‘আমেরিকান ড্রিম’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে আমেরিকার সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায়। পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আগমন ও সমন্বয়ে সৃষ্ট বৈচিত্র্যময় আমেরিকান জীবনের এই রহস্য আমেরিকান ড্রিম বা আমেরিকান স্বপ্ন। কী সেই স্বপ্ন, যার স্বপ্নে বিভোর হয় রঙিন পৃথিবীর বিভিন্ন কোণ থেকে সমবেত হয় স্বপ্নসারথিরা? তারা কি সত্যি কোনো জীবন্ত স্বপ্নের প্রত্যাশায় পাড়ি জমিয়ে আবাস গড়ে এই আটলান্টিকের পাড়ে? বিশ্বের সব ভালো নামকরা দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ভালো ছাত্ররা একবারের জন্য আমেরিকায় আসতে, এখানকার একটা সার্টিফিকেটের জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকে। সব টাকাওয়ালা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে শিক্ষক, আমলা ধনীর দুলালি, স্ত্রী ও পুত্ররা কীসের আশায় স্বপ্নের ভেলায় পাল উড়িয়ে পাড়ি জমায় সাত সমুদ্র তেরো নদীর ঐ পাড়ে, গড়ে স্থায়ী নিবাস। কী সেই প্রাপ্তি? আমার ৩০ বছর আমেরিকান জীবনের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, সামাজিকতা ও পেশার অভিজ্ঞতায় রিসার্চ শেষে বের করতে চেয়েছি সেই স্বপ্নের চাবি ও প্রাপ্তির ব্যাপ্তি। সেই স্বপ্ন কি সত্যিই বাস্তব, না অলীক?
১৭৭৬ সালে আমেরিকা সৃষ্টির পরিকল্পনা বা স্বাধীনতা ঘোষণার মুখবন্ধে (উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব) পাঁচ জাতীয় নেতা ও জাতির জনক জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন, বেন্জামিন ফ্রাংকলিন, জন এডামস ও জন মেডিসনরা লাইফ, লিবার্টি ও পারসুয়েট অব হ্যাপিনেসের (খরভব, খরনবৎঃু ধহফ চঁৎংঁরঃ ড়ভ ঐধঢ়ঢ়রহবংং) যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তার বাস্তবায়ন কি আমেরিকানদের জীবনে এসেছে নাকি এখনো তা অঙ্গীকারই আছে। আর যদি না-ই এসে থাকে, তবে তা কোথায় আটকে আছে এবং কেনÍএই প্রশ্নের উত্তরও এত সহজ নয়। এই শত বছরের উপাখ্যান এক লেখায় সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।
আড়াই শ বছর আগে প্রতিটি আমেরিকান নাগরিকের জন্য লাইফ, লিবার্টি ও পারসুট অব হ্যাপিনেসের অঙ্গীকারের সময় সেই সমাজব্যবস্থায় কৃতদাস প্রথা প্রচলিত ছিল। কৃতদাসেরা সমাজে সাধারণ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। শিক্ষা ও আর্থিকভাবে সমাজের অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী, উপজাতি যেমন রেড ইন্ডিয়ানরাও সে সময় সেই সব অঙ্গীকারের অন্তর্ভুক্ত ছিল কি না, তা স্পষ্ট ছিল না। তদুপরি বিবাহিত নারীরাও সমাজের অত্যাচারমূলক আচরণের শিকার ছিল, যাদের হ্যাপিনেস ও লিবার্টিও অঙ্গীকার মোতাবেক ছিল সুদূর পরাহত। আব্রাহাম লিংকনের নেতৃত্বে সিভিল ওয়ারের পর কৃতদাস প্রথা বিলুপ্তির মাধ্যমে আমেরিকান সভ্যতার নতুন রূপান্তর ঘটার পরেও আমেরিকান ডেমোক্রেসির গবেষক সমাজবিদ, ফ্রেঞ্চ দার্শনিক হেনরি টকিয়েভেলি অষ্টাদশ শতাব্দীর গবেষণায় বের করেন যে, অধিকাংশ আমেরিকান সুখী না হয়ে তারা অসুখী থাকে বিভিন্ন কারণে। এসংক্রান্ত গবেষণায় তুলে এনেছেন অনেক তথ্য-উপাত্ত।
কথা হলো, আমেরিকান ফাউন্ডিং ফাদারেরা সেই আড়াই শ বা হাজার বছর পরের ভাবনাটিও তারা ভাবতে পেরেছিলেন বলেই এগুলোর অঙ্গীকার করেছিলেন। তারা জানতেন এই লাইফ, লিবার্টি ও পারসুট অব হ্যাপিনেস তাৎক্ষণিক, দশ, বিশ, পঞ্চাশ বা শত বছর এমনকি হাজার বছরেও শতভাগ অর্জিত হবে কি না, তা নিশ্চিত বা গ্যারান্টি না দিয়ে অঙ্গীকারে সীমাবদ্ধ ছিলেন। কথা হলো, সেই অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না বা এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন কোথায় কীভাবে আটকে আছে তা আলোচনার মূল বিষয়।
হ্যাপিনেস বা সুখ ও সুখীর সংজ্ঞা খুবই জটিল। যেহেতু মানুষের জীবনই আনপ্রেডিক্টেবল। ইউরোপীয়, এংলো ইউরোপীয় চেতনা ও শিক্ষায় এটির ব্যাপক আলোচনা বা কীসে মানুষ সম্পূর্ণ সুখী হয় তা অনেকটা অলৌকিক বিশ্বাস, ভাগ্য বা ধর্মের বিষয়ও বটে। এ ধরনের হাইপোথেটিক্যাল আলোচনায় না গিয়েও আমরা সাধারণ পার্থিব বিষয় যেগুলো সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্তব্য, তা ক্রমান্বয়ে আলোচনা করতে পারি।
আমেরিকান দার্শনিক, রাজনৈতিক ও সমাজচিন্তকদের মতে বর্তমান আমেরিকান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে বা যিনি ভার্জিনিয়া, নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, নিউ হ্যাম্পশায়ার, ম্যাসাচুসেটস, ক্যালিফোর্নিয়াসহ অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যের সংবিধান মোতাবেক নাগরিকগণ তাদের লাইফ, লিবার্টি ও পারসুট অব হ্যাপিনেস শুধু কাগজের অধিকার ও অঙ্গীকারই নয়, ইচ্ছা করলেই তারা তা বাস্তবায়নের জন্য আদালতের শরণাপন্নও হতে পারেন। আদালত তাদের সব অধিকার, সুখ-শান্তি নিশ্চিতের শতভাগ গ্যারান্টি ও নিশ্চয়তা দিতে বাধ্য। প্রফেসর ডেরিন মেকমেহেনের মতে, যে কোনো আমেরিকান নাগরিক তার হ্যাপিনেস বা সুখাধিকার, অন্য যে কোনো ক্ষতি বা অধিকার আদায়ের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন এবং আদালত এ বিষয়ে তার পূর্ণাঙ্গ এক্তিয়ার প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে। তাই পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে কোনো দেশ থেকে আশা যে কোনো মানুষ নাগরিকত্ব লাভ করেই এসব অধিকার দাবি ও বাস্তবায়নের অধিকারী হয়ে, প্রত্যেকেই অতি সহজেই একেকজন অধিকার, সচেতন, স্বাধীন আমেরিকান হয়ে ওঠেন। (অসমাপ্ত) -সূত্র দৈনিক ইত্তেফাক। লেখক :বাংলাদেশি আমেরিকান আইনজীবী