ভারতের কলকাতা থেকে পশ্চিমবঙ্গে এই সময় নতুন নতুন ম্যাগাজিন বের হয় সবাই তা জানেন। বলা হয় শারদীয়া সংখ্যা অথবা পূজা সংখ্যা। নাম যাই হোক এটা ঠিক বইমেলা বাদ দিলে এই উৎসবের সময়ে এ বঙ্গের লেখকদের নতুন পরীক্ষাধর্মী লেখা পড়ার জন্য আমরা, পাঠকরাও মুখিয়ে থাকি।
অনেকেই বলবেন সাহিত্যের কোনো ধর্ম হয় না। হতেই পারে। তাই হওয়াই তো স্বাভাবিক। শোভন। কিন্তু বাস্তবে পশ্চিমবঙ্গের হালে যা লেখালেখি তার মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজ অদৃশ্য। কুমিরের ছানার মতো আমরা দু’চারটে নাম মুখস্ত করে পড়া বলার মতো বলে যাই। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, আবুল বাশার, আফসার আহমেদ এরকম শাহযাদ ফিরদাউস, সাদেক হোসেন ইত্যাদি তিন-চারজন মাত্র। যাদের লেখার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে বড় হাউজের ম্যাগাজিনের দৌলতে। তাও এসব একটু বাড়িয়ে বলা। শাহযাদ ফিরদাউসের মতো অসম্ভব শক্তিশালী কথাকারের লেখাও শেষ কবে বা আদৌ কোনোদিনই দেশ বা আনন্দবাজারে দেখেছি কি না মনে করতে পারছি না। এই নির্দিষ্ট সময় পত্র-পত্রিকা বের হওয়ার পেছনে মূল কারণ নিঃসন্দেহে অর্থনীতি। মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু বাঙালির হাতে এ সময় পয়সা থাকে। ফলে নতুন জামা-কাপড়, শাড়ি, জুতা কেনার পাশাপাশি অনেকেই নতুন ম্যাগাজিনও এই সময়ে কেনেন। এই পাঠকদের বড় অংশের পছন্দ দেশ, আনন্দবাজারের মতো বাণিজ্যসফল পত্রিকা। ইদানীং প্রতিদিন, আজকাল, এইসময় ইত্যাদি দৈনিক কাগজের বিশেষ সংখ্যাও ভালো বিক্রি হয়। সংখ্যায় কম হলেও একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির পছন্দ অনুষ্টুপ, বারোমাস বা আরও কিছু মননশীল লিটল ম্যাগাজিন। এই ট্র্যাডিশন চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। কখনো কখনো মনে হয় যে হিন্দু মধ্যবিত্ত মনে এই কাগজ কেনার পেছনে পড়ার তাগিদা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু কেন জানি না, অনেকের মধ্যেই আবার একটু যেন দেখনদারিও আছে। এক ধরনের স্ট্যাটাস সিম্বল। দেশ পত্রিকা রাখলাম এবার। এটা বলার মধ্য দিয়ে এক ধরনের এলিট গোত্রে ঢুকে পড়ার নীরব ঘোষণা থাকে। কে ক’টা পূজাসংখ্যা কিনেছে তা নিয়েও চলে এক অঘোষিত, অদৃশ্য প্রতিযোগিতা। লিটল ম্যাগাজিন পড়াটা আবার কখনো কখনো উচ্চমার্গের প্রমাণের চেষ্টা। সাহিত্য সমাজের দর্পণ। অথচ সেই দর্পণে যদি সাতাশ-আটাশ শতাংশের জীবনযাপন অনুপস্থিত থাকে তখন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত প্রগতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। মনোরঞ্জন ব্যাপারীর মতো দলিত লেখক কেন করপোরেট পুঁজিশাসিত কাগজে লেখার যোগ্য হন না তাও কম আশ্চর্যের নয়। তখন যতই আড়াল করা হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবর্গের সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের চেহারা বে-আব্রু হয়ে যেতে বাধ্য। আরও অবাক লাগে যখন ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে বোঝা যায় এ বঙ্গে দেশভাগের আগে তো বটেই, পরেও বাংলা সাহিত্যে সামন্তরালভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের বহু প্রতিভাবান দাপটে রাজত্ব চালিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে প্রচার না থাকায় প্রতিবেশী বাংলাদেশেও গবেষণার বাইরে কেউ সেভাবে তাদের চেনেন না। সুন্দর সাজানো গোছানো যে বই বিপণন কেন্দ্রগুলো আছে সেখানে আলো করে পশ্চিমবঙ্গের যে লেখকদের বই থাকে তাতে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ থাকলেও শাহযাদ ফিরদাউস বা আফসার আহমেদ প্রায় নেই। এপারে মুসলিম সম্প্রদায়ের সাহিত্যচর্চা মূলত আবর্তিত হয় বিশেষ ঈদসংখ্যার মধ্য দিয়ে। এভাবে সাহিত্যও ঈদ ও পূজাসংখ্যা এই দুই আলাদা আলাদা ভাগে আড়াআড়ি হয়ে রয়ে যায় এ বঙ্গের শিল্প-সাহিত্যে।
দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায়ের এলিট বা মধ্যবিত্তদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কিছুটা ইচ্ছেয় আর অনেকটাই বাধ্য হয়ে অবিভক্ত পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর এপারের যে বিপন্ন মুসলিম রাতারাতি সংখ্যালঘু হয়ে গেল তাদের প্রাথমিক সমস্যা ছিল কোনোরকমে টিকে থাকা। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপে বিপর্যস্ত মুসলিমদের পক্ষে তখন সাহিত্যে মন দেওয়া খুব একটা সহজ ছিল না। বিখ্যাত সাংবাদিক, রাজনীতিক আকরম খাঁ আজও এ বঙ্গে পরিচিত আজাদ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ও তার পরিবারের সবাই ওপারে চলে গেলেও এ বঙ্গে থেকে গেলেন আকরম খাঁর এক ছেলে। তিনি, মহম্মদ খায়রুল আনম খাঁন, যে ‘পয়গম’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেটাই দেশভাগের পরেও আবার নতুন করে বের করলেন খায়রুল আনম খাঁন। ফলে পয়গম-ই দেশভাগের পর এ বঙ্গে প্রথম মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা।
খুব ভুল না করলে ওই পত্রিকাতেই কলেজ জীবনে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম আব্দুল জব্বারের বাংলার চালচিত্র। এপারের গ্রাম মফস্বলকে চিনতে গেলে ওই বইটি এক জীবন্ত দলিল। পয়গম বাদ দিলে এ বঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ‘জাগরণ’। ১৯৫৭ সাল থেকে টানা ১৯৬৪ অবধি বের হয়েছে পত্রিকাটি। ওই সময় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা পরিস্থিতিতে তা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭০ ছ’বছর প্রথম পর্যায়ে বের হয় ‘কাফেলা’, আর দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘কাফেলা’ বের হয় ফের ১৯৮১ থেকে। বন্ধ হয়ে যায় ৯০-এ। কাছাকাছি সময়ে জন্ম নেয় ‘নতুন গতি’। এই ‘জাগরণ’, ‘কাফেলা’, ‘নতুন গতি’ তিনটে কাগজের পেছনেই অবদান একজনের। তিনি আবদুল আজীজ আল-আমান। কত কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে তিনি এই সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা করেছেন তা ভাবলে সত্যি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়। কাফেলা প্রকাশের সঙ্গে উনি শুরু করেছিলেন সাহিত্যের আড্ডা। এবং তরুণ লেখকদের উৎসাহ দিতে একাধিক পুরস্কার। জাগরণ বা কাফেলার দৌলতেই আমরা পেয়েছি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ তো বটেই আব্দুল জব্বার, আব্দুল রাকিবের মতো শক্তিশালী কথাকারকে। কাফেলার পাশাপাশি আবদুল আজীজ আল-আমানের আর এক কৃতিত্ব হরফ প্রকাশনের জন্ম দেওয়া। সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই প্রকাশনা দীর্ঘদিন ধরে বেদ-কুরআনসহ সব ধর্মের বই ছেপে অলক্ষ্যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সত্যিকারের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির। কাফেলার মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এমদাদুল হক নুর সম্পাদিত ‘নতুন গতি’ পত্রিকার। এছাড়া আছে বুলবুল। সেও সাধ্যমতো সাহিত্য অন্য এক ধারাকে লালন করে চলেছে।
তবে সবাইকে পেছনে ফেলে এবার নানা কারণে চমকে দিয়েছে ‘সহজিয়া’ বলে এক্কেবারে নতুন একটি পত্রিকা। সহজিয়ার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে ঈদসংখ্যা না করে শারদ সংখ্যা প্রকাশ করে সব ধরনের চেনা পরিচিত ম্যাগাজিনের পাশে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। এ যেন দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা এক হেজিমনিকে চ্যালেঞ্জ করা। কভার, ছাপা, বিপণন, লেখা সব দিক দিয়ে যে পেশাদারিত্ব সহজিয়া প্রথম সংখ্যাতেই দেখিয়েছে তা নিঃসন্দেহে কুর্নিশ দাবি করে। কে বলবে এই কাগজটি আনকোরা কয়েকজন তরুণ-তরুণী কোনো বড় করপোরেট হাউজের সাহায্য ছাড়া স্রেফ নিজেরাই পকেটের টাকা দিয়ে বের করেছে। এবারের শারদ সংখ্যার ভিড়ে সহজিয়া বিগহিট। সহজিয়ার মধ্য দিয়ে এ বার্তাটিও এপারের বাংলা সাহিত্যে এবার পেল যে বড় দ্রুত বদলে যাচ্ছে শিক্ষিত আধুনিক মুসলিম মানস। একঝাঁক মেধা স্রেফ লেখার জোরে জানিয়ে দিয়েছে তাদের আর উপেক্ষা করার দিন শেষ। ইসমাইল দরবেশ, খালিদা খানুম, নাফিস আনোয়ার, সরফরাজ মল্লিক, রাকিবা সুলতানা, আশরাফুল আমীন সম্রাট, সফি মল্লিক এ বলে আমায় দ্যাখ ও বলে আমায়। পেশায় কেউ শিক্ষক, কেউ পশু চিকিৎসক, কেউ আবার অধ্যাপক। ৩০৫ পাতার ম্যাগাজিন। দাম ১৫০ টাকা। উপন্যাস আছে একটিই। লিখেছেন মুর্শেদ এ এম। চমৎকার এই উপন্যাস পড়লেই আপনি বুঝতে পারবেন এ বঙ্গের সাহিত্যের অন্দরমহলটি ঠিক কেমন। সহজিয়ার এটাই প্রথম সংখ্যা। আগে ঈদসংখ্যা একটা হয়েছিল। সেটা অনলাইন সংস্করণ। ঠিকঠাক চালিয়ে যেতে পারলে যে নামগুলোই শুধু আমরা পশ্চিমবঙ্গের লেখক বলে চিনে এসেছি এতদিন বোধহয় সেই চেনা ন্যারেটিভ এবার বদলে যাওয়ার সময় হয়েছে। নিছক মুসলমানি বাংলা বলে হেলা ছেরেদ্দা করে তাকে দূরে ঠেলার দিন এবার শেষ। লেখক : ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ংফধংঃরফধৎ২৭@মসধরষ.পড়স