আত্মীয়-স্বজন সমাজবদ্ধ জীবনের অবিচ্ছেদ অংশ। আত্মীয়তার সুসম্পর্ক বন্ধন ছাড়া স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাপন অসম্ভব। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনের প্রতিটি ধাপে আত্মীয়-স্বজনের ভূমিকা সর্বতোভাবে জড়িত। তাই ইসলাম আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষায় জোরালো তাগিদ দিয়েছে। এ লেখায় কোরআন ও হাদিস থেকে আত্মীয়তার অধিকার ও সম্পর্ক রক্ষার কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো।
আত্মীয়তা রক্ষায় কোরআনের নির্দেশনা: পবিত্র কোরআনে মা-বাবার পরে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ইবাদত করো আল্লাহর, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার করো মা-বাবার সঙ্গে, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে, এতিম, মিসকিন, নিকটাত্মীয়-প্রতিবেশী, অনাত্মীয়-প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সঙ্গী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদের, যারা দাম্ভিক, অহংকারী।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩৬)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর নিকটাত্মীয়ের অধিকার রক্ষা করো।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৬)
আত্মীয়তা ছিন্নকারী অভিশপ্ত : আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা খুবই কঠোর।
পবিত্র কোরআনে তাদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাতের কথা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে এরও সম্ভাবনা রয়েছে যে তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে। ওরা তারাই, যাদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করেছেন। (সুরা: মুহাম্মাদ, আয়াত: ২২-২৩)
আত্মীয়তা ছিন্নকারী উভয় জগতে শাস্তিযোগ্য : আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা একটি ইবাদত। যারা এ সম্পর্ক রক্ষা করে চলে না তাদের অন্যান্য আমল-ইবাদত যথার্থ হলেও তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। অভ্যস্ত মদ্যপায়ী, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ও জাদুতে বিশ্বাসী।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৯৫৮৭)
কেবল পরকালীন শাস্তি নয়, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীরা জাগতিক শাস্তিরও সম্মুখীন হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো গুনাহের কারণে যদি আখিরাতের শাস্তির পাশাপাশি দুনিয়াতেও শাস্তি ত্বরান্বিত হয় তবে জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে বেশি উপযুক্ত অন্য কোনো গুনাহ নেই।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২০৩৯৮)
আত্মীয়তায় জীবন ও জীবিকা সমৃদ্ধ হয় : সমৃদ্ধ জীবন ও জীবিকা সবারই প্রত্যাশিত। এ জীবন ও জীবিকার পেছনে আমরা এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি, যার কারণে আত্মীয়দের খোঁজখবর রাখা হয় না। আত্মীয়তা রক্ষা করতে গেলে অর্থ ব্যয় হবে এই ভেবে আমরা অনেকেই দূরে দূরে থাকি। আবার সংসারজীবনের নানা চাপে আমরা আত্মীয়দের ভুলে যাই। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রিজিক (জীবিকা) প্রশস্ত হওয়ার এবং দীর্ঘ জীবনের প্রত্যাশা করে সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ন রাখে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯৮৬)
সম্পর্ক রক্ষায় আন্তরিক ব্যক্তি প্রকৃত আত্মীয় : আত্মীয়তার সম্পর্ক সতেজ রাখতে যোগাযোগের বিকল্প নেই। প্রযুক্তিগত যোগাযোগের সব মাধ্যম থাকা সত্ত্বেও অনেক আত্মীয়ের সঙ্গে কথাবার্তা হয় না বছরের পর বছর। সে খোঁজখবর নিচ্ছে না তাহলে আমি কেন নেব এই চিন্তা থেকেও একে অন্যের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ থাকে দীর্ঘ সময়। সম্পর্ক ছিন্নকারী আত্মীয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আন্তরিক আত্মীয়কে শ্রেষ্ঠ ও প্রকৃত আত্মীয় হিসেবে নবীজি (সা.) স্বীকৃতি দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃত আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী সেই, যে ব্যক্তি তার আত্মীয় তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও সে তা রক্ষা করে চলে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯৯১)
বিপদে পাশে দাঁড়ানো আত্মীয়তার হক : আমরা অনেক সময় অন্য সাধারণ মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার পরিচয় দিয়ে থাকি। কিন্তু সংকটে পড়া নিজ আত্মীয়দের ব্যাপারে উদাসীন থাকি। অসুস্থতায় সেবা শুশ্রূষা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ যেকোনো সংকটে সর্বাগ্রে আত্মীয়দের প্রাধান্য দেওয়া উচিত। সংকটাপন্ন ও অভাবগ্রস্ত আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতার তাগিদ দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো অভাবীকে দান করলে শুধু দানের সওয়াব আর আত্মীয়কে সহযোগিতা করলে দুটি সওয়াব, দান ও আত্মীয়তা রক্ষা।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২৫৮২)
ধর্মীয় বিষয়ে সচেতনতা আত্মীয়তার অধিকার : জাগতিক কল্যাণের পাশাপাশি আত্মীয়দের পরকালীন কল্যাণের ব্যাপারেও আমাদের ভাবতে হবে। তাদের ধর্মীয় বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক করা আত্মীয়তার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা নিজেদের এবং পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করো জাহান্নামের আগুন থেকে, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর।’ (সুরা : তাহরিম, আয়াত : ৬)
আল্লাহ তাআলা আমাদের আত্মীয়তার অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হওয়ার তৌফিক দান করুন।