লাভের জন্য ৩০ টাকা হওয়া উচিত।’
গোলাম ফারুক আরও বলেন, ‘কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই। এটি দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। উৎপাদন কমলে খাদ্যঝুঁকি বেড়ে যাবে। এজন্য কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
অন্যদিকে দেশে উপযুক্ত আবহাওয়ার কারণে ভুট্টার ফলন খুব ভালো। বিশ্বে ভুট্টা চাষে হেক্টরপ্রতি সবচেয়ে বেশি ফলনের রেকর্ড তুরস্কের। দেশটিতে প্রতি হেক্টরে সাড়ে ১১ টন ফলন হয়। সেখানে বাংলাদেশে গত বছর হেক্টরপ্রতি ফলন হয়েছে ১০ দশমিক ৩৬ টন। কয়েক বছর আগেও ফলন ছিল ৮ টনের কিছু বেশি।
গম ও ভুট্টা শীতে প্রায় একই সময়ের ফসল। সারাদেশের জেলা বিবেচনায় ভুট্টা চাষে প্রথমেই রয়েছে দিনাজপুর জেলা। গমের ক্ষেত্রেও তাই। ওই জেলায় সমতল ছাড়াও নদীর চর এলাকায় গত কয়েক বছরে ভুট্টা চাষে সফল হয়েছেন চাষিরা।
দিনাজপুর সদর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামেরর চাষি মনির হোসেন বলেন, এখানে আগে সবাই গমের আবাদ করতো, এখন সে জায়গায় ভুট্টা হচ্ছে। আগে আমি পাঁচ-ছয় বিঘা জমিতে গম করতাম। এখন এক বিঘা বাদে পুরোটায় ভুট্টা করেছি।
মনির হোসেনসহ আরও কয়েকজন চাষী জানিয়েছেন, তারা গমের তুলনায় ভুট্টা চাষে প্রায় দ্বিগুণ মুনাফা পাচ্ছেন। প্রতি বিঘায় ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা খরচ করে ৪৫ থেকে ৫০ মণ ফলন হচ্ছে, যা বাজারে বিক্রি হয় মণপ্রতি ৫০০ টাকা। অর্থাৎ বিঘাপ্রতি ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ হচ্ছে।
ভুট্টার বড় বাজার
মাছ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির উৎপাদন বাড়ায় ভুট্টার চাহিদাও বাড়ছে। প্রাণিখাদ্য তৈরির বড় অংশই ভুট্টা থেকে আসে। এর মধ্যে মুরগির খাদ্য তৈরিতে ৫৫ শতাংশ ভুট্টার দরকার হয়। এ হার গবাদিপশুর খাদ্যে ৩০ ও মাছের ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। এ তিন খাতে বছরে ৫০-৫৫ লাখ টন ভুট্টার চাহিদা রয়েছে।
পাশাপাশি খাদ্য ও অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উপকরণ হিসেবে সবমিলে প্রতি বছর দেশে ভুট্টার প্রয়োজনীয়তা ছাড়িয়েছে ৭০ লাখ টন। স্বাভাবিকভাবেই দেশে দ্রুততম সময়ে বড় হয়েছে এ খাদ্যশস্যের বাজার। এখন দেশে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার ভুট্টার কারবার হচ্ছে। বীজ আমদানি থেকে শুরু করে ভুট্টা রফতানি পর্যন্ত চলে এ কর্মযজ্ঞ।
এছাড়া কয়েক বছর আলোচনায় রয়েছে ভুট্টার তেল। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বছরে দেশে উৎপাদিত ৫৪ লাখ টন ভুট্টা থেকে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টন ভুট্টার তেল আহরণ করা সম্ভব। যার বাজার মূল্য প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।
গমের আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে
চাহিদা মেটাতে দেশে গমের প্রয়োজন বছরে ৭০ লাখ টন। সেখানে উৎপাদন হচ্ছে এক-সপ্তমাংশ। এজন্য প্রতি বছর গমের আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে। একই কারণে দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে আটা-ময়দার দাম।
উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালের দামের কারণে এখন অনেক দরিদ্র মানুষ দুইবেলা রুটি খাচ্ছেন। রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকানে আটা থেকে তৈরি বিভিন্ন খাদ্যের চাহিদা বেড়েছে। পাশাপাশি যারা স্বাস্থ্যসচেতন তারাও ভাতের চেয়ে আটায় প্রোটিন বেশি ও জলীয় অংশ কম থাকায় পছন্দের তালিকায় এনেছেন আটার তৈরি খাদ্য। অন্যদিকে ডায়াবেটিস ও অন্যান্য রোগে আক্রান্তরা ভাত খাওয়া কমিয়ে রুটির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। এছাড়া ভাতের চেয়ে রুটির দাম তুলনামূলক কম। সব মিলিয়ে দেশে দ্রুত গমের চাহিদা বেড়েছে।
এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাব বলছে, বিশ্বের যে কয়টি দেশে সবচেয়ে দ্রুত গমের আমদানি বাড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। আর গম আমদানিতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ পঞ্চম।
চাহিদা মেটাতেই বিশ্ববাজার থেকে গম আমদানি বাড়ছে জানিয়ে দেশের শীর্ষ ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে আটা-ময়দার রুটিসহ অন্যান্য পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন চালের দাম বেশি। এ কারণে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। চাহিদা বেশি হওয়ায় আমদানি বেড়েছে।’