ইসলাম চির সুন্দরের ধর্ম। সত্য ও সুন্দরের বন্দনা ইসলামের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। মানুষের চিন্তাচেতনা থেকে শুরু করে তার যাপিত জীবনের সব দিকে, সব স্তরে সত্য ও সুন্দরের লালন, পালন ও প্রতিষ্ঠা ইসলামের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। ইসলাম মানুষকে অনুপ্রাণিত করেÍতোমার প্রভু সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। মানবজীবনে সৌন্দর্যের অন্যতম দিক ভাষা। ভাষার মাধ্যমে বিকশিত হয় তার ব্যক্তিত্বের শোভা ও সৌরভ। ব্যক্তির শব্দ ও বাক্য তার রুচি ও বোধের পরিচায়ক। তার চিন্তা ও চেতনার স্ফুরক। তার কথামালা ধারণ করে থাকে তার মন ও মননের রং। তাই ইসলাম মানুষকে নির্দেশ দেয়, পরিশুদ্ধ হও জীবনে, শুদ্ধ করো তোমার শব্দ, বাক্য ও ভাষা। মধুর করো তোমার বাচনভঙ্গি, ভাষার অবয়ব। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই কিছু কথা জাদুময়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫১৪৬)
সব ভাষার মর্যাদা সমান: ইসলামের দৃষ্টিতে পৃথিবীর সব ভাষাই সমমর্যাদার অধিকারী। কোনো ভাষাই অন্য ভাষার ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে ভাষাভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ ভাষার এই সমমর্যাদার জন্যই আল্লাহ তাআলা সব নবীকে তার স্বজাতির ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা নিজ নিজ জাতিকে মাতৃভাষায় আল্লাহর পথে আহ্বান করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি প্রত্যেক রাসুলকে স্বজাতির ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ০৪) আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক নবীকে তার স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২১৪১০)
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘রাসুলরা মাতৃভাষাভাষী হওয়ার কারণ হচ্ছে, যেন তাঁদের জাতি রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য এবং তাঁরা কী নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন তা বুঝতে পারেন।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৪/৪৭৭)
মাতৃভাষায় দক্ষ ছিলেন নবীরা: নবী (আ.) শুধু মাতৃভাষায় ধর্ম প্রচার করেননি; বরং তাঁরা ছিলেন নিজ নিজ ভাষায় পা-িত্যের অধিকারী। সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও আলংকারিক ভাষার কৃতিত্বধারী। রাসুল (সা.) বলেন, আমি আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাষী। একইভাবে পবিত্র কোরআনে মুসা (আ.)-এর ভাষ্যে হারুন (আ.)-এর প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ‘আর আমার ভাই হারুন, সে আমার চেয়ে সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী, তাই তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন, সে আমাকে সমর্থন করবে।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৩৪)
শব্দচয়নে সতর্ক হতে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশনা: রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে যেমন ভাষার প্রতি যতœবান ছিলেন, তেমনি অন্যদেরও যতœবান হয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি কাউকে শব্দের ভুল প্রয়োগ বা ভাষার বিকৃতি করতে দেখলে তা শুধরে দিতেন। একবার এক সাহাবি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘আ-আলিজু’ শব্দটির অর্থ আমি কি প্রবেশ করব? আরবি ভাষায় এই অর্থে ব্যবহৃত হলেও তা অনুমতি প্রার্থনার জন্য যথেষ্ট নয়। তখন রাসুল (সা.) তাঁর দাসীকে বললেন, বাইরে গিয়ে তাকে এ কথা বলতে বলো, ‘আসসালামু আলাইকুম! আ-আদখুলু?’ কারণ সে সুন্দরভাবে অনুমতি প্রার্থনা করেনি। (আল-আদাবুল মুফরাদ) ইমাম মুসলিম (রহ.) তাঁর সহিহ মুসলিমে ‘আল-আলফাজু মিনাল আদাব’ শিরোনামে অধ্যায় এনেছেন। যেখানে উপযুক্ত শব্দচয়ন সম্পর্কে হাদিস আনা হয়েছে। এ অধ্যায়ের হাদিসগুলোয় রাসুল (সা.) ভুল শব্দ প্রয়োগের সংশোধনী এনেছেন এভাবেÍ‘আঙুর’কে ‘কারম’ বলো না, ‘ইনাব’ কিংবা ‘হাবালাহ’ বলো। কাউকে ‘দাস’ না বলে ‘চাকর’ বলো, কারণ সবাই আল্লাহর দাস ও দাসী; মনিবকে ‘প্রভু’ বলো না, ‘সর্দার’ বলো।
এমনকি শত্রুর সঙ্গে বিতর্ক করার সময়ও সুন্দরতম ভাষায় বিতর্ক করার নির্দেশ রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী! আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করুন প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে। আর তাদের সঙ্গে বিতর্ক করুন সর্বোত্তম পন্থায়।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৫)
ভাষা-সাহিত্যের উন্নয়নে কোরআনের অনুপ্রেরণা: ইসলাম মানুষকে তার মাতৃভাষায় বিশুদ্ধতার নির্দেশ দিয়েই থেমে যায়নি। বরং উৎসাহিত করেছে ভাষা ও সাহিত্যে উৎকর্ষ সাধনে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাঁর ভাষার অলংকার ও উপমার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, ‘তুমি কি লক্ষ করো না, আল্লাহ কিভাবে উপমা দিয়ে থাকেন? পবিত্র বাক্য হলো পবিত্র বৃক্ষের মতো। যার মূল সুদৃঢ় এবং শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত। সে তার পালনকর্তার অনুমতিক্রমে প্রতিনিয়ত ফল দান করে। আর আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা বর্ণনা করেন, যাতে তারা শিক্ষা লাভ করে। এবং মন্দ বাক্যের উপমা একটি মন্দ বৃক্ষের মতো। যার মূল ভূপৃষ্ঠ থেকে বিচ্ছিন্ন। যার কোনো স্থায়িত্ব নেই।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ২৪-২৬) এ আয়াতে আল্লাহ মানুষকে উত্তম ও উৎকৃষ্ট ভাষা ব্যবহারে মনোযোগী হতে বলেছেন। এমন অসংখ্য উপমা, উৎপ্রক্ষা ও অলংকার শোভিত কোরআন আরবি ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শনের মর্যাদা দখল করে আছে। কোরআনের ইজাজ বা অপরাজেয় প্রভাব ও শক্তির অন্যতম একটি দিক নিঃসন্দেহে তার ভাষা ও সাহিত্য মান। আল্লামা ইবনে খালদুন (রহ.) তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে হাফিজ জিয়াউদ্দিন ইবনে আসির, শিহাবুদ্দিন হালবিসহ একাধিক প্রাজ্ঞ ও প-িত ব্যক্তির উদ্ধৃতি উল্লেখ করে লেখেনÍ‘নিশ্চয়ই কোরআন পাঠ, তা মুখস্থকরণ এবং তার চর্চা আরবি ভাষা শিক্ষা করা এবং তাতে দক্ষতা অর্জন করার একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। কেননা কোরআনের মাধ্যমে জাহেলি যুগের (যা আরবি সাহিত্যের স্বর্ণযুগ খ্যাত) পদ্য ও গদ্য সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন ধারণা লাভ করা যায়। বরং তা জাহেলি যুগের ভাষা ও সাহিত্যকে পরাজিত করেছে। তা ছাড়া কোরআন সর্বযুগে সব প্রকার বিকৃতিমুক্ত এবং সংরক্ষিত। (তারিখে ইবনে খালদুন)
আধুনিক আরবি সাহিত্যের দিকপাল ড. তোহা হুসাইন কোরআনের বাচনভঙ্গি ও স্টাইল সম্পর্কে বলেন, ‘এতে সন্দেহ নেই, কোরআন আরবি গদ্যের আদি গ্রন্থ। কিন্তু তোমরা এ-ও হয়তো জানো যে কোরআন গদ্য নয়। তদ্রূপ কোরআন কাব্যও নয়। কোরআন কোরআনই। … কোরআন একটি একক পদ্ধতি, অনুপম ও অতুলনীয়। আগেও এমনটি ছিল না এবং পরেও এর তুল্য কিছু হয়নি।’ (ড. তোহা হুসাইন, মিন হাদিসিশ শেরি ওয়ান নাসরি, পৃষ্ঠা. ২৫)
মহানবী (সা.)-এর যুগে কবি ও কবিতার সম্মান: ইসলামী যুগে এমন কিছু কবির নাম খুঁজে পাওয়া যায় যাঁরা ইসলাম আগমনের আগেই প্রচলিত ধারার কবিতা রচনা করে কবি খ্যাতি লাভ করেন। ইসলাম আগমনের পরও তাঁরা কাব্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। তাঁদের মধ্যে কা’ব ইবনে জুহায়র (রা.), হাসসান ইবনে সাবেত (রা.), কা’ব ইবনে মালিক (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) ও আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া প্রাথমিক ইসলামী যুগের কবিদের মধ্যে খ্যাতি অর্জন করেনÍআমর ইবনে মা’দিকারাব, আল হুতয়াহ, আবু লায়লা হাসসান ইবনে কায়সÍযিনি নাবিঘা নামে বেশি পরিচিত ছিলেন এবং আবু জুয়াব আল-হুজলি।
মহানবী (সা.) ইতিবাচক কাব্যচর্চাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন। বর্ণিত আছে, তিনি তাঁর মিম্বারের পাশে প্রাথমিক ইসলামী যুগের প্রধান কবি হাসসান ইবনে সাবিত (রা.)-এর বসার স্থান নির্ধারণ করেন। তিনি মুসলিম কবিদের উৎসাহিত করে বলেন, ‘যারা অস্ত্র হাতে আল্লাহর রাসুলকে সাহায্য করে তাদেরকে নিজ কথা (কবিতা) দ্বারা সাহায্য করতে কে নিষেধ করে?’ (আল্লামা সাইয়েদ মুর্তাজা আস্কারি, আহাদিসু উম্মুল মুমিনা আয়েশা : ৩/২২২) ইসলাম শুধু শব্দ-বাক্য নয়; বরং ভাষার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ কামনা করে। সব ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে চায় তার সর্বোত্তম ব্যবহার। ইসলাম তাই তার অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছে, ‘আর তোমরা মানুষের সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বলো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৮৩)