কেউ পার পাবে না, পৃথিবীতে অন্যায় করে কেউ পার পায় না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। এ সময় রিজভী বলেন, অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে নরক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ভয়াবহ তা-ব আর তামাশার নাটক শুরু করেছে। পত্র-পত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক ও সোস্যাল মিডিয়ায় নানা রকম গুজব ছড়িয়ে গণমানুষকে বিভ্রান্ত করতে মাঠে নামানো হয়েছে সরকারের ‘পেইড বাহিনী’।
তিনি বলেন, দেশে দুর্বার গণআন্দোলনে উত্তাল রাজপথ আর বিদেশে রেড সিগন্যালের এই পরিস্থিতিতে ভোট ডাকাত সরকার পুরোপুরি বেপরোয়া-উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। বন্দুকের নলের শাসন শুরু করেছে। সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর গুন্ডাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে মরিয়া আক্রমণ চালাচ্ছে। কেবল গায়েবি মামলা, হয়রানি-হামলা-মারপিট-ভাঙচুর-লুটপাটই নয়, এমনকি কুপিয়ে ও গুলিবর্ষণ করেও হত্যা ও পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে দেশের মানুষকে। মিছিল দেখলেই আতংকে গুলি চালানো হচ্ছে নির্বিচারে। আমাদের নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে থাকতে দেয়া হচ্ছে না। গায়েবি মামলায় গণগ্রেফতার করা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুতের লোডশেডিং, সর্বগ্রাসী দুর্নীতির ছোবলে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অর্ধাহারে অনাহারে কাটছে মানুষের জীবন। ডলার সংকটে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রফতানি। এদিকে সরকার প্রধানকে নিয়ে রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়কের একটি ‘স্লিপ অব টাং’ নিয়ে আওয়ামী লীগ উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটি অবনতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। পত্রিকায় দেখলাম চট্টগ্রামে সোমবার প্রকাশ্যে পিস্তল হাতে নিয়ে মিছিল করেছেন চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের বিনা ভোটের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। উগ্রবাদী কায়দায় প্রকাশ্যে পিস্তল হাতে মিছিলের অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার হতে চললেও পুলিশ এখনো “পিস্তল মুস্তাফিজকে” গ্রেফতার করেনি। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা পর্যন্ত হয়নি। এটি একটি ভয়ঙ্কর আলামত।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা প্রকাশ্যেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কখনো পরোক্ষভাবে, কখনো সরাসরি হত্যার হুমকি দিয়েছেন। গত বছরের ১৮ মে এক আলোচনা সভায় শেখ হাসিনা পদ্মা নদীতে টুস করে ফেলে দিয়ে হত্যা করার হুমকি দেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে পদ্মা সেতু থেকে পানিতে ফেলে চুবিয়ে মারার হুমকি দিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, দেশের জনগণ ভুলে যায়নি, ”একটার বদলে ১০টা লাশ” ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর সারাদেশের আওয়ামী সন্ত্রাসীদের লগি বৈঠাসহ রাজধানীতে জড়ো করেছিলেন শেখ হাসিনা। রাজধানীসহ সারাদেশে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সেদিন কয়েক ডজন মানুষকে নির্মমভাবে খুন করে। এই লগী-বৈঠা ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন সরকার প্রধান। প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে তরতাজা তরুণদের পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ নির্মম হত্যাকা- ও পাশবিকতায় কেঁদেছে বাংলাদেশ, কেঁদেছে বিশ্বমানবতা। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব থেকে শুরু করে সারাবিশ্বে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। শুধু হত্যাই নয়, মৃত লাশের উপর নৃত্য করার দৃশ্যও প্রত্যক্ষ করে বিশ্ববাসী। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশ বানচাল করতে নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় অফিসে নারকীয় তা-ব ও আমাদের শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের একদিন পরে গত ৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক যৌথসভায় শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হাত ভেঙ্গে দেয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘সারাদেশে দলের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে মাঠে সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। যে হাত দিয়ে মারতে আসবে, সে হাত ভেঙে দিতে হবে। যে হাত দিয়ে আগুন দিতে আসবে, সে হাত দিয়ে তাদের পোড়াতে হবে। ওদের কিসের ক্ষমা ? বসে বসে আর মার খাওয়া যাবে না।’
বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, ইতিহাস সাক্ষী, অবৈধ সরকার প্রধান বাংলাদেশে সকল সন্ত্রাসের উস্কানিদাতা, হুকুমদাতা। ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে হুমকি দিয়ে কী বলেছিলেন সেটি আমি বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে চাই। তাহলে দেখা যাবে আওয়ামী নেতাদের সন্ত্রাসী চরিত্র পাল্টায়নি। উগ্রতা, নির্মমতা ও হিংস্রতা হচ্ছে আওয়ামী লীগের ‘ভূষণ’।
‘সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র’ এই নামে শেখ হাসিনার লেখা একটি বইয়ে তিনি বলেছেন, ‘সেনা ছাউনিতে বসে বন্দুকের নল চেপে পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে জনগণের ভোট কেড়ে নেবে আমরা তা মেনে নেব না। আমরা তা হতে দেব না। পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনীকে বলতে চাই-আপনারা জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না। জনগণের বিরুদ্ধে বন্দুক তুলে ধরবেন না। বাংলার জনগণ তাহলে আপনাদের রেহাই দেবে না। সাথে সাথে বলতে চাই, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের পরিবার পরিজন পাকিস্তানে রেখে এসেছিল। কিন্তু আজকের পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনীর আত্মীয়স্বজনরা বাংলার গ্রামে-গঞ্জে বাস করে। এদের আত্মীয়স্বজনদের ঠিকানা খুঁজে বের করুন, সতর্ক করে দিন। হুঁশিয়ার করে দিন। আর যদি এদেশের মানুষের বুকের ওপর গুলি চালানো হয়, আর যদি এদেশের মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়, আপনাদের প্রতি আমার আহ্বান- প্রতিশোধ নেবেন। লাশের পরিবর্তে লাশ চাই। আমি এই নির্দেশ দিচ্ছি’।
বন্ধুগণ, বর্তমানে তার চেয়েও ভয়ংকর পরিস্থিতি বিরাজমান। তবুও বিএনপি কখনোই শেখ হাসিনার মতো প্রতিহিংসা এবং জিঘাংসার রাজনীতি কিংবা আইন নিজ হাতে তুলে নেয়ার জন্য কর্মীদের নির্দেশ দেয়নি।
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, শেখ হাসিনার মতো আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী-এমপিরা খুন, গুম, চোখ তুলে নেয়া, হাত-পা কেটে দেয়া, গুলি করে মারার হুমকিতে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সুশীল সমাজের নেতারা আতংকে থাকেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে হত্যা করতে তার গুলশান অফিসের দরজা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতা মুফিদুল ইসলাম গেলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। আপনাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, বিনা ভোটের সরকারের শরিক দল জাসদের একাংশের সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম-৮ আসনের সাবেক এমপি মরহুম মঈন উদ্দীন খান বাদল ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে খালেদা জিয়াকে গুলি করে হত্যার হুমকি দেন। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী হরতালকারীদের বাড়িতে ঢুকে হত্যা করার নির্দেশ দিলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের সভাপতি ম-লীর সদস্য ও বিনা ভোটের এমপি শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, এবার আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য করা হলে প্রত্যেকের হাত-পা কেটে দেয়া হবে। শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতাদের নির্দেশনায় ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনের সময় ধানের শীষের প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের গণসংযোগের সময় দিনের আলোতে খালেদা জিয়াকে হত্যার জন্য গাড়িতে হামলা করে ভাংচুর করা হয়। আওয়ামী লীগের সাবেক নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান প্রকাশ্য টকশো’তে প্রখ্যাত আইনজীবী, বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার চোখ তুলে নেয়ার হুমকির কথা সর্বজনবিদিত। গত রোববার আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মেয়র তাপস বলেছেন, যে সকল সুশীলরা আমাদেরকে বুদ্ধি দিতে যাবেন সেই সকল সুশীলদের আমরা বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গা নদীর কালো পানিতে ফেলে দেবো।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেররা এখন রাজনীতির ভাষা ত্যাগ করে সন্ত্রাসীদের ভাষায় কথা বলছেন। ইদানিং প্রতিদিন ওবায়দুল কাদের আন্দোলনরত জনগণকে হাত পা ভেঙ্গে দেয়ার হুমকি দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, ‘এত লাফালাফি কেন ? যে হাতে আগুন নিয়েছেন, ওই হাত পুড়িয়ে দেব। যে হাত ভাংচুর করবে ওই হাত ভেঙ্গে দেব। আগুন হাতে আসবেন না, ওই হাত গুঁড়িয়ে দেব।’ সরকার প্রধান ও তার মাত্র কয়েকজন নেতার সন্ত্রাসী ভাষা উল্লেখ করলাম। নেতাদের এই হুমকি কার্যকর করছেন অতি উৎসাহী কিছু দলবাজ পুলিশ আর আওয়ামী গু-াবাহিনী। তাদের নেতারা কেবল হুমকি দিয়ে থমকে থাকে না। গুম-খুন ও হাত পা ভাঙ্গার মাধ্যমে তা কার্যকর করছে প্রতিটি জনপদে।
রিজভী বলেন, যে সন্ত্রাসী ও পুলিশ আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করেছে তাদের চিহ্নিত করুন, বিচারের আওতায় আনুন। নয়তো বা কেউ পার পাবে না, পৃথীবিতে অন্যায় করে কেউ পার পায় না। তিনি বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দোয়ায় আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়। কারণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মজিবুর রহমান তার দলের অস্তিত্ব বিলীন করেছিলেন। এরপর জিয়াউর রহমানের আমলে আবেদনের মাধ্যমে তা ফিরে পায়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম, তারিকুল ইসলাম তেনজিং প্রমুখ।