রাজশাহীতে পানির সংকট আরও গভীর আকার ধারণ করছে। ক্রমবর্ধমান হারে দিন দিন এই অ লের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। আর শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট জটিল আকার ধারণ করছে। এতে এ অ লের মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য পানিসহ সেচের পানি নিয়ে দুর্ভোগের মাত্রা আরও বাড়ছে। রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুন্ডুমালা পৌরসভার মাহালিপাড়া গ্রামে পৌরসভা ও স্থানীয় প্রশাসন ৭০০ ফুট পর্যন্ত বোরিং করেও পানির স্তর পায়নি। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারাও। রাজশাহীর বাঘায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। বিশুদ্ধ খাবার পানি নিয়ে মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। উপজেলার বাজুবাঘা গ্রামের গৃহবধূ জায়দা বেগম বলেন, গত দুই সপ্তাহ থেকে বাড়িতে বসানো টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। পাশের বাড়ি থেকে পানি সংগ্রহ করছি।ন উত্তর মিলিক বাঘা গ্রামের নাসির উদ্দীন বলেন, বাড়ির টিউবওয়েলে ১৭০ ফুট পাইপ বসিয়েছি। এরপরেও পানি উঠছে না। বিদ্যুৎচালিত মর্টার বসানো আছে, সেখানেও পানি উঠছে না।
বাঘা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী কে এম নাসির উদ্দীন বলেন, কোথাও কোথাও ৩০ থেকে ৩৫ ফিট পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে পানির সমস্যা দেখা দিয়েছে। সরকারিভাবে বসানো সাবমার্সিবল নলকূপে তেমন কোনও সমস্যা হচ্ছে না। বৃষ্টি না হওয়ায় কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, ধানের শিষ বের হওয়ার সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠলে ধান চিটা হতে পারে। বুধবার (১৯ এপ্রিল) রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় তাপমাত্রা উঠেছে ৩৯ ডিগ্রি। দেখা নেই বৃষ্টিরও। অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আগের বছরগুলোর চেয়ে নিচে নেমে গেছে। ফলে নলকূপে আর আগের মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় ধানে ধরেছে ‘ব্লাস্ট’ রোগ। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা।
বাঘা উপজেলার তেঁথুলিয়া, নওটিকা, ধন্দহ ও অমরপুর এলাকায় এই সমস্যা বেশি দেখা দিয়েছে। কৃষি কর্মকর্তারা ওষুধ নিয়ে এসব এলাকার মাঠে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। তারা এই সময় জমিতে পানি জমিয়ে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু দিনের বেলায় নলকূপে পানি ঠিকমতো উঠছে না। সারা রাত পানি দিয়েও সব জমি ভেজানো যাচ্ছে না। এই সংকটে অনেক কৃষকের জমির ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে।
বাঘা উপজেলার অমরপুর গ্রামের কৃষক নাজমুল হোসেন এবার পাঁচ বিঘা জমিতে ব্রি-২৮, ব্রি-২৯ ও কাটারিভোগ ধানের চাষ করেছেন। এর মধ্যে এক বিঘা জমিতে সবেমাত্র শিষ বের হয়েছে। এমন অবস্থায় ১০ দিন ধরে তার নলকূপে পানি উঠছে না। পাশে একটি পুকুর ছিল। তা থেকেই জমিতে পানি দিচ্ছিলেন। পুকুরে যে পরিমাণ পানি আছে, তাতে আর দুই দিন চলতে পারে। এরই মধ্যে চলছে প্রচ- খরা। এমন অবস্থায় পোকার উপদ্রব দেখা দিয়েছে।
বাঘা উপজেলার নওটিকা গ্রামের চাষি বয়েজুল ইসলাম গ্রামের পশ্চিম মাঠে ১৭ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। সেসব ধানে শিষ বের হচ্ছে, একইসঙ্গে শিষ মারাও যাচ্ছে। বয়েজুল বলেন, দিনের বেলায় তার নলকূপে পানি উঠতে উঠতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাতের বেলায় যা উঠছে, তা গত বছরের চার ভাগের এক ভাগের সমান। এত অল্প পানিতে পুরো জমি ভেজে না। যেটুকু ভিজছে, সূর্যের তাপে তা দিনে শুকিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে পোকার উপদ্রব বেড়েছে।
বাঘা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান জানান, তার কার্যালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ওষুধ কোম্পানির লোকজন ও কৃষকদের নিয়ে তিনি মাঠ পরিদর্শন করছিলেন। ধানের শিষ বের হওয়ার সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির ওপরে উঠলে ধান চিটা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। মাঠে এসে তিনি ৩৯ ডিগ্রি তাপমাত্রা উঠেছে। প্রকৃতির ওপরে আসলে কারও হাত নেই। অনেকের জমিতেই পানি নেই। অথচ এই সময়ে পানি জমিয়ে রাখার প্রয়োজন ছিল। রাজশাহী আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, বুধবার দুপুর ৩টায় রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। এ ছাড়া সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ২৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পারদও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় রাতেও স্বস্তি মিলছে না। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আব্দুস সালাম জানান, অব্যাহতভাবে তাপপ্রবাহ বাড়ছেই। যেভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে সামনে তাপমাত্রার সঠিক সমীকরণ বোঝা যাচ্ছে না। তবে ধারণা করছি, ২০ এপ্রিলের পর বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা কমে আসবে।
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ অ লের ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদের প্রাপ্যতা যাচাই কমিটির সদস্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, প্রতি বছর বরেন্দ্র অ লে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এক ফুট করে নিচে নেমে যায়। পরের বছর তা আর ওঠে না।
অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান আরও বলেন, প্রতি বছরই বরেন্দ্র এলাকার পানির স্তর নিচে নামছে। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ। আবার বৃষ্টি কম হওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারও দায়ী। এই থেকে উত্তরণের পথ হতে পারে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানো। এতে স্থিতিশীল একটা অবস্থা আসতে পারে। কিন্তু যে স্তর নেমে গেছে, তা ওভারকাম করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে গবেষণা করে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই কর্মসূচি দ্রুতই হাতে নেওয়া দরকার।
তিনি বলেন, গত বছর বরেন্দ্র অ লে বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। এ জন্য পানির স্তর দুই ফুট করে নেমে গেছে। এ জন্য বাঘা উপজেলার চাষিরা যে স্তরে আগের বছর পানি পেয়েছেন, সেই স্তরে এবার পানি পাচ্ছেন না। পানি পেতে হলে আরও নিচের স্তরে যেতে হবে। তীব্র এই গরমে রাজশাহী জেলার চারঘাটেও খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সঙ্গে লোডশেডিং বাড়িয়েছে কষ্ট। চারঘাট উপজেলা
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্য বলছে, উপজেলায় গভীর ও অগভীর নলকূপ রয়েছে প্রায় ১৭ হাজার ৫০০টি। জনস্বাস্থ্য অধিদফতর গত তিন বছরে ইউনিয়ন পর্যায়ে গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে ৪৬২টি। এসব নলকূপের জন্য দুটি লেয়ার রয়েছে। প্রথম লেয়ারে পানি উত্তোলনের ক্ষমতা রয়েছে ৮০০ থেকে ৯০০ ফুটের মধ্যে এবং দ্বিতীয় লেয়ারে এক হাজার থেকে ১১০০ ফুটের মধ্যে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মাছ উৎপাদনসহ নানা কাজে খেয়াল-খুশিমতো গভীর নলকূপ স্থাপন করায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে গেছে।
চারঘাট উপজেলা সদরের বাসিন্দা আফরোজা বেগম বলেন, উপজেলা সদরের বাসিন্দা হয়েও এ সময় পানির চরম সংকট। সারাদিন তো পানি ওঠে না। রাতের বেলায়ও পাওয়া যায় না। এ কষ্ট লাঘব যে কবে হবে! আশপাশের বাড়িতে মোটরের পানি এনে খাওয়া-দাওয়া ছাড়াও পরিবারের অন্য কাজ কর্ম করতে হচ্ছে।
চারঘাট উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, ২০০৬ সালের পার থেকে পানির এমন সংকট সৃষ্টি হয়ে আসছে। এখন এটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। নদী, খাল-বিলে পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। নদী, খাল-বিলে পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যায়। অপরিকল্পিত গভীর নলকূপ স্থাপন এবং একসঙ্গে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
একই অবস্থা রাজশাহী জেলার মোহনপুরেও। সেচ ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। মোহনপুর উপজেলা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্পের (বিএমডিএ) সহকারী প্রকৌশলী গোলাম ফারুক বলেন, চলতি মৌসুমে খরা অনেক বেশি। এ জন্য বোরো খেতে ঘন ঘন সেচ দিতে বেগ পেতে হচ্ছে গভীর নলকূপ অপারেটরদের। তবে কয়েকটি গভীর নলকূপের সমস্যা দেখা দেওয়ার পর কারিগরি প্রযুক্তির মাধ্যমে সারানো হয়েছে। পানির স্থিতিশীল স্তর দেবে যাওয়ায় সেচ যন্ত্রসহ বসত বাড়িতে পানির কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে এই সময় রাজশাহীতে বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়েছে। চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুতের সরবরাহ ৩০ শতাংশে নেমে যাচ্ছে। এদিকে চলছে টানা খরা। গত সোমবার তাপমাত্রা উঠেছে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই অবস্থায় লোডশেডিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে বোরো ক্ষেতে জমিতে যেটুকু পানি পড়ছে, তা শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার সব জমিতে পানি পৌঁছানোও যাচ্ছে না। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলায় তাদের বিদ্যুৎ-চালিত ৭২৫টি গভীর নলকূপ রয়েছে। একদিকে খরা, অন্যদিকে বিদ্যুতের এই লোডশেডিংয়ের কারণে ধানের ক্ষতি হচ্ছে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদ বলেন, এখন ধানের শিষ বের হচ্ছে। এই সময়ে বিদ্যুৎ না পেলে ধান বাঁচানো যাবে না।
এই রাজশাহী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) রমেন্দ্র চন্দ্র রায় বলেন, এই সময় বিদ্যুতের চাহিদার ৪৮ শতাংশ পাচ্ছেন। গত রবিবার সন্ধ্যায় চাহিদা উঠেছিল ১০৫ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে পেয়েছেন মাত্র ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ। এ বিষয়ে রাজশাহী থেকে কিছু করার নেই। তাদের যেটুকু দেওয়া হচ্ছে, তারা সেইটুকুর যথাযথ ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। এ জন্য মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন।
তিনি বলেন, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মোহরাপুর মৌজায় বিএমডিএর তিনটি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে মোহরাপুর-১ গভীর নলকূপের আওতার ধান ক্ষেতের অবস্থা বেশি খারাপ। পানির অভাবে খেতের জমির মাটি সাদা হয়ে গেছে। কোনও কোনও জমির মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
মোহরাপুর গ্রামের কৃষক আমজাদ আলী তিন বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। তার জমির মাটি ফেটে গেছে। ধান গাছ নেতিয়ে পড়ছে। একই গ্রামের শামীম ও তার ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন এই নলকূপের আওতায় ছয়-সাত বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। শামীম হোসেন বলেন, এক পাশে এক বিঘা ও আরেক অংশে দেড় বিঘা জমির মাটি ফেটে গেছে। শিষ বের হওয়ার সময় যেমন রোদ পড়ছে, তেমনি বিদ্যুৎ না থাকার কারণে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। পানি দেওয়ার পরপরই জমি শুকিয়ে যাচ্ছে। একই গ্রামের কৃষক শুকুর আলী জানান, তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে ধান করেছেন। পানি দিতে না পারায় জমির ধান মরে যাচ্ছিল। জমি সাদা হয়ে মাটি ফেটে যাচ্ছিল। মোহরাপুর-১ গভীর নলকূপের অপারেটর ফাহারুল ইসলাম বলেন, দিনরাত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬/৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে।