রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৬ অপরাহ্ন

আমার মা

হাসান আলীম :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০২৩

এ জীবনের ৬৬ বছর আমার বুকে, আমার মনন মেধায়, আমার প্রার্থনায়, সদা সর্বক্ষণ আমার বুকে আলোর প্রদীপ হয়ে, আল্লাহর রহমত হয়ে, পার্থীব জান্নাত হয়ে সদা জাগ্রত ছিলেন আমার যে জন্মদায়িনী, মমতাময়ী মা, তিনি গত পহেলা মার্চ, ২০২৩ রাত্র সাড়ে দশটার দিকে পরম প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের ছেড়ে চিরকালের জন্য বেদনার কালো রুমাল উড়িয়ে চলে গেলেন। তার মুখে ছিলো চন্দ্র জোছনার হাসি, আহা! কী মায়াবী সে চন্দ্র জ্যোতি মুখ। মায়ের মধুর মুখ! আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ, আল্লাহর রহমত, আমার জান্নাত চলে গেল! যার উদরে আমার জন্ম, যার গর্ভে দশ মাস আমার বসবাস ছিলো, যার রক্ত, যার শরীরের খাদ্যপ্রাণ ছিলো আমার একমাত্র খাদ্য, যার শ্বাসপ্রশ্বাস ছিলো আমার শ্বাসপ্রশ্বাস! যার হায়াতের রশিতে বাঁধা ছিলো আমার হায়াতের রশি – আমার জীবন, তিনি চলে গেলেন। তার জন্য আমার মমতাময়, আমার জন্মদাতা পিতা বিশ বছর অপেক্ষা করছিলেন। আজ তিনি তার পাশে, তার কবরের পাশে শায়িত হলেন। আমার পিতা আজ থেকে বিশ বছর আগে, ২০০৩ সনের ১৮ ফেব্রুয়ারি, দুপুর ১২টা ১২ মিনিটে ধ্যানরত অবস্থায় আল্লাহর ডাকে চলে গিয়েছিলেন।
আমার মমতাময়ী মা ঐ রাতে এশার নামায পড়ে পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা ইয়াছিন, সূরা মূলক পড়তে পড়তে পরম প্রভু মহান আল্লাহর কাছে চলে যান। ঐ সময় তিনি আমার তৃতীয় ভাই হাফেজ মাওলানা শাহ হাবিবুল্লাহর কণ্ঠে পবিত্র কুরআনের সূরা ইয়াছিন শুনছিলেন। আমার ভাতৃবধূ মনীরার মুখে দোয়া দরুদ শুনতে শুনতে হাসপাতালের ট্রলিতে বসে তার হাতের ওপর মাথা রেখে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছিলেন। আমার বাবা প্রায় একশত বছর হায়াত পেয়েছিলেন। আর আমার মা প্রায় বিরাশি বছর হায়াত পেলেন। আজ আমরা জীবিত সাত ভাই বোন মাতৃহারা হয়ে গেলাম! আমাদের জান্নাত আমাদের মমতাময়ী মা, আজ মাতৃসম মৃত্তিকার কোমল আদরে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন! পারিবারিক কবরস্থান ‘ জান্নাতুল -ইসরাইল’- মিয়াবাড়ি, খায়েরদিয়া মিয়াপাড়া, সালথা, ফরিদপুরে তিনি ঘুমিয়ে গেলেন! তার নামাযে জানাযা আমাদের বাড়ির মসজিদ কাচারী ঘর ও দোতলা ঘরের আঙিনায় অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় আত্মীয় স্বজনসহ, নিজমহল্লা, পার্শ্ববর্তী গ্রামের এবং আমাদের গ্রামের কয়েক হাজার পুরুষের অংশগ্রহণ ছিলো। আমার ভাই হাফেজ মওলানা শাহ হাবিবুল্লাহ নামাযে জানাযার ইমামতি করে। ইমামতির পূর্বে আমি, আমার ছোট ভাই শাহ আসাদ উল্লাহ, মামাতো ভাই আমিরুল ইসলাম এবং ছোট ভাই শাহ হাবিবুল্লাহ মায়ের কর্মময় জীবনের ওপর কথা বলি।
ফরিদপুর শহর থেকে গ্রামের বাড়ীতে মায়ের কফিন এসেছিল রাত তিনটার দিকে। আমরা ঢাকা থেকে রাত্র পৌনে চারটার দিকে চারটা হায়েক্স গাড়িতে ভাই বোন, ভাতৃবধূরা, ভাতিজা, ভাতিজি, ভাগনা ভাগনি, ভগ্নিপতি ও নিকট আত্মীয় স্বজনরা এসেছিলাম মায়ের শেষ দর্শনের জন্য। বাড়িতে তখনই অনেক লোকের ভিড়, রাত্র শেষ হতে না হতেই শোকার্ত লোকের ভিড় বাড়তে থাকে। পার্শ্ববর্তী গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু সুহৃদ সুজনও এসেছিলো মায়ের স্নেহের টানে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের বাড়িতে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের আব্বা আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাদের মহিলাদের আমার মমতাময়ী মা অনেক দেখভাল করেছিলেন। আমার হিন্দু বন্ধুদের নিজ হাতে খাইয়েছেন। আমার হিন্দু বন্ধুর ভাই বোন সহ তাদের আত্মীয় স্বজনদের, যারা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন তাদের খুব যতœ করে আপ্যায়ন করতেন। আমার হিন্দু বন্ধুদের অনেকে আমার মাকে মা বলতো, চাচিমা বলে সম্বোধন করতো। আমার মা নিঃসংকোচে তাদের সাদরে গ্রহণ করতেন।
মায়ের কফিন ছিলো দোতলা ঘরের বারান্দায়। শত শত নারী শিশুরা আমার মাকে দেখার জন্য ভিড় করে। সবার চোখে শোকের অশ্রু, অনেক নারীকে, অনেক পুরুষ লোককেও বুক চাপড়ে হাঁউমাউ করে, চিৎকার করে কাঁদতে দেখেছি। আমাদের বাড়িতে তখন শোকের জন-উত্তাল তরঙ্গ। আমরাতো কাঁদবো, কারণ আমরা তার সন্তান কিন্তু আমার মায়ের শত সন্তান রয়েছে এ মহল্লা, এ গ্রামে। যারা, যে নারী পুরুষেরা তাদের ছোট সময়ে, যে নারীরা তাদের সুখে দুখে সব সময় আমার মাকে তাদের সাথে পেয়েছে, অর্থকড়ি, খাদ্য খাবার পেয়ে উপকৃত হয়েছে তাদেরকে চিৎকার করে কান্নার সুরে সেই সব কথা বলতে শুনেছি, যা শুনে আমি আরও আবেগাক্রান্ত হয়ে গিয়েছি, বাষ্পরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার কণ্ঠ।
আমার মা কেবল সাধারণ কোন মহিলা ছিলেন না -তিনি মহল্লার নারী পুরুষের প্রয়োজনীয় কাজে বিভিন্ন রকম সহযোগিতা করেছেন। আমার বাবার সাথে, বাবার মৃত্যুর পর মহল্লার অসহায় নারী পুরুষের অনেক সামাজিক কাজে, অনেক অভাব-অভিযোগ অপনোদনের জন্য আমার মা সমাজ সেবায় ভূমিকা পালন করেছেন। আমার মা পর্দানশীন মহিলা, তিনি দুবার পবিত্র হজ¦ পালন করেছেন। তিনি জীবনে নামায কাজা করেননি। নিয়মিত রোজা পালন করেছেন। নিজের টাকার জাকাত দিয়েছেন মহল্লার গরীব লোকদের। তাকে নিয়মিতভাবে তাহাজ্জুদ নামায পড়তে দেখেছি। তিনি যেমন ছিলেন পরহেজগার, তেমন ছিলেন জনদরদী গরীব -বান্ধব নারী! সেই মায়ের মৃত্যুর পর শত সহস্র নারী পুরুষের ভিড় খুব স্বাভাবিক ছিলো।
তদুপরি মা যেহেতু নারী, নারীদের মৃত্যুর পর খবর এলাকায় মাইকিং না করার সংস্কার রয়েছে, জানাযায় বেশি পুরুষ মানুষের শরীক না হওয়ার রীতি রয়েছে। সেই কারণে আমার মায়ের জানাযার জন্য মাইকিং করে লোক সমাগম করিনি। তারপরও কয়েক হাজার পুরুষের সমাগম হয়েছিল। জানাযা শেষে সমাগত লোক যেন শোকের মিছিলে একত্রিত হয়েছিল। সবার চোখে বেদনার নীলজল। সবার কণ্ঠ বেদনায় বাকরুদ্ধ। আর কে দেবে তাদের খাবার, কে দেবে সান্ত¡নার শীতল পরশ। মহল্লার লোকদের, নারী পুরুষের চোখে মুখে বিচ্ছেদ বেদনার কালো মেঘ। মা, মা করে হাঁউমাউ করে কান্না করেছে অনেক পুরুষ, অনেক নারী। হাঁটতে পারে না, ক্রাচের ওপর ভর করে তারা এসেছেন আমার মায়ের জানাযায়, পঙ্গু লোককেও দেখেছি কারো সহযোগিতায় মায়ের নামাযে জানাযায় শরীক হতে। আমরা তার সন্তানেরা এ জন্য চির কৃতজ্ঞ -এইসব অকৃত্রিম ভালোবাসার স্বজনদের জন্য!
মায়ের দাফন কাফনের পর তাকে পরম মমতায় কবরে শায়িত করা হয়। কবরে তাকে রেখে দেওয়ার কাজে নিকটজন আমার ছোট ভাই শাহ আবদুল্লাহ, ছেলে হাসান আল জাবির, আমার ভাগিনা রুহুল আমিন চৌধুরী নাইম, আমার ভাই হাফেজ শাহ হাবিবুল্লাহ, মামাতো ভাই নিজাম, মামাতো ভাই জিকরুল্লাহ, মামাতো ভাই মফিজুর রহমানসহ আরও অনেক মাহরাম পুরুষ অংশগ্রহণ করেন। আমরা অপর ভাইয়েরা কবরে মাটি দেওয়ার কাজে সহযোগিতা করেছি। কবর খোঁড়ার কাজে আমজেদ ফকির, বাবলু ফকির, নান্নু মোল্লা, জাকির খা, সোলায়মান শেখ প্রমুখ অংশগ্রহণ করেছেন। আমরা তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। মহান আল্লাহ আমার মায়ের রুহকে ইল্লিনে রাখুন, তার পবিত্র দেহ সংরক্ষণ করুন এবং তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসের উচ্চ মাকাম দান করুন। # লেখক: কবি




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com