রাজধানীর বঙ্গবাজারের আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষত সেরে উঠতে কতো সময় লাগবে জানে না কেউ! এখানকার ব্যবসায়ীরা পাইকারি পণ্য বিক্রি করতেন। খুচরা বিক্রির চিন্তাও করতেন না। অথচ তারা এখন কাঠফাটা রোদে মাথার ওপরে ছাতা ধরে খুচরা ক্রেতাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ক্রেতা এলে দরদাম না করেই স্বল্প লাভে পণ্য বিক্রি করছেন। গত রবিবার (১৬ এপ্রিল) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, বঙ্গবাজারে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা ব্যবসায়ীদের চোখেমুখে হতাশা ছাপ। অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাজনরা এভাবে বসতে না চাইলেও কর্মচারীরা বসেছেন। গভীর রাত পর্যন্ত কেনাবেচা চললেও ইফতারের পরই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছেন তারা। রাতে মালামাল নিয়ে যাচ্ছেন বাসায়।
দোকানিরা বলছেন, সর্বস্ব হারিয়ে মহাজনরা পাগলপ্রায়। এই অবস্থায় তাদের রোদের মধ্যে দোকানে আসতে নিষেধ করা হচ্ছে। আমারা ব্যবসা ছাড়া অন্য কিছু শিখিনি। তাই ব্যবসাই করতে হবে। দোকান শ্রমিক থেকে মালিক হওয়ারও সুযোগ আছে। রোদে একটু কষ্ট হলেও ব্যবসা করতেই হবে। আগুনে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ইউনিট রয়েছে চারটি। এরমধ্যে আর্দশ ইউনিট, মহানগর ইউনিট, গুলিস্তান ইউনিট ও বঙ্গবাজার ইউনিটের মোট দোকান ২ হাজার ৯৬১টি। বঙ্গবাজার ইউনিটেই ভ্রামমাণ ব্যবসায়ীরা বসেছেন। সব দোকানি এখনও চৌকি নিয়ে বসতে পারেননি। এখনও কাজ করছে সিটি করপোরেশন।
ছেলেকে নিয়ে বঙ্গবাজারে মার্কেট করতে এসেছেন রাজধানীর কামরাঙ্গীচর এলাকার প্লাস্টিক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ তুহিন। তিনি বলেন, ‘প্রতিবারই এখান থেকে কমবেশি মার্কেট করি। এবারও এসেছি। দেখি কী কিনতে পারি। না হলে অন্য মার্কেট থেকে কেনাকাট করতে হবে।’
বঙ্গবাজার ইউনিটে রবিউল নামে এক ব্যবসায়ীর ছাতার নিচে দুজন ক্রেতাকে দেখে এই প্রতিবেদক এগিয়ে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন। ব্যবসায়ী বলেন, একটু পরে কথা বলেন। আজ একটা কাপড়ও বিক্রি করতে পারিনি। ক্রেতাকে কাপড় দেখতে দেন। পরে ওই ক্রেতা শিশুদের একটি প্যান্ট কিনে চলে যান।
এরপর ওই ব্যবসায়ী বলেন, তেমন বেচাকেনা নেই। এখানে কেউ আসছে না। হয়তো অন্য মার্কেটে গিয়েছিল। এখান দিয়ে যাওয়ার সময় কাপড় দেখছে, দামে হলে নেবে বলে এসেছে। ওই সময় আপনি কথা বলার চেষ্টা করলে হয়তো না কিনেই চলে যেতো। বঙ্গবাজারে মায়ের দোয়া ১৮২৯-৩০ নামে দুটি ব্যাগের দোকানের কর্মচারী সাগর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে এই দোকানে পাইকারি কেনাবেচা হতো। কিন্তু এখন খুচরা কেনাবেচা করছি। তাও টুকটাক হচ্ছে। দিনে হয়তো দু-চারটা কেনাবেচা হয়। প্রতিদিন মালামাল গোডাউনে নিয়ে রাখি।’ পাশের আরেক ব্যাগের দোকানিও একই কথা বলেন। পায়েল ফ্যাশানের মালিক নুরুল হোসেন বলেন, ‘বেচাকেনা খুবই খারাপ। ক্রেতা আসছে না। সব ব্যবসায়ী বসে আছে। সন্ধ্যার পরেও কেউ আসছে না। এটা ছিল পাইকারি মার্কেট, এখন খুচরা কেনাবেচা করছি। এই মালামালগুলো গোডাইনে ছিল, তাই নিয়ে বসছি। কয়েকজন স্টাফ আছে তাদের জন্য কিছু করা যায় কিনা– তাই বসেছি। মালিক কর্মচারীকে ছাড় কর্মচারী মালিককে ছাড়া চলতে পারে না।’ বরিশাল প্লাজার রিংকো গার্মেন্টসের কর্মচারী জনি বলেন, ‘এই মার্কেটে রিংকো গার্মেন্টসের সাতটি দোকান ছিল। সবগুলো পুড়ে গেছে। একটা মালামালও উদ্ধার করা যায়নি। এই গার্মেন্টসের কারখানা সুরিটোলা এলাকায়। সেখানেই এসব প্যান্ট-শাট তৈরি হয়। সেখানে থেকে এনে এখানে পাইকারি বিক্রি করা হতো।’
বঙ্গবাজারের একটি ব্যতিক্রমী ১৮৮৫ নম্বর দোকান যুবায়ের প্যান্ট হাউজ। ওই দোকানের কর্মচারী জসিম হোসেন জানান, এ মার্কেটে তাদের একটি দোকান ছিল। গোডাউন ছিল অন্য মার্কেটে। এই অবস্থায়ও তারা খুচরা মালামাল বিক্রি করছেন না। পাইকারি বিক্রির জন্য অপেক্ষা করছেন। কয়েকদিনে বেশকিছু মালামাল বিক্রি হয়েছে। কিন্তু কাঠফাটা রোদে জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে। জসিম হোসেন বলেন, ‘বছরে এই মার্কেটের প্রতিটি দোকানে কয়েক কোটি টাকার কেনাবেচা হতো। তার অধিকাংশ হতো ঈদকে সামনে রেখে। কিন্তু এবার আমরা একেবারে পথে বসে গেছি।’ গত ৪ এপ্রিল সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজারে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। ৬টা ১২ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। সর্বশেষ ৪৮টি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। পরে ১২ এপ্রিল সকাল থেকে চৌকি পেতে শুরু হয় ব্যবসা।