‘তুমি ভালো থাকো আর না-থাকো/ ফাল্গুন আসবেই এ দেশে’
আজ পহেলা ফাল্গুন। আমাদের মাঝে শুকনো পাতায় ভর করে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। হ্যা, ভোটাধিকার হারা. গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনরত দেশে আবারও এলো ঋতুরাজ বসন্ত। বর্তমান কালের কবি খালেদ হোসাইনের ভাষায়,‘তুমি ভালো থাকো আর না-থাকো/ ফাল্গুন আসবেই এ দেশে।/ ফুল যদি ঝরে যায়, নদী যদি মরে যায়/ ফাল্গুন আসবেই এ দেশে।’ গাছে গাছে সবুজ পাতা আর নানা রঙের ফুল। শিমুল বন আর কৃষ্ণচূড়ারা সেজেছে সূর্যের সাথে তাল মিলিয়ে রক্তিম রঙে। কোকিলরা গান ধরেছে ভ্রমরের গুনগুনানির তালে তালে। চারদিকে শোনা যায় ঝড়া পাতার নিক্কন ধ্বনি। বসন্ত বারৈ খুঁজে পায় নিজের নামের স্বার্থকতা।
এ দিন বিশেষ করে তরুণীরা বাসন্তি রঙের শাড়ি আর মাথায় হলুদ ফুল দিয়ে নিজেরদের নুতন করে সাজিয়ে তোলে। অন্যদিকে ছেলেরা সাজে হলুদ রঙের পাঞ্জাবিতে। গ্রাম-বাংলায় বিশেষ আয়োজনে চলে পিঠা উৎসব। আর শহরে এটি পায় বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা।
চীনেও বসন্ত বরণ হয়ে থাকে। এই বসন্ত বরণ উৎসব হলো তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব। তারা চন্দ্রপুঞ্জিকা অনুযায়ী এ উৎসব করে থাকে। তারা সিন চুন খোয়াইলা বলে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় আপনাকে বসন্তের শুভেচ্ছা।
বসন্ত ঋতু লুকিয়ে আছে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসের ভিতর। তবে অনুভবের জায়গা থেকে বলতে গেলে শুধু ফাল্গুন মাসের কথাই বলতে হবে। বাংলা বছর গণনায় ফাল্গুন ১১তম মাস হলেও কালের আবর্তনে এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটি শুধু একটি মাসের নামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন ঘটেছিল মহান ভাষা আন্দোলন। যা আজ বিশ্বব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারির মোড়কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর কাহিনীকে উপজীব্য করে জহির রায়হান রচনা করেছেন উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’। সারা পৃথিবীর ঋতু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এই বসন্ত ঋতু তথা ফাল্গুন মাসে দক্ষিণ এশীয় নাতিশীতোষ্ণ অ লের পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানেই এ সময়টি আশীর্বাদ রূপে আসে। এ সময়টা বিশ্বের বিভিন্ন অ লে মৃদু মানের বর্ষা হয় যার ফলে সেসব স্থানে বৃক্ষরা পত্রপল্লবে নিজেদের জানান দেয়। অন্যদিকে হীমাচল প্রদেশসহ কাস্মীর অ লের তুষারপাত ক্রমে কমে আসে এবং মানুষ তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মের ভরসা পেতে থাকে। পৃথিবী সূর্যের দিকে ঢলে পড়ে বলেই শীত তার ইতিটানতে বাধ্য হয়। এই সময়টাতে প্রাণিকুলের প্রজননের মোক্ষম সময়। পৃথিবীজুড়ে নুতন নুতন প্রাণের স ার হতে থাকে। তারা প্রকৃতির শ্রী বৃদ্ধির পাশাপাশি টিকিয়ে রাখে পরিবেশ ও প্রতিবেশ।
আমাদের দেশে ফাল্গুন শব্দের পাশাপাশি বসন্ত শব্দের নানাবিধ ব্যবহার হচ্ছে। যেমন : যৌবনের তেজ বুঝাতে বলে থাকি ফাগুনের আগুন। আবার মজা করে টিপ্পুনি কেটে বলে থাকি আরে হ্যাঁ বুঝি বুঝি আর বলতে হবে না, তোর মনে যে ফাগুনের হাওয়া বইছে তা আর বলতে হবে না।
এই ফাল্গুন মাসকে নিয়ে আমাদের লোক গানের পাশাপাশি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় রয়েছে নানা রচনা। যেমন বাউল সুরে গাওয়া হয় নারী হয় লজ্জাতে লাল, ফাল্গুনে লাল শিমুল বন, এ কোন রঙে রঙিন হলো বাউল মন..মন রে….এ কোন রঙে রঙিন হলো বাউল মন। নারী লজ্জাতে লাল হয় না পুরুষ লজ্জাতে লাল হয় তা বিতর্কের বিষয়। তবে ফাগুনের মাসে শিমুলের বন যে লাল হয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন…‘ফাল্গুনে বিকশিত/কা ন ফুল,/ডালে ডালে পুঞ্জিত/আম্রমুকুল।/চ ল মৌমাছি/ গুঞ্জরি গায়,/বেণুবনে মর্মরে/ দক্ষিণবায়।/ স্পন্দিত নদীজল/ ঝিলিমিলি করে,/ জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি/বালুকার চরে।’ কবি ফররুখ আহমদের ভাষায়,‘ ফাল্গুনে শুরু হয় গুনগুনানী,/ভোমরাটা গায় গান ঘুম ভাঙানি,/এক ঝাঁক পাখি এসে ঐকতানে/গান গায় এক সাথে ভোর বিহানে,/আযানের সুর মেশে নীল আকাশে/শির শির করে ঘাস হিম বাতাসে,/আচানক দুনিয়াটা আজব লাগে/আড়মোড়া দিয়ে সব গাছেরা জাগে,/লাল নয়, কালো নয়, সবুজ ছাতা/ জেগে ওঠে একরাশ সবুজ পাতা,/হাই তুলে জাগে সব ফুলের কুঁড়ি/প্রজাপতি ওড়ে যেন রঙিন ঘুড়ি।/বনকুল মিঠে যেন তাল পাটালি,/পরখ করতে নামে কাঠবিড়ালী,/পিপঁড়ারা নামে কাজে দায় এড়াতে/মৌমাছি চৌগাছি যায় বেড়াতে,/শীত শেষে হিমবুড়ী যায় সে চলে,/ফাল্গুনে হাসিখুশি তাই সকলে।’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন- ‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত।’