আজ ১০ জুন মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদের জন্মদিন । বাংলাদেশের মানুষের কবিতাপ্রীতি এবং কবিতার লেখার প্রতি আগ্রহ দেখে রসিকজনরা বলেন,‘এদেশে কাক ও কবির অভাব নেই।’ যে যাই বলুক সত্যি কথা হলো দেশে প্রকৃত কবির অভাব প্রকট। পরিপূর্ণ কবি যে তো সোনার হরিণ। বাংলা-ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক আবু সায়ীদ আবদুল্লাহ তাঁর ‘স্বনির্বাচিত প্রবন্ধ ও রচনা’ গ্রন্থের ‘ফররুখ আহমদ’ শিরোনামে লেখা প্রবন্ধে বিষয়টি তুলে ধরেছেন এভাবে,“আগেই বলেছি ফররুখ আহমদের পর ছোট বা বড় মাপের ‘সম্পূর্ণ + কবি’ আমরা খুব একটা পাইনি। কথাটার অল্পস্বল্প ব্যাখ্যা এখানে দিতে চাই। একজন ‘সম্পূর্ণ কবি’ কে? আমার ধারণা, জীবননান্দ দাশের ‘সকলে কবি নয় কেউ কেউ কবি’-উক্তির ভিতর এই প্রশ্নের একটা প্রচ্ছন্ন উত্তর আছে।‘সকলেই কবি নয়’ কথাটার মধ্যে এমন একটা বক্তব্য অনুক্ত রয়েছে যার অর্থ এরকম সকলে (যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁদের) কবি বলে মনে হতে পারে কিন্তু আসলে (তাঁদের) ‘সকলেই নয়।’ এখানে একটি প্রশ্ন।”
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এই একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আবিষ্কার করেছেন। ফররুখ আহমদ শুধু একজন কবিই নন ‘সম্পূর্ণ কবি’। তিনি ফররুখ আহমদের সাথে দুস্তর পার্থক্যের কথা দিয়েই প্রবন্ধের সূচনা করেছেন। কেন এই দুস্তর পার্থক্য তা আশা কবি ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। যদি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একটি ব্যাখ্যা অবশ্য দিয়েছেন। কিন্তু সেই ব্যাখ্যার মধ্যেও তিনি কবিকে তাঁর বিশ্বাসের জন্য দায়ী করেননি। বরং তাঁর হৃদয়ের অব্যক্ত চেতনার রঙ তুলে ধরেছেন এভাবে,‘ফররুখ আহমদ জাতি বলতে মোটামুটি নিজস্ব ধর্মের মানুষকেই বুঝতেন, আমরা ধর্মাধর্ম নির্বিশেষে আবহমান বাংলার সকল উত্তরাধিকারীকে।… কেন ফররুখ আহমদ জাতির খ-িত পরচিয়কে পূর্ণাঙ্গ পরিচয় করে তুলেছিলেন কিংবা তাঁর মতন একজন উদার-হৃদয় মানুষের চেতনায় তাঁর নিজস্ব ধর্মের মানুষ ছাড়া আর সবাই কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছিলো। তা নির্ণয় করা কঠিন নয়। তাঁর অর্ধঃপতিত দুঃখী জাতিকে উদ্ধারের নিদ্রাহীন উৎকণ্ঠা তাঁর অস্থির-মজ্জা-মনন-চেতনাকে এমন নিষ্কৃতিহীনভাবে কামড়ে ধরেছিল যে ঐ বিশেষ জাতির অস্তিত্বের প্রসঙ্গ ছাড়া আর সব কিছুই তাঁর সামনে থেকে রিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, ঠিক যেভাবে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্কিমের সমানে থেকে তাঁর নিজস্ব ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ ছাড়া আর সবার প্রসঙ্গ কিংবা সুকান্তের কাছে নিপীড়িত মানুষের দুঃখ-বেদনা ছাড়া জীবনের আর সব বিবেচনা।’
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নিকট থেকে কবি অকবি কিংবা সম্পূর্ণ কবির ব্যাখ্যা না নিলেও বিষয়টি বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, একজন কবি কখন সম্পূর্ণ বা পুরোপুরি কবিতে পরণিত হন। এখানে আলোচনার বিষয় হলো, কবি ফররুখ আহমদের নীতি আদর্শের সাথে যারা দ্বিমত পোষণ করেন, তারাও তাঁর কবি সত্তাকে অস্বীকার দূরের কথা অসম্মান করার দুঃসাহসও দেখান না। কারণ তাঁর প্রতিটিই কবিতাই কাব্যসুষমা এবং বৈশিষ্ট্য গুণে এক একটি সম্পূর্ণ কবিতা। এই সত্য অস্বীকার করার সুযোগ কবি দেননি। তাই তো তিনি একজন ‘সম্পূর্ণ কবি’।
তাঁর সৃষ্টিগুণেই তিনি সবার প্রিয় কবি। তিনি ইসলামী রেঁনেসা বা নবজাগরণের কবি বলে পরিচিত। কিন্তু তাঁর কবিতার প্রেমে আকৃষ্ট সকল ধারার মানুষ। তাই যারা বলতে চান তিনি আসলে মুসলিম সম্প্রাদয়কে নিয়েই তার ভাবনা সীমান্ত রেখেছিলেন, তাদের এই চিন্তাটিই আসলে সাম্প্রদায়িক। কবি ফররুখ আহমদ সাম্প্রাদয়িক ছিলেন না। তাঁর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো সকল নিপীড়িত অধিকারহারা বঞ্চিত মানুষ। তাঁর সময়ে মুসলমানরা ছিলেন এই বঞ্চিতদের মিছিলের সবার সামনের সারিতে। তিনি সবার কথাই বলেছেন, কিন্তু পাদপ্রদীপের আলোয় ধরা পড়েছে সবার আগে বঞ্চিত ও লঞ্ছিত মুসলমানদের মুখ। কবি পৃথিবীর সকল বঞ্চিত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস পেয়েছেন,তাঁর চিরচেনা দর্শন ও আদর্শ ইসলামের মাঝে। তিনি এই দর্শনের বাতিঘর থেকেই আলো সংগ্রহ করে সেই আলোয় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে আলোকিত করার জন্য সংগ্রাম করেছেন। কবি ফররুখ আহমদ মানবতার মুক্তির জন্য প্রথম জীবনে সমাজতান্ত্রিক আর্দশে আকৃষ্ট হয়ে ছিলেন। পরে ভুল বুঝতে পেরে বিশ্ব মানবতার মুক্তি সনদ ইসলামী আর্দশ প্রতিষ্ঠতার জন্য তাঁর শক্তিশালী লিখনীর মাধ্যমে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি লিখেছেন:
‘আজকে উমরপন্থী পথীর দিকে দিকে প্রয়োজন
পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রান্তর প্রাণ-পণ,
ঊষর রাতের অনাবাদী মাঠে ফলাবে ফসল যারা,
দিক-দিগন্তে তাদের খুঁজিয়া ফিরিছে সর্বহারা!’
কবি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে শুধুমাত্র আদর্শিক মতপার্থক্যের কারণে নির্যাতিত হয়েছেন। কিন্তু মিথ্যার সাথে আপস করেননি। তার লক্ষ্য ছিল ঘুমন্ত এই জাতিকে জাগ্রত করে আল্লাহ প্রদত্ত সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব মানবতার মুক্তি। তিনি লিখেছেন :
তবে তুমি জাগো, কখন সকালে ঝরেছে হাসনাহেনা
এখনো তোমার ঘুম ভাঙলো না? তবু তুমি জাগলে না?
ফররুখ আহমদ বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষার একজন প্রখ্যাত মৌলিক কবি। তাঁর কবিতার মুগ্ধ পাঠক কবিসত্তাকে স্বীকার করলেও অনেকেই আজো তার এই আহ্বানে সাড়া দিতে পারেনি বলেই মানবতা মানব রচিত মেকি, মিথ্যা, মানুষ ঠকানো মতবাদের শৃঙ্খলে বন্দি।
তাঁর কবিতায় বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অণুপ্রেরণা প্রকাশ পক্ষে বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামী ভাবধারার বাহক হলেও তাঁর কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার সকল লক্ষণ তার কবিতায় পরিব্যাপ্ত। রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতায় ফররুখ আহমদের সৃষ্টিশীলতা মৌলিক বলে সর্বজন স্বীকৃতি পেয়েছে। তাঁরও আদর্শের পাশে আপস না করার কারণে নব্য স্বাধীনতা উত্তরণ বাংলাদেশে তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা সেই দুঃসময়ে কবি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৬ জুন, ১৯৭৩ সালের গণকণ্ঠ পত্রিকায় তিনি কবির প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেছেন,‘খবর পেয়েছি বিনা চিকিৎসায় কবি ফররুখ আহমদের মেয়ে মারা গেছে। এই প্রতিভাধর কবি যাঁর দানে আমাদের সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে-পয়সার অভাবে তাঁর মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে পারেননি, ওষুধ কিনতে পারেননি। কবি এখন বেকার। তাঁর মৃত মেয়ের জামাই, যিনি এখন কবির সঙ্গে থাকছেন বলে খবর পেয়েছি তাঁরও চাকুরি নেই। মেয়ে তো মারাই গেছে। যারা বেঁচে আছেন, কি অভাবে, কোন অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিনগুলো অতিবাহিত করছেন, সে খবর আমরা কেউ রাখিনি।
হয়ত একদিন সংবাদ পাব কবি মারা গেছেন, অথবা আত্মহত্যা করেছেন। খবরটা শোনার পর আমাদের কবিতাপ্রেমিক মানুষের কি প্রতিক্রিয়া হবে? ফররুখ আহমদের মৃত্যু সংবাদে আমরা কি খুশি হব, নাকি ব্যথিত হব? হয়ত ব্যথিতই হব এ কারণে যে, আজকের সমগ্র বাংলা-সাহিত্যে ফররুখ আহমদের মত একজনও শক্তিশালী স্রষ্টা নেই। এমন একজন স্রষ্টাকে অনাহারে রেখে তিলে তিলে মরতে বাধ্য করেছি আমরা। ভবিষ্যৎ বংশধর আমাদের ক্ষমা করবে না, অথচ কবি ফররুখ আহমদের মরার সমস্ত ব্যবস্থা আমরাই পাকাপোক্ত করে ফেলেছি। আমরা তাঁর চাকুরি কেড়ে নিয়েছি, তাঁর জামাই এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের সৎভাবে পরিশ্রম করে বাঁচবার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছি। রাস্তা-ঘাটে কবির বেরোবার পথ বন্ধ করে দিয়েছি। প্রয়োজনীয় সবগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আমরা ত্রুটি রাখিনি।
কবি ফররুখ আহমদকে আমরা এতসব লাঞ্ছনার মধ্যে ফেলেছি তার কারণ তো একমাত্র কবিতাই। ফররুখ আহমদের একমাত্র অপরাধ তিনি একদা পাকিস্তানের সপক্ষে কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতার একটি বিশেষ জীবনাদর্শ দুষ্টলোকের ভাষায় ইসলামি জীবনাদর্শ। এখন কথা হল, তখন কি পাকিস্তানের সপক্ষে কবিতা লেখা অপরাধ ছিল? আমরা যতটুকু জানি পাকিস্তান এবং ইসলাম নিয়ে আজকের বাংলাদেশে লেখেননি এমন কোন কবি-সাহিত্যিক নেই বললেই চলে। অন্য অনেককে বাদ দিয়েও কবি সুফিয়া কামালের পাকিস্তান এবং জিন্নাহর ওপর নানা সময়ে লেখা কবিতাগুলো জড়ো করে প্রকাশ করলে ‘সঞ্চয়িতা’র মত একখানা গ্রন্থ দাঁড়াবে বলেই আমাদের ধারণা। অথচ ভাগ্যের কি পরিহাস কবি সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হয়ে মস্কো-ভারত ইত্যাদি দেশ সফর করে বেড়াচ্ছেন, আর ফররুখ আহমদ রুদ্ধদ্বার কক্ষে বসে অপমানের লাঞ্ছনায় মৃত্যুর দিন গুনছেন।
ফররুখ আহমদের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করে বাংলাভাষার সতীত্ব হানি করেছেন। কিন্তু কবি ফররুখ আহমদ নিজে বলেছেন, তিনি শব্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, কবিতার ক্ষেত্রে তা নিশ্চয়ই দোষনীয় নয়। বিশেষত বাংলাদশে এমন একটা সময় ছিল, কবি-সাহিত্যিকেরা উর্দু, ফারসি ঘেঁষা দেখাতে পারলে বর্তে যেতেন। তাদের অনেকেই এখন বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন রয়েছেন। তাছাড়া ইংরেজি, জার্মান, সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষা নিয়ে যাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কবিতা, গল্প লিখতে চেষ্টা করেছেন, তাঁদেরকে সে সকল রচনার জন্য পুরস্কৃত করতেও আমাদের বাধছে না। ও সমস্তের ফলে যে বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হচ্ছে সত্যিকার অর্থে সে বিচার কে করবে? অথচ অন্য কবি-সাহিত্যিক সকলে বাইরে রয়েছেন। কিন্তু শাস্তি ভোগ করছেন একা ফররুখ আহমদÍএ কেমন ধারা বিচার? ফররুখ আহমদের বিরুদ্ধে যে দু’টি উল্লেখযোগ্য নালিশ রয়েছে, সেগুলো হলÍতিনি রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে চল্লিশজন স্বাক্ষরকারীর একজন। তিনি স্বশ্রদ্ধভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু স্বাক্ষরদানকারী চল্লিশজনের অনেকেই তো এখনো বাংলাদেশ সরকারের বড় বড় পদগুলো অলংকৃত করে রয়েছেন। কিন্তু ফররুখ আহমদকে একা কেন শাস্তি ভোগ করতে হবে? পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন না কে? আজকের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী (শেখ মুজিব) স্বয়ং তো এক সময়ে পাকিস্তান আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। সাতই মার্চের পূর্ব পর্যন্ত তিনি পাশাপাশি জয়-বাংলা এবং জয়-পাকিস্তান শব্দ দু’টো উচ্চারণ করেছিলেন, তাহলে ফররুখ আহমদের অপরাধটা কোথায়? বলা হয়ে থাকে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ে তিনি অনেকবেশি সাম্প্রদায়িক বিষোদগার করেছিলেন। সেপ্টেম্বরের যুদ্ধের সমস্ত প্রমাণ এখনো নষ্ট হয়ে যায়নি। বাংলাদেশের সমস্ত লেখক-কবি-সাহিত্যিক সাম্প্রদায়িকতার প্রচারে কে কার চাইতে বেশি যেতে পারেন সে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। কেউ যদি চ্যালেঞ্জ করেন আমরা দেখিয়ে দিতে পারি। মানুষের স্মৃতি এত দুর্বল নয় যে, হিং টিং ছট ইত্যাদি প্রোগামগুলো ভুলে গেছে। ঐ সমস্ত প্রোগ্রাম যারা করেছে সংস্কৃতির সে সকল কলমধারী গুন্ডারা বাংলাদেশে বুক চিতিয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতির আসন দখল করে আছেÍকি আশ্চর্য। চাকুরি হারাবেন, না-খেতে পেয়ে মারা যাবেন এক ফররুখ আহমদ। এতসব দোষের মধ্যেও ফররুখ আহমদের কতিপয় গুণের কথা আমরা না-উল্লেখ করে পারছিনে। সেপ্টেম্বর যুদ্ধের পরে কবি ফররুখ আহমদকে যখন প্রাইড অব পারফরমেন্স দেয়ার কথা ওঠে, তিনি অস্বীকার করেছিলেন। আমরা শুনেছিলম, তিনি বলেছিলেন, একজন কবির ক্ষমতাদর্পীর হাত থেকে নেয়ার কিছুই নেই। খবর পেয়েছিলাম, সে প্রাইড অব পারফরমেন্স এমন একজন সাহিত্যসেবীকে দেয়া হয়েছিল এখন যত্রতত্র তাঁর শোকসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি দলের সকলে তাঁর কথা মনে করে শোকাশ্রু বর্ষণ করছেন।
মজার কথা হল, তিনিও দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের সপক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন। যাকে নিয়ে এত লাফালাফি তিনি যদি বেঁচে থাকতেন আজ হয়ত কারাগারেই থাকতেন। আমাদের কথা হল, ফররুখ আহমদের মত একজন শক্তিমান স্রষ্টার চাকুরি কেড়ে নেয়া, সপরিবারে তাঁকে মৃত্যু-যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করার পেছনে ন্যায়-নীতিসঙ্গত যুক্তিটা কি হতে পারে?
আমরা বাংলাদেশের আরো একজন খ্যাতনামা কবির কথা জানি (কবি শামসুর রাহমান)। যিনি পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিকটির (দৈনিক পাকিস্তান) সম্পাদকীয় রচনা করেছিলেন। ঐ পত্রিকার চাকুরি করেন আর একজন কবি সম্পর্কে কানা-ঘুষা শোনা যাচ্ছে যে, তিনি পাকিস্তানি মেজর ক্যাপটেনদের সাহায্যে নাম ভাঙ্গিয়ে লাহোর করাচি ছুটোছুটি করেছেন। কেউ যদি আমাদের বক্তব্যকে অসত্য মনে করেন, বাস্তব প্রমাণ দাখিল করতে পারব।…আমরা ফররুখ আহমদকে বাঁচাবার জন্য, তার পরিবারকে বাঁচাবার জন্য ‘ফররুখ আহমদ সাহায্য তহবিল’ গঠন করার জন্য কবির অনুরাগীজন এবং দেশপ্রেমিক, সংস্কৃতিপ্রেমিক জনগণের কাছে আবেদন রাখছি।
স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরেও কবি ফররুখ আহমদের ওপর থেকে এই বঞ্চনার চাদর সরে যায়নি। এখনো একটি দুষ্টচক্র তাঁকে নিয়ে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। অথচ এই দুঃসময়ে কবি ফররুখ আহমদের সাহিত্য ও জীবনের ওপর ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে আলোর পথে পরিচালিত করতে তাঁকে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। ইতিহাসের সঠিক বিচার বিশ্লেষণের সাথে সাথে তাঁর কবি প্রতিভা সম্পর্কেও বর্তমান প্রজন্মকে অবহিত করতে হবে।
তিনি শিশু-কিশোরদের জন্যও লিখেছেন অনেক মজার মজার ছড়া কবিতা,গান,গল্প নাটক-নাটিকা। যেমন:পাখির বাসা,হরফের ছড়া, ছড়ার আসর, নয়া জামাত, চিড়িয়াখানা, কাফেলা, আলোকলতা, খুশীর ছড়া, ছড়াছবির দেশে, পাখির ছড়া, রঙমশাল তার লেখা উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ। আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশের প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসার কথা। সে ভালবাসার টানে তিনি লিখেছেন: ডালে ডালে পাখির বাসা/মিষ্টি মধুর পাখির ভাষা/সাত সাগরে নদীর বাসা/কুলুকুলু নদীর ভাষা।/হাজার সুরের হাজার ভাষায় /এ দুনিয়া ঘেরা/আর মাতৃভাষা বাংলা আমার/সকল ভাষার সেরা।’
জীবনের শেষলগ্নে বঞ্চনার শিকার হলেও কবি জন্ম নিয়েছিলেন সোনার চামিচ মুখে নিয়ে ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা জেলার মাঝআইল গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী। কিন্তু আর্দশিক মতপার্থক্যের কারণে মৃত্যুর আগে তাকে অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর ইন্তেকাল করেছেন। তিনি চলে গেলেও রেখে গেছেন তাঁর লেখা অসংখ্য কবিতা,গান, ছড়া, নাটক, কথিকা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, তাঁর প্রতিটি প্রতিটি সৃষ্টিই। তাই তাঁকে তাঁর কর্মের মাঝে বাঁচিয়ে রাখতে হবে,আমাদের উন্নতি ও সমৃদ্ধির স্বর্ণালী সোপানকে মজবুত রাখার স্বার্থেই। লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সিনিয়র সাংবাদিক।