আমরা কবি ফররুখ আহমদকে পাই রেনেসাঁর কবি হিসেবে, ছন্দের কবি হিসেবে। ছোট বড় সকলের পরিচিত এক বাস্তবতা বিরোধী কবি হিসেবে। তিনি সুদূরপ্রসারী চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন। তার যে লেখাগুলো পড়ে আমরা রেনেঁসার কবি বলি সেগুলো বিচার করলে দেখা যায় তিনি শত বছর পরের বাস্তবতাকে অনুভব করতে পেরেছিলেন। তার অনেক কবিতা পাঠে এখনো মনে হয় এই বুঝি তিনি পরিবেশ সমাজ ও পৃথিবীর প্রেক্ষাপট দেখে দেখে লিখেছেন। কবির সাহিত্য সাধনা ছিলো মোটামুটি চার দশক। এই চার দশকের প্রথমে তিনি কলকাতায় সাহিত্য রচনা করেন, এ সময়ে দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু অজস্র কবিতা ও অন্যান্য রচনা সে সময়ে পাওয়া যায়। বাকি তিন দশক ঢাকায় ১৯৪৮-৭৪, এ সময়ের সাহিত্য রচনা বিশাল ভান্ডার তৈরি হয়, লেখালেখিতে কখনো বিরতি পড়েনি। তিনি সাহিত্য তেমনটা রচনা করেননি কারণ কবিতা তার মূল উৎস। তার সমসাময়িক ছিলেন কবি আবু রুশদ, আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, গোলাম কুদ্দুস ও শওকত ওসমান।
আবু রুশদের মন্তব্যে তাকে আধুনিক তথা রোমান্টিক কবি বলেছেন কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক বাস্তব বোধের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তার একটি বলিষ্ঠ সজাগ তীক্ষè অনুভূতিশীল মন আছে।
অশান্ত পৃথিবী একটি সনেট কবিতা। আঠারো অক্ষরের চরণ মাত্রায় রচিত। “মূহূর্তের কবিতা” কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কবিতা অশান্ত পৃথিবী। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে যা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ সময়। সে সময় অর্থাৎ ষাটের দশকের শক্ত হাতের তেজস্বী লেখকদের মধ্যে রয়েছেন, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, আহসান হাবীব, সুফিয়া কামাল, শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরী, বন্দে আলী মিয়া, অধ্যাপক শাহেদ আলী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, মাহবুব উল আলম, কাজী মোতাহার হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ বিখ্যাত জন। তারা ষাটের দশকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। সবচে মজার বিষয় হলো ১৯৬৩ সালের এই বছরটিতে অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ পাকিস্তান রিভিউ পত্রিকার জানুয়ারি সংখ্যায় Farrukh Ahmed: The Representative Of East Pakistan নামে ইংরেজিতে একটি প্রবন্ধ লিখেন। যেখানে তার প্রশংসা করা হয়। ব্যঙ্গ কবিতা ধোলাই কাব্য ও এই বছরই প্রকাশিত হয়। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় বাংলা “ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ” এই উপলক্ষে চর্যাপদ থেকে ফররুখ আহমদ পর্যন্ত কবিতা আবৃত্তির আয়োজন করা হয়েছিলো। এতে কবির ডাহুক কবিতাটি আবৃত্তি করেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
ভাষা আন্দোলনের পর থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত সময়টা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক সংকটকালীন সময় ছিলো। তথাপি সাহিত্যে অবদান রাখা, আন্দোলনমুখী সাহিত্য রচনা করা সবই ছিলো কণ্টকাকীর্ণ। সে সময় তাঁর প্রকাশিত কবিতা সমূহের নামকরণে বুঝা যায় কেমন সময় গিয়েছিলো, কেমন দুর্যোগ ছিলো যা নিয়ে কবিতা রচিত হয়েছিলো। কবিতার নাম- দুর্লভ মূহূর্ত, ঝড়, বৃষ্টি, ক্লান্তি, নাস্তিকের প্রার্থনা, সাতান্নর কবিতা, তুমি জাগলে না, তোমাকে জাগাবো, এ বিধ্বস্ত শহর এবং আজকের আলোচ্য কবিতা অশান্ত পৃথিবী। কবিতায় মানবতার ক্লান্ত শ্রান্ত অবহেলিত জীবনের কথা স্থান পেয়েছে। কবির হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে লিখেছেন পৃথিবীর জন-মানবের কথা। কবিতার লাইনগুলো যেন আজই লিখেছেন, আজকের সময়টি আসবে তিনি জানতেন। এসেছেও ঠিকভাবে। কত চিন্তাশীল তুখোড় মেধাবী বিজ্ঞ বিচক্ষণ কবি ছিলেন শতবর্ষ আগেও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন শতবর্ষ পরে, তিনি জানতেন তার কবিতায় মধু লাগানো আছে, শতবর্ষ পরেও মৌমাছি মৌ মৌ করে নেচে নেচে গিয়ে বসবে। তেমনি ফররুখ বাংলার শান্তিহারা মানুষের ব্যাধিগ্রস্ত মনের কথা লিখেছেন। যা তাকে হাজার বছর মনে রাখবে। কবি লিখেছেন “পারে না সান্তনা দিতে তাকে আর গতির স্পন্দন”। যে সকলের নাড়ির স্পন্দনের অনুভূতি তিনি কলমের কালিতে প্রকাশ করেছেন। আরো লিখেছেন
অশান্ত পৃথিবী” কবিতায় ক্ষত অঙ্গ হতে তার ঝরে পড়ে ক্লেদ, রক্ত, পুঁজ, সংখ্যাহীন ইয়াজুজ মাজুজ মুক্তির নামে দেয় চরম বন্ধন।
অতি সরল ভাষায় সময়ের সংকট, সভ্যতার সংকট দেখা দিয়েছে সমাজে। কবিতায় কবি অংকন করেছেন নিপুণ হাতে। মনের আকুতি ভরা হতাশা প্রকাশ করে চিৎকার করে বলেছেন – এ পৃথিবী শান্তি চায়, শান্তি চায় মানুষের প্রাণ। হতাশায় নিমগ্ন- জানি না কখন তার দুঃখ রাত্রি হবে অবসান
কন্টকিত প্রশাখায় ফুটবে সে গোলাবের মতো।
হিংস্র ক্ষুধাতুর রাত্রি” কবিতায়-
হিংস্র, ক্ষুধাতুর রাত্রি আজাদাহার মত কুন্ডলীতে
ঘিরেছে সহস্র পাকে পৃথিবীকে।
এ রাত্রির ফণা ঢেলে যাবে মৃত্যু বিষ যদি তুমি হও অন্যমনা,
ক্রুর কুন্ডলীতে বন্দী মুক্তি নাই তোমার আমার
সাপের ফণার মতো মৃত্যু-তিক্ত এই শর্বরীতে।
যখন তৎকালীন সরকারের কাছে কোনো অধিকারই পাচ্ছিলেন না তখন কবিতাকে বানিয়েছেন হাতিয়ার, কোনো প্রতিশ্রুতি সরকার পূরণ করছে না, কথা দিয়ে কথা রাখে না, অধিকার দেয় না, তখন তিনি লিখেছেন- সংশয় সন্দেহ দ্বন্দ্ব অবিশ্বাসে রক্তাক্ত বিক্ষত। যে নাকি মারণাস্ত্র গড়ে সেও মৃত্যু ভয়ে বিব্রত। হতাশার পাহাড়ে মাথা রেখে তিনি আকাশের পানে তারকার দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ করে বলেছেন- জানি না কখন তার দুঃখ রাত্রি হবে অবসান
কন্টকিত প্রশাখায় ফুটবে সে গোলাবের মতো।
“হিংস্র ক্ষুধাতুর” রাত্রি কবিতায় আফসোস করে চিন্তিত মনে লিখেছেন- হিংস ক্ষুধাতুর রাত্রি আজদাহার মত কুন্ডলী তে ঘিরেছে সহস্র পাকে পৃথিবীকে।
এক অন্ধকার যদি শেষ হয় তবে ঘনতর
রাত্রির তরঙ্গ মেঘে নেমে আসে প্রগাঢ় আঁধার।
একটি সূর্যোদয়, স্বর্ণ ঈগল, মুক্তি স্বপ্ন “ এ সব কবিতায় কবি আশার আলো সঞ্চার করেছেন। ভোরের ইশারা পেয়ে নিশাতের অস্পষ্ট তিমিরে যেমন আতপ্ত নীড়ে জেগে ওঠে নিঃশঙ্ক ঈগল তরঙ্গ, তুফান, ঝড় পাড়ি দিতে দূর আকাশের।।
কিংবা
দুর্জয় দুর্বার, দৃঢ় রাখে পূর্ণ শক্তি যে পাখাতে
মরুর দুরন্ত ঝড়ে কোন দিন ভোলে না যে দিক।
কিংবা
দুঃস্বপ্নের রাত্রি শেষে তাই জাগে সুর প্রার্থনার।
তথ্যসূত্র: ১। কবিতা সমগ্রঃ ফররুখ আহমদ, অনন্যা প্রকাশনী। ২। আবদুল মান্নান সৈয়দ, প্রবেশক অংশ।
৩। বিভিন্ন সাময়িকী ও দৈনিক পত্রিকা।