ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের মধ্যে হজ অন্যতম। প্রতি বছর পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে পবিত্র নগরী মক্কা ও মদীনায় গমন করেন হাজীরা। আগামী ১৪ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে ‘হজ ফ্লাইট’। সৌদি আরবে একটি দীর্ঘ সফরে গিয়ে ইসলামের অন্যতম ফরজ বিধান পবিত্র হজ আদায় করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই এই সফর কষ্টের। এখানে স্বীকার করতে হয় শারীরিক ও আর্থিক ত্যাগ। তবে বান্দা যখন আল্লাহর মহব্বতের টানে হজের সফরের কষ্ট স্বীকার করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন আল্লাহ সবকিছু সহজ করে দেন। হজযাত্রী ভাই-বোনদের জন্য হজের বিস্তারিত করণীয়-বর্জনীয় তুলে ধরা হল।
হজের প্রস্তুতি: হজ সফর শুরুর আগে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে ওষুধ ও প্রয়োজনীয় সামানপত্র সঙ্গে নিন। বাংলাদেশ ছাড়ার আগেই হজের প্রশিক্ষণ নিয়ে নিন। মনে রাখবেন, অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হওয়াই ভালো। নিজের ওপর আস্থাশীল হয়ে হজ পালন করুন। কেননা আপনি যার ওপর নির্ভরশীল হয়ে হজে যাচ্ছেন তিনি কোনো কারণে হজে না-ও যেতে পারেন বা উপস্থিত সময়ে আপনার থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারেন, তাই নিজের ওপর আস্থা রাখুন। হজের কাজগুলো আদায়ের পদ্ধতি জেনে নিজেই পালন করার দৃঢ় সংকল্প করুন। হজের মানসিক প্রস্তুতিতে কয়েকটি বিষয় অবশ্যই ভুলবেন না। যথা ১. অন্তরে সর্বদা আল্লাহর মহব্বত। ২. কষ্টে ধৈর্য ধারণ। ৩. জবানের হেফাজত। ৪. সব আহকাম একাকী করার হিম্মত এবং ৫. নিজেকে গোনাহমুক্ত রাখার প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি।
বিমানবন্দরে করণীয়: নির্দিষ্ট সময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছান। লাগেজে যে মাল দেবেন, তা ঠিকমতো বাঁধা হয়েছে কি না, দেখে নিন। বিমানের কাউন্টারে মাল রাখার পর এর টোকেন যতœ করে রাখুন। ইমিগ্রেশন, চেকিংয়ের পর আপনার মালপত্র যতেœ রাখুন। বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র, বিমানের টিকিট, টিকা দেওয়ার কার্ড, অন্য কাগজপত্র, টাকা, বিমানে পড়ার জন্য ধর্মীয় বই ইত্যাদি গলায় ঝুলানোর ব্যাগে সংরক্ষণ করুন। সময়মতো বিমানে উঠে নির্ধারিত আসনে বসুন।
ইহরাম বাঁধা: আপনার গন্তব্য ঢাকা থেকে মক্কায় নাকি মদিনায়, জেনে নিন। মদিনায় হলে এখন ইহরাম বাঁধা নয়; যখন মদিনা থেকে মক্কায় যাবেন, তখন ইহরাম বাঁধতে হবে। বেশিরভাগ হজযাত্রী আগে মক্কায় যান। আপনার গন্তব্য সরাসরি মক্কায় হলে ঢাকা থেকে বিমানে ওঠার আগে ইহরাম বাঁধা ভালো। কারণ জেদ্দা পৌঁছানোর আগেই ইয়ালামলাম মিকাত বা ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থান। বিমানে যদিও ইহরাম বাঁধার কথা বলা হয়; কিন্তু ওই সময় অনেকে ঘুমিয়ে থাকেন। তা ছাড়া বিমানে পোশাক পরিবর্তন করাটাও দৃষ্টিকটু। ইহরাম না বেঁধেই মিকাত পার হলে এজন্য দম (আলাদা কোরবানি) দিতে হবে এবং গোনাহ হবে।
উল্লেখ্য, ইহরামের সময় মূল বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে আপনি কি হজে তামাত্তু করবেন নাকি কিরান না ইফরাদ। বাংলাদেশ থেকে যারা যান, তারা সাধারণত তামাত্তু তথা প্রথমে ওমরা, তারপর হজ করেন। আপনিও যদি ইফরাদ বা কিরান না করে তামাত্তু হজ করতে চান, তাহলে আপনাকে ইহরাম বাঁধতে হবে ওমরার। ওমরা পালনের পর ৮ জিলহজ মক্কার হারাম শরিফ থেকে যে ইহরাম করবেন সেটিই আপনার হজের ইহরাম। ইহরাম হলো পুরুষ বা মহিলা হজ বা ওমরার নিয়ত করে কমপক্ষে একবার তালবিয়া পড়া। তিনবার পড়া উত্তম। অনেকে শুধু ইহরামের কাপড় পরিধান করাকেই ইহরাম মনে করে থাকে। এটা ভুল। তালবিয়া হলো ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়াননিমাতা লাকা ওয়াল-মুলক, লা-শারিকা লাক।’
ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ: ১. পুরুষের জন্য সেলাইযুক্ত যে-কোনো কাপড় ব্যবহার নিষিদ্ধ। পায়ে ফিতাযুুক্ত স্যান্ডেল ব্যবহার করতে হবে। পায়ের পাতা ঢাকে এমন কোনো জুতা বা স্যান্ডেল পরা যাবে না। মহিলারা স্বাভাবিক কাপড় ও জুতা মোজা পরবে।
২. পুরুষরা মাথা ও মুখমন্ডল ইহরামের কাপড়সহ যে-কোনো কাপড় বা টুপি দ্বারা ঢাকতে পারবে না। মহিলারা মাথা ঢেকে রাখবে আর মুখমন্ডল খোলা রাখবে। ৩. চুল কাটা বা ছিঁড়ে ফেলা। ৪. নখ কাটা। ৫. ঘ্রাণযুক্ত তেল বা আতর ব্যবহার। ৬. স্ত্রী মিলন করা। ৭. যৌন উত্তেজনামূলক কোনো আচরণ বা কথা বলা। ৮. শিকার করা। ৯. ঝগড়া-বিবাদ করা। ১০. চুল ও দাড়িতে চিরুনি বা আঙ্গুল চালানো (কারণ তাতে চুল বা দাড়ি ছেঁড়ার আশঙ্কা থাকে)। ১১. শরীরে সাবান লাগানো প্রভৃতি নিষেধ। ১২. উকুন, ছারপোকা, মশা ও মাছিসহ কোনো জীবজন্তু হত্যা করা বা মারা নাজায়েজ। ১৩. কোনো গোনাহের কাজ করা ইত্যাদিও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে শামিল।
জেদ্দা বিমানবন্দর: মুয়াল্লিমের গাড়ি আপনার জন্য জেদ্দা হজ টার্মিনালে অপেক্ষা করবে। সেখান থেকে তারা আপনাকে মক্কায় যে বাড়িতে থাকবেন, সেখানে নামিয়ে দেবেন। মুয়াল্লিমের নম্বর (আরবি+ইংরেজিতে লেখা) হ্যান্ড বেল্ট দেওয়া হবে, তা হাতে পরে নেবেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র (যাতে পিলগ্রিম নম্বর, আপনার নাম, ট্রাভেল এজেন্সির নাম ইত্যাদি থাকবে) গলায় ঝুলাবেন। জেদ্দা থেকে মক্কায় পৌঁছাতে ২ বা ৩ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। কখনও আরও বেশিও লাগতে পারে। চলার পথে তালবিয়া পড়ুন (লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইকৃ)।
মক্কায় পৌঁছে: মক্কায় পৌঁছে আপনার থাকার জায়গায় মালপত্র রেখে ক্লান্ত থাকলে আরাম করুন। নামাজের ওয়াক্ত হলে আদায় করে নিন। এরপর কাফেলার বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যান। মসজিদুল হারাম অর্থাৎ কাবা শরিফে অনেক প্রবেশপথ আছে। প্রতিটি প্রবেশপথে আরবি ও ইংরেজিতে ১, ২, ৩ নম্বর ও প্রবেশপথের নাম লেখা আছে। ১ নম্বর তথা ‘বাদশা আবদুল আজিজ’ গেট দিয়ে প্রবেশ করুন। আগে থেকেই ঠিক করুন, কোন প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকবেন বা বের হবেন।
আপনার সফরসঙ্গীকেও জায়গা চিনিয়ে দিন। হারিয়ে গেলে নির্দিষ্ট নম্বরের গেটের সামনে থাকবেন। এতে ভেতরের ভিড়ে হারিয়ে গেলেও নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে সঙ্গীকে খুঁজে পাবেন। কাবা শরিফে স্যান্ডেল-জুতা রাখার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকুন। নির্দিষ্ট স্থানে জুতা রাখুন অথবা আলাদা ব্যাগে করে জুতা বগলের নিচে রাখুন। সফরের শুরু থেকে প্রতিটি পর্যায়ে সঙ্গীদের সম্মান করুন। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন। গ্রুপের দুর্বল-বয়স্কদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখুন।
ওমরার ফরজ ও ওয়াজিব: মিকাত থেকে ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা, সাফা-মারওয়া সাঈ করা এবং মাথার চুল ফেলে দেওয়া বা ছোট করাকে ওমরা বলে। ওমরার ফরজ দুটি। যথা ১. ইহরাম বাঁধা। ২. তাওয়াফ করা। ওমরার ওয়াজিবও দুটি। যথা ১. সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে সাতবার সাঈ করা। ২. মাথার চুল মুড়ানো বা ছাঁটা।
হজের ফরজ ও ওয়াজিব: হজের ফরজ আমল তিনটি। যথা ১. ইহরাম বাঁধা। ২. আরাফার ময়দানে অবস্থান করা। ৩. তাওয়াফে জিয়ারত করা। ছয়টি আমল ওয়াজিব। যথা১. সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে সাতবার সাঈ করা। ২. জিলহজের ১০ তারিখ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্য হলেও মুজদালিফায় অবস্থান করা। ৩. মিনায় জামারাত বা শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা। ৪. তামাত্তু ও কিরান হজ পালনকারীদের ক্ষেত্রে হজের কোরবানি করা। ৫. ইহরাম ত্যাগের আগে মাথার চুল মুড়ানো বা ছাঁটা। ৬. পবিত্র মক্কার বাইরের লোকদের জন্য মক্কা থেকে বিদায়কালীন তাওয়াফ করা। এর বাইরেও হজের আরও বিভিন্ন আমল রয়েছে, সেগুলো সুন্নত অথবা মুস্তাহাব।
হজ তিন প্রকার : তামাত্তু : মিকাত অতিক্রমের আগে শুধু ওমরার নিয়তে ইহরাম বেঁধে ওমরার আমল সম্পন্ন করে চুল কেটে ইহরামমুক্ত হওয়া। অতঃপর একই সফরে হজের আগ মুহূর্তে হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে হজ কার্য সম্পন্ন করা। তামাত্তু হজ পালনকারীর জন্য দমে-শোকর বা হজের কোরবানি করা ওয়াজিব।
ইফরাদ : মিকাত অতিক্রমের আগে শুধু হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে সেই ইহরামে হজ সম্পন্ন করা। ইফরাদ হজ পালনকারীর জন্য হজের কোরবানি করা মুস্তাহাব।
কিরান : মিকাত অতিক্রমের আগে একই সঙ্গে ওমরা ও হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে ওই একই ইহরামে ওমরা ও হজ করা। কিরান হজ পালনকারী মাঝখানে ওমরার পর ইহরাম খুলতে পারবেন না। কিরান হজ পালনকারীর জন্যও হজের কোরবানি করা ওয়াজিব।
তামাত্তু হজের ১৪ আমল: ১. প্রথমে ওমরার ইহরাম বাঁধা। ২. মক্কায় গিয়েই ওমরার তাওয়াফ করা। ৩. ওমরার তাওয়াফের পরই এর সাঈ করা। ৪. সাঈর পর মাথা মুড়ানো। ৫. জিলহজের ৭/৮ তারিখ হজের জন্য ইহরাম বাঁধা। ৬. জিলহজের ৯ তারিখ আরাফায় অবস্থান করা। ৭. ১০ থেকে ১২ জিলহজের মধ্যে তাওয়াফে জিয়ারত করা। ৮. জিলহজের ১০ তারিখ বড় শয়তানকে সাতটি পাথর মারা। ৯. কোরবানি করা (পাথর মেরে মাথা মুড়ানোর আগে)। ১০. মাথা মুড়ানো। ১১. নফল তাওয়াফ বা তাওয়াফে জিয়ারতের সঙ্গে হজের সাঈ করা। ১২. জিলহজের ১১ তারিখ তিন শয়তানকে (প্রথমে ছোট তারপর মেজ ও শেষে বড়) সাতটি করে মোট ২১টি পাথর মারা। ১৩. পরের দিন ১২ তারিখ অনুরূপ তিন শয়তানকে সাতটি করে মোট ২১টি পাথর মারা। সব মিলিয়ে তিন দিনে ৭+২১+২১=৪৯টি পাথর নিক্ষেপ করা। ১৪. পবিত্র মক্কার বাইরের লোকজন মক্কা থেকে বিদায়ের সময় তাওয়াফ করা।
ইফরাদ হজের ১১ আমল: ১. হজের ইহরাম বাঁধা। ২. তাওয়াফে কুদুম অর্থাৎ মক্কায় গিয়ে প্রথমেই তাওয়াফ করা। ৩. জিলহজের ৯ তারিখ আরাফায় অবস্থান করা। ৪. ১০ থেকে ১২ জিলহজের মধ্যে তাওয়াফে জিয়ারত করা। ৫. ১০ জিলহজ মুজদালিফায় অবস্থান করা। ৬. জিলহজের ১০ তারিখ বড় শয়তানকে (জামারা আকাবায়) সাতটি পাথর মারা। ৭. মাথা মুড়ানো। ৮. তাওয়াফে কুদুম বা তাওয়াফে জিয়ারতের সঙ্গে সাঈ করা। ৯. জিলহজের ১১ তারিখ তিন শয়তানকে (প্রথমে ছোট তারপর মেজ ও শেষে বড়) সাতটি করে মোট ২১টি পাথর মারা। ১০. পরের দিন ১২ তারিখ অনুরূপ তিন শয়তানকে সাতটি করে মোট ২১টি পাথর মারা। সব মিলিয়ে তিন দিনে ৭+২১+২১=৪৯টি পাথর নিক্ষেপ করা। ১১. বিদায়ী তাওয়াফ করা।
কিরান হজের ১৪ আমল: ১. হজ ও ওমরার একত্রে ইহরাম বাঁধা। ২. ওমরার তাওয়াফ করা। ৩. ওমরার সাঈ করা। ৪. তাওয়াফে কুদুম করা। ৫. জিলহজের ৯ তারিখ আরাফায় অবস্থান করা। ৬. ১০ থেকে ১২ জিলহজের মধ্যে তাওয়াফে জিয়ারত করা। ৭. ১০ জিলহজ মুজদালিফায় অবস্থান করা। ৮. জিলহজের ১০ তারিখ বড় শয়তানকে (জামারাতে আকাবায়) সাতটি পাথর মারা। ৯. হজের কোরবানি করা (পাথর মেরে মাথা মু-ানোর আগে)। ১০. মাথা মু-ানো। ১১. হজের সাঈ করা। ১২. জিলহজের ১১ তারিখ তিন শয়তানকে (প্রথমে ছোট তারপর মেজ ও শেষে বড়) সাতটি করে মোট ২১টি পাথর মারা। ১৩. পরের দিন ১২ তারিখ অনুরূপ তিন শয়তানকে সাতটি করে মোট ২১টি পাথর মারা। সব মিলিয়ে তিন দিনে ৭+২১+২১=৪৯টি পাথর নিক্ষেপ করা। ১৪. বিদায়ী তাওয়াফ করা। বাংলাদেশ থেকে যারা যান তারা সাধারণত কেরান হজ করেন না। বরং তারা তামাত্তু হজ করেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার পর ওমরা পালন করে স্বাভাবিক কাপড় পরেন বা স্বাভাবিক হয়ে যান। ৮ জিলহজ নতুন করে ইহরাম বেঁধে মিনা ও আরাফাতে মূল হজের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
মিনার উদ্দেশে যাত্রা: তিন প্রকার হজের আমল ৫ দিনে মৌলিকভাবে একই। প্রথম দিন ৮ জিলহজ ইহরাম অবস্থায় মক্কা থেকে মিনায় রওনা করতে হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করা সুন্নত। জোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ৯ তারিখ ফজর মিলিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ।
আরাফায় অবস্থান: দ্বিতীয় দিন ৯ জিলহজ আরাফায় অবস্থান ফরজ। ফজরের নামাজ মিনায় পড়ে আরাফার ময়দানের দিকে রওনা করতে হয়। প্রয়োজনে ফজরের আগে রাতেও আরাফার উদ্দেশে রওনা হওয়া যায়। সেখানে সূর্য হেলার পর অর্থাৎ ১২টার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করতে হবে। ওয়াক্ত মতো তাঁবুতে বা আরাফার ময়দানে (মসজিদে নামিরায় না গেলে) যে-কোনো স্থানে জোহর ও আসরের নামাজ নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করুন। উল্লেখ্য, আরাফার ময়দানে মসজিদে নামিরায় জোহর ও আসরের জামাত এক আজান, দুই ইকামতে একত্রে পরপর আদায় করা হয়।
মুজদালিফায় অবস্থান: সূর্যাস্তের পর সঙ্গে সঙ্গে মাগরিব নামাজ না পড়ে মুজদালিফায় রওনা করতে হবে। সেখানে মাগরিব ও এশার নামাজ এক আজান, এক ইকামতে একত্রে আদায় করা ওয়াজিব। জামাতে পড়া উত্তম। মুজদালিফায় অবস্থানের সময় কমপক্ষে ৪৯টি খুব ছোট আকারের কঙ্কর সংগ্রহ করে নিন। কারণ ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ (৪৯টি পাথর) তিন শয়তানকে মারতে হবে। মিস হওয়ার আশঙ্কায় কয়েকটি পাথর বেশি নিয়ে নেওয়া ভালো।
শয়তানকে পাথর মারা ও কোরবানি: তৃতীয় দিন ১০ জিলহজে বড় শয়তানকে পাথর মারা, কোরবানি করা, মাথা মুড়ানো ও তাওয়াফে জিয়ারাত করা হজের মৌলিক বিধান। আরাফায় অবস্থানের (৯ জিলহজ) রাতে মুজদালিফায় ফজরের নামাজ পড়ে সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত অবস্থান করা ওয়াজিব। সূর্যোদয়ের পরপর মিনায় পৌঁছে বড় শয়তানকে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। বড় শয়তানকে পাথর মারার পর তামাত্তু ও কিরান হজকারীদের কোরবানি করা ওয়াজিব। এরপর মাথা মুড়িয়ে ইহরাম খুলে হালাল হয়ে স্বাভাবিক পোশাক পরিধান করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোরবানির আগে ইহরাম খোলা যাবে না। ইফরাদ হজকারীর কোরবানি না করলেও চলবে।
তাওয়াফে জিয়ারত : তাওয়াফে জিয়ারত হজের তিনটি ফরজের অন্যতম। মক্কায় গিয়ে এ দিনেই তাওয়াফে জিয়ারত করা সবচেয়ে উত্তম। তাওয়াফে জিয়ারতের পর হজের সাঈ করতে হবে। সাঈ শেষে মিনায় গিয়ে রাতযাপন করা সুন্নত।
মিনায় রাতযাপন: ১০ তারিখে কোরবানি, চুল ছাঁটা ও তাওয়াফে জিয়ারত না করে থাকলে ১১ জিলহজ তা সম্পন্ন করুন। সূর্য হেলার পর থেকে মিনায় তিন শয়তানকে ২১টি পাথর মারা ওয়াজিব। মিনায় রাতযাপন সুন্নত। ১২ জিলহজ তাওয়াফে জিয়ারত আগের দু-দিন না করে থাকলে আজ সূর্যাস্তের আগে অবশ্যই করতে হবে। মিনায় সূর্য হেলার পর থেকে সূর্যাস্তের আগে ২১টি পাথর শয়তানকে মেরে সূর্যাস্তের আগেই মক্কায় রওনার চেষ্টা করুন। উল্লেখ্য, ১১ বা ১২ তারিখ সূর্য হেলার পরই পাথর মারার চেষ্টা করুন।
তাওয়াফ করবেন যেভাবে: তাওয়াফ শুরুর আগে তাওয়াফের সাত চক্কর গণনার সুবিধার্থে সাত দানার তসবি সঙ্গে রাখুন। প্রতি চক্কর শেষ হলে একটি করে তসবির দানা টানুন। যে তাওয়াফের পরে সাঈ আছে সে তাওয়াফে আপনার চাদরের ডান অংশকে ডান বগলের নিচ দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধের ওপর রেখে নিন। এরূপ করাকে ‘ইজতেবা’ বলে। পূর্ণ তাওয়াফেই এরূপ রাখতে হবে। অবশ্য প্রথম তিন চক্কর বীরত্ব প্রকাশক দৌড়ের ভঙ্গিতে হাঁটতে হবে। একে রমল বলে। তাওয়াফ শুরুর জন্য কাবা শরিফের দিকে ফিরে এমনভাবে দাঁড়ান যেন হাজরে আসওয়াদ আপনার সম্মুখে বাম পার্শ্বে থাকে। এ পর্যন্ত যে তালবিয়া পড়ে এসেছেন, তা বন্ধ করে দিন। পুরো তাওয়াফে কোরআন-সুন্নাহে বর্ণিত আরবি দোয়াগুলো বেশি বেশি পড়ুন। মাতৃভাষাতেও নিজের মতো করে প্রাণ খুলে প্রার্থনা করুন।
হাজরে আসওয়াদে চুমু: তারপর সম্ভব হলে হাজরে আসওয়াদকে চুমু খান বা হাতে স্পর্শ করে হাতে চুমু খাবেন নতুবা বুক বরাবর দুই হাত উঠিয়ে দুই হাতের তালু দিয়ে হাজরে আসওয়াদের প্রতি ইশারা করুন। তারপর পা দুটো স্বস্থানে রেখে ডান দিকে কিছুটা ঘুরে যান। এতে কাবা শরিফ আপনার বাম দিকে হয়ে যাবে। তাওয়াফ হাতিমের বাইরে দিয়ে করুন। তাওয়াফ করা অবস্থায় যে-কোনো দোয়া করতে পারেন। এ সময় দোয়া কবুলের সুসংবাদ রয়েছে। যখন রুকনে ইয়ামানি তথা হাজরে আসওয়াদের আগের কোণে পৌঁছবেন, তখন সেই কোণে চুমু খাবেন না, হাত উঠাবেন না। সম্ভব হলে দুই হাতে কিংবা ডান হাতে শুধু স্পর্শ করতে পারেন, হাতে স্পর্শ করতে না পারলে দূর থেকে ইশারাও করবেন না।
তাওয়াফের সময় দোয়া: এখান থেকে ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আজাবান্নার’ পড়তে পড়তে হাজরে আসওয়াদ বরাবর পৌঁছলে এক চক্কর পূর্ণ হয়ে গেল। এখন দ্বিতীয় চক্কর শুরু। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে দুই পা যথাস্থানে সামনের দিকে ফেরানো অবস্থায় রেখে শুধু চেহারা ও বুক যতটুকু ফেরাতে হয়, ততটুকু কাবা শরিফের দিকে করে সম্ভব হলে আবার হাজরে আসওয়াদ চুমু খাবেন। অথবা হাতে স্পর্শ করে হাতে চুমু খাবেন। নতুবা বুক বরাবর দুই হাত উঁচিয়ে দুই তালু দিয়ে ইশারা করুন ও হাতের তালুতে চুমো খান। অতঃপর আগের মতো রমল করা অবস্থায় রুকনে ইয়ামানিকে দুই হাতে অথবা শুধু ডান হাতে স্পর্শ করে না হয় এমনিতেই ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাৃ’ পড়তে পড়তে হাজরে আসওয়াদ বরাবর পৌঁছলে দ্বিতীয় চক্কর পূর্ণ হয়ে গেল। ওই নিয়মে তৃতীয় চক্কর পূর্ণ করে নিন। যখন চতুর্থ চক্কর শুরু করবেন, তখন রমল বন্ধ করে দিন এবং রমল ছাড়া স্বাভাবিক গতিতে চার চক্কর করে সাত চক্কর পূর্ণ করে নিন। সাত চক্কর শেষ হওয়ার পর হাজরে আসওয়াদে আবার তথা অষ্টমবার চুমু খেয়ে কিংবা আগের মতো হাতে স্পর্শ করে নতুবা তালুদ্বয়ের দ্বারা ইশারা করে তাওয়াফ কার্য শেষ করে নিন। এখন চাদরের ইজতেবা খুলে ডান কাঁধ ঢেকে নিন। (মহিলারা ইজতেবা ও রমল করবেন না)।
তাওয়াফের নামাজ: অতঃপর মাকামে ইবরাহিমের পেছনে কিংবা তা সম্ভব না হলে মসজিদে হারামের যে-কোনো স্থানে দুই রাকাত নামাজ সালাতুত তাওয়াফের নিয়তে আদায় করুন। তারপর জমজমের পানি কাবা শরিফের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়ে পান করুন। (যে তাওয়াফের পরে সাঈ নেই সেই তাওয়াফে পুরুষের জন্যও ইজতেবা ও রমল নেই)।
সাঈ করবেন যেভাবে: জমজম থেকে রওনা হয়ে সাঈর জন্য সাফা পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হোন। পাহাড়ের চিহ্নস্বরূপ উঁচু জায়গা রয়েছে। এখানে উঠলে কাবা শরিফ আপনার নজরে আসবে। এখন কাবা শরিফের দিকে মুখ করে স্বাভাবিকভাবে দোয়া করার সময় যেরূপ হাত উঠানো হয় সেরূপ হাত উঠিয়ে তিনবার ‘আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে অন্তরের আবেগ অনুযায়ী দোয়া করুন। দোয়া শেষ করে স্বাভাবিক গতিতে মারওয়া পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হোন। এ সময় আপনার সামনে সবুজ বাতি দেখতে পারবেন। সবুজ বাতির একটু আগে থেকেই ‘রাব্বিগফির ওয়ারহাম আনতাল আআযযুল আকরাম’ পড়তে পড়তে পরবর্তী সবুজ বাতির পর পর্যন্ত দ্রুতগতিতে চলুন। এরপর স্বাভাবিক গতিতে চলতে চলতে মারওয়া পাহাড়ের সামান্য উঁচুতে উঠে কাবা শরিফের দিকে ফিরে থেমে যান যদিও কাবা শরিফ নজরে পড়ে না। এখানে কাবামুখী হয়ে সাফা পাহাড়ের অনুরূপ উভয় হাত উঠিয়ে তিনবার ‘আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে দোয়া করুন।
মদিনা মোনাওয়ারায় হাজেরি: হজ সফরে হজের আগে বা পরে মদিনা মোনাওয়ারায় নবীজির রওজা মোবারক জিয়ারত ও মসজিদে নববিতে নামাজ আদায়ের দুর্লভ সুযোগ পরম ভক্তি সহকারে কাজে লাগান। মক্কা শরিফের মতো মদিনা মোনাওয়ারায় ইসলামের ইতিহাসের নিদর্শনগুলো আমাদের ঈমানকে উজ্জীবিত করবে। নবী করিম (সা.) এর রওজা মোবারক ও মসজিদে নববির মিম্বারের মাঝখানের অংশটুকু ‘রিয়াজুল জান্নাহ’ বা বেহেশতের বাগান। পরম ভক্তি নিয়ে রিয়াজুল জান্নায় নামাজ, তেলাওয়াত, দরুদ শরিফ পাঠের সৌভাগ্য লাভের চেষ্টা করুন।
পরিশেষে: হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধান পালন করতে পারা নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। এ নেয়ামত সবার ভাগ্যে জুটে না। আমরা যারা এ নিয়ামতের ভাগিদার হতে পেরেছি আমাদের উচিত হবে হজের পুরো সময়টা রুটিন করে আমলের মধ্য দিয়ে কাজে লাগানো। বিশেষ করে মিনা, আরাফা ও মুজদালিফার দিনগুলো। অনেকে অন্যের দেখাদেখি আমল করে, এমনটা না করে হক্কানি কোনো আলেম বা হক্কানি আলেমের লেখা হজসংক্রান্ত বই থেকে জেনে আমল করা উচিত। পূর্ণ সফর, বিশেষ করে চলতি পথে কোনো নামাজ যেন কাজা না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা। জানা থাকা উচিত হজ কবুলের অন্যতম আলামত হলো হজপরবর্তী জীবনে ধর্মীয় বিষয়ে উন্নতি সাধন করা। আল্লাহ আমাদের সবার হজকে কবুল করুন। সূত্রঃ আলোকিত বাংলাদেশ।