সম্প্রতি কুমিল্লায় মালবাহী ট্রেন ও একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়েছে তার পেছনে সিগনালিংয়ের সমস্যা ছিল বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় এ পর্যন্ত দু’জনকে- লোকোমোটিভ মাস্টার বা ট্রেনটির চালক ও তার সহকারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদেরকে আসলে সিগনাল দেয়াই হয় নাই। তাদের অপেক্ষা করার কথা ছিল, কিন্তু তারা সেটি না করে ট্রেন চালিয়ে চলে আসছেন। প্রাথমিক অবস্থায় এটাই পাওয়া গেছে।’ এ কারণে তাদের বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী। একই সাথে সিগনাল যারা চালান তাদের কিছুটা গাফিলতি আছে কি না সেটা দেখা হবে বলেও জানানো হয়। এর আগে ১৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি যাত্রীবাহী ট্রেন কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে একটি মালবাহী ট্রেনের সাথে সংঘর্ষের পরে বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হয়। দুর্ঘটনায় সোনারবাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। পুলিশ তখন জানায়, হাসানপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা মালবাহী ট্রেনকে ধাক্কা দেয় যাত্রীবাহী ঢাকাগামী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেন। এ ঘটনার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রেন চলাচল কয়েক ঘণ্টা বন্ধ হয়ে যায়।
বেসরকারি সংস্থা যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রেললাইনের সাথে সম্পৃক্ত নানা দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এসব রেল দুর্ঘটনার মধ্যে ট্রেনের সংঘর্ষ ছাড়াও রেলক্রসিংয়ে অন্য যানবাহনের সাথে সংঘর্ষ, ধাক্কা এবং রেললাইনে কাটা পড়ে মৃত্যু- এসব পরিসংখ্যানও উল্লেখ রয়েছে। তবে ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের সংখ্যা খুব বেশি হয় না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা খুবই কম। এই যে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা বছরে ৮-১০টির বেশি হয় না। পাঁচটি, সাতটি থেকে ১০টির মধ্যেই থাকে।’
তবে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘আমরা তো মনে করছি যে ট্রেনের দুর্ঘটনা নাই বললেই চলে। আমি আসার পরে একটা দুর্ঘটনা মন্দবাগে হইছিল, আর এটা সেকেন্ড আরেকটা দুর্ঘটনা। আর যেগুলো হয়েছে, সেগুলো রেলক্রস নিয়ে।’
রেলমন্ত্রী মনে করেন রেলক্রসিংয়ে যেসব দুর্ঘটনা সেগুলো রেলের দুর্ঘটনা নয়।
তিনি বলেন, ‘রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা তো রেলের দুর্ঘটনা না, এটা অন্যরা রেলওয়েতে এসে অবস্ট্রাকশন তৈরি করে সেই কারণে হয়েছে। সেটা রেলের কিছু না।’
কেউ ইচ্ছে করে দুর্ঘটনা ঘটায় না উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, রেলপথের উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। চট্টগ্রামের কিছু অংশ ছাড়া বাকি সবই ডাবল লাইন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে কিছুটা অংশ ডাবল লাইন হয় নাই, এছাড়া সবটাই ডাবল লাইন।’ দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরা রেল লাইনে দুর্ঘটনার কিছু কারণ ব্যাখ্যা করেছেন।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাব: দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে রেলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা। এছাড়া অপারেশনের ঘাটতির কারণে একই লাইনে দু’টি ট্রেন চলে আসতেও দেখা যায়।
বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. শামসুল হক বলেন, বাংলাদেশে যে ধীর গতিতে ট্রেন চলাচল করে সেখানে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটার জন্য রক্ষণাবেক্ষণের অভাবই দায়ী।
রেলওয়ের রোলিং স্টক বা বাহনগুলো সব নতুন হওয়ার পরও এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে রেল লাইনের বেজ বা ভিত্তি ঠিক থাকে না, ভিত্তির লেভেল ঠিক থাকে না, নিচে যে উপাদানগুলো থাকে সেগুলো ঠিক সময়ে পরিবর্তন করা হয় না, জোড়া-তালি দিয়ে রাখা হয় এবং এ কারণেই দুর্ঘটনা হয়ে থাকে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, দেশে রেল দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে দুর্বল ইঞ্জিন এবং সংস্কারবিহীন নড়বড়ে রেলপথ। লোকোমোটিভ ইঞ্জিন যেটা আমদানি করা হয়েছে এগুলো আসলে নি¤œমানের ইঞ্জিন এবং এগুলো বেশ দুর্বল।
এই প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে রেল ইঞ্জিনের সংখ্যা ছিল ৪৪২টির মতো। আর বর্তমানে এই সংখ্যা ২৫০টির মতো। এর মধ্যে আবার ৮৩ ভাগ ইঞ্জিন মেয়াদোত্তীর্ণ।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, নতুন করে যেসব ইঞ্জিন আমদানি করা হয়েছে সেগুলো অত্যন্ত নি¤œমানের।
লোকবল সঙ্কট: বাংলাদেশের রেলওয়েতে লোকবলের সঙ্কট এবং এর কারণে দুর্ঘটনা ঘটার অভিযোগ নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে দেশে রেলের জনবল ছিল ৬৮ হাজার। ২০১৯ সালের দিকে এই সংখ্যা কমে এসে দাঁড়ায় ২৭ হাজারে। রেলওয়ে মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এর আগে বলেছিলেন, ১৯৮৬ সাল থেকে রেলওয়েতে নিয়োগ একেবারে বন্ধ ছিল। বিএনপি সরকারের সময়ে রেলওয়ে থেকে ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক কর্মসূচিতে বিদায় করা হয়েছিল। ফলে ট্রেনের চালকসহ লোকবলের সঙ্কট এখনো রয়েছে। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. শাসসুল হক বলেন, বর্তমানে ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু দক্ষ লোকবল তৈরি হয়নি।
অভিজ্ঞ লোকোমাস্টার বা ট্রেন চালক যেমন দরকার ঠিক তেমনি ট্রেনের শিফট বা শিডিউল যারা ব্যবস্থাপনা করেন সেই স্টেশন মাস্টারও দরকার। আর এ দায়িত্ব পালনে অনেক বেশি দক্ষতা ও ধৈর্য্য দরকার হয়।
স্টেশন মাস্টারদের যে ধরনের দায়িত্বশীল হওয়ার কথা, সেখানে গাফিলতির কারণেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করেন তিনি। কারণ এতে সিগনালিংয়ে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।তিনি বলেন, ‘যেখানে স্টেশন মাস্টার আছে, সেখানেও দক্ষ জনবলের অভাব আছে।’
অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং: ট্রেন দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং। রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দুই হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে রেলক্রসিং আছে প্রায় দুই হাজার ৫৪১টির মতো। সে হিসাবে বাংলাদেশে প্রায় প্রতি কিলোমিটারে একটা করে লেভেল ক্রসিং আছে বললে ভুল হওয়ার কথা নয়। এসব ক্রসিংয়ের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশে কোনো গেট নেই বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. শাসসুল হক বলেন, এসব লেভেল ক্রসিংয়ের বেশিরভাগই অনুমোদন ছাড়া এবং স্থানীয় সরকার বা মিউনিসিপালিটি জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য অবৈধভাবে তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, ‘লেভেল ক্রসিং কিন্তু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটা জায়গা। তো সেটা যদি অবৈধভাবে সংখ্যাটা বাড়তে থাকে এবং এটার যদি চেক না থাকে, ঝুঁকিপূর্ণ তো হবেই এবং সেভাবেই কিন্তু লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনাগুলো প্রচুর পরিমাণে হচ্ছে।’ সামনে এ ধরনের লেভেল ক্রসিং এবং দুর্ঘটনা দুটিই বাড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, লেভেল ক্রসিংয়ের আশেপাশেও অনেক স্থাপনা হচ্ছে এবং এগুলো ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে লেভেল ক্রসিংয়ে যে বাধাহীন দৃষ্টিসীমা থাকার কথা সেটা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে চালক আসলে সামনে দেখতে পান না যে সেখানে কে আসছে বা যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের লেভেল ক্রসিংগুলো একটা বিরাট হেডেক (চিন্তার বিষয়) এবং অ্যাক্সিডেন্টের একটা হটস্পট এই জায়গাটার মধ্যে।’ অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সমমানের এমন সব দেশের তুলনায়ও বাংলাদেশে এমন দুর্ঘটনার হার বেশি বলে জানান বুয়েটের এই অধ্যাপক।
প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতা: বুয়েটের শিক্ষক ড. শাসসুল হক তিনি বলেন, অন্যদেশগুলো অপারেশন বা বিদ্যমান ব্যবস্থার সর্বোত্তম ও দ্রুত ব্যবহার কিভাবে করা যায় তার ওপর নজর দিলেও বাংলাদেশে উন্নয়নের উপর নজর দেয়া হয়েছে।
হাজার হাজার কোটি টাকা উন্নয়নে খরচ করা হচ্ছে। কিন্তু সম্পদের সর্বোত্তম ও দ্রুত ব্যবহার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জোর দেয়া হচ্ছে না এবং এতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আছে। এক্ষেত্রে রেল বিভাগের যদি ক্ষোভ থাকে যে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে কেন লোকবল নিয়োগ দেয়া হবে সেক্ষেত্রে, সড়ক ও পরিবহনের সাথে জড়িত সব প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে নিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
অবৈধ দখল: ড. শামসুল হক বলেন, ট্রেন একটা আর্টিকুলেটেড জোড়া লাগানো গাড়ি। এটিতে হঠাৎ ব্রেক করা যায় না। কারণ তাহলে যাত্রীদের ঝুঁকিতে ফেলা হয়। এ কারণেই ট্রেনের নীতিমালায় বলা আছে যে, রেল ট্র্যাকের ১০ ফুটের মধ্যে সবসময় ১৪৪ ধারা জারি থাকবে অলিখিতভাবে। কেউ তার আশেপাশে আসতে পারবে না। তবে বাস্তবে এর উল্টোটা দেখা যায়। তিনি বলেন, ‘সবাই রেলের জমিটাকে নিজের জমি মনে করে এই যে অসঙ্গতিপূর্ণ হাট বাজার, বসতি বানিয়ে হ্যাজার্ডটাকে বাড়িয়ে ফেলছেন, সেটা রেল মন্ত্রণালয়ের সরকারের সাথে বসে ঠিক করা উচিত। দুর্ঘটনা রোধ করতে এসব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে এবং সেগুলো যাতে উঠিয়ে দেয়ার পর আবার বসতে না পারে তার জন্য সারা বছর তত্ত্বাবধায়ন করতে হবে। এতে ব্যবহার করতে হবে রেলওয়ে পুলিশকে। তবে এই রেলওয়ে পুলিশে রেলের কাজে নিয়োজিত থাকার কথা থাকলেও তারা আসলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত। ফলে তাদের পরিচালনার খরচ রেল মন্ত্রণালয় থেকে এলেও তাদেরকে দিয়ে কাজ করাতে পারে না রেলওয়ে। এখানে এই জটিলতা এড়াতে রেলওয়ে পুলিশকে রেলমন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত করা উচিত বলেও মত দেন বিশেষজ্ঞরা। সূত্র : বিবিসি