মধুর প্রতিশোধ বুঝি একেই বলে! ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে আফগানদের কাছে ২২৪ রানের সেই পরাজয়ের ক্ষত এখনও ভুলতে পারেননি বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা। এবার ঘরের মাঠে সেই দলটিকে পেয়ে শুধু জয়ই তুলে নিলো না, নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জয়ের রেকর্ডও গড়ে নিলো টাইগাররা। মিরপুরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সাড়ে তিনদিনেই ৫৪৬ রানের বিশাল ব্যবধানে জয় তুলে নিলো লিটন দাসের দল। ব্যাটারদের দারুণ নৈপুণ্য এবং বোলারদের দারুণ নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের গতকাল শনিবার এতবড় জয়ের দেখা পেলো বাংলাদেশ দল। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এই জয় তৃতীয় সর্বোচ্চ রানের ব্যবধানে জয়ের রেকর্ড। লা বিরতির আগে ম্যাচটা শেষ করার জন্য প্রথম সেশনে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ১৫ মিনিট বেশি খেলানো হলো। সে অনুসারে ম্যাচটাও প্রায় শেষ করে দিয়েছিলেন তাসকিন আহমেদ। ৩৩তম ওভারে তার করা চতুর্থ বলটি ফুলটস ছিল। সেই বল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দেয় আফগান ব্যাটার জহির খানের।
কিন্তু বলটি যখন ব্যাটারকে অতিক্রম করছিলো, তখন সেটি ছিল ব্যাটারের কোমরের ওপরে। যে কারণে আম্পায়ার বলটিকে নো ডাকেন। বেঁচে যান জহির খান। বাংলাদেশের বিজয়ও বিলম্বিত হলো। ওই ওভার শেষেই লা বিরতি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আফগানিস্তান জানিয়ে দেয়, তাদের ব্যাটার জহির খান আহত। আর ব্যাট করতে নামতে পারবেন না। অর্থ্যাৎ ১১৫ রানেই শেষ আফগানদের দ্বিতীয় ইনিংস এবং বিশাল জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ। তবে লসটা হলো তাসকিনের। তার নামের পাশে ফাইফার শোভা পেতো; কিন্তু নো বলের কারণে সেটা আর হলো না। আবার আফগান ব্যাটার জহির খান আউট হওয়ায় ৫ম উইকেট নেয়ারও আর সুযোগ পেলেন না তিনি। বাংলাদেশ নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে প্রথম জয় পেয়েছিলো ২০০৫ সালে চট্টগ্রামে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ওই টেস্টে ২২৬ রানের ব্যবধানে পাওয়া জয়ই এতদিন রানের ব্যবধানে সবচেয়ে বড় জয় ছিল টাইগারদের। ২০১৮ এবং ২০২০ সালে দুটি ইনিংস ব্যবধানে জয় থাকলেও শুধু রানের ব্যবধানে সবচেয়ে বড় জয় সেটিই। এবার আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৫৪৬ রানের বিশাল জয় দিয়ে ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার পর নাম লেখালো বাংলাদেশ। রানের ব্যবধানে সবচেয়ে বড় জয় ইংল্যান্ডের। ১৯২৮ সালে ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৬৭৫ রানে জিতেছিলো ইংলিশরা। এরপর ১৯৩২ সালে দ্য ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৬২ রানের ব্যবধানে জয় পেয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া। এরপর সর্বোচ্চ ব্যবধানে জয়ের রেকর্ডটিই এখন বাংলাদেশের।
টস হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে নাজমুল হোসেন শান্তর ১৪৬ রানের ওপর ভর করে বাংলাদেশ ৩৮২ রান সংগ্রহ করে। জবাব দিতে নেমে ১৪৬ রানে অলআউট হয়ে যায় আফগানিস্তান। ২৩৬ রান এগিয়ে থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামে। নাজমুল হোসেন শান্তর ব্যাক টু ব্যাক এবং অভিজ্ঞ মুমিনুল হকের সেঞ্চুরির ওপর ভর করে ৪ উইকেটে ৪২৫ রানে ইনিংস ঘোষণা করে টাইগাররা। ৬৬২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে তাসকিন, শরিফুলের আগুনে বোলিংয়ের সামনে মাত্র ১১৫ রানেই অলআউট হয়ে যায় আফগানরা। দুই ইনিংস মিলিয়ে ২০ উইকেট হারিয়ে তারা করতে পারলো মাত্র ২৬১ রান। তৃতীয় দিন শেষে আফগানিস্তানের সামনে ৬৬১ রানের লিড নেয়ার পরই পরিস্কার হয়ে যায় ম্যাচের ফল কী হতে যাচ্ছে। শুধু অপেক্ষা ছিল, আফগানরা দ্বিতীয় ইনিংসে কত রান করে এবং কত ব্যবধানে জয় পায় বাংলাদেশ। তৃতীয়দিন শেষ বিকেলে জয়ের জন্য ৬৬২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে দুই উইকেট হারায় আফগানরা। তবুও তৃতীয় দিন শেষে আফগান কোচ আশা প্রকাশ করেন, পরের দুদিন টানা ব্যাট করতে চান তারা।
কিন্তু চতুর্থ দিন সকালে ব্যাট করতে নেমে কোচের আস্থার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হলেন আফগান ব্যাটাররা। একের পর এক উইকেট হারিয়েছেন তারা। দিনের তৃতীয় ওভারেই এবাদত হোসেনের অফ স্ট্যাম্পের একটু বাইরে লেন্থ বলটি ব্যাটের কানায় লাগিয়ে বসেন ব্যাটার নাসির জামাল। উইকেটের পেছনে লিটন দাসকে সেই ক্যাচ ধরতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি। ৪৮ রানে পড়ে আফগানদের তৃতীয় উইকেট। এর আগে তৃতীয়দিন শেষ বিকেলে রানের খাতা খোলার আগেই ইবরাহিম জাদরান, ৭ রানের মাথায় আবদুল মালিক আউট হন। ২৬ রানের মাথায় মাথায় আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়েন আফগান অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শহিদি। আজ তার কনকাশন হিসেবে একাদশে নেয়া হয়েছে বাহির শাহকে। তিনিই নামেন ব্যাট করতে।
এবাদত হোসেনের পর আফগান শিবিরে জোড়া আঘাত হানেন শরিফুল ইসলাম। মিডল অর্ডার আফসার জাজাই মাঠে নেমে থিতু হওয়ার আগেই শরিফুলের বলে ক্যাচ দেন মেহেদী হাসান মিরাজের হাতে। ৬ রান করে আউট হয়ে যান তিনি। হাশমত উল্লাহ শহিদির পরিবর্তে কনকাসন হিসেবে নামা বাহির শাহ ব্যাট করতে নামেন এরপর। কিন্তু তিনিও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি ১৩ বলে ৭ রান করে স্লিপে তাইজুলের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান সাজঘরে। ৭৮ রানের মাথায় পড়লো ৫ম উইকেট।
এরপর ধারাবাহিকভাবে উইকেট হারান রহমত শাহ (৩০), করিম জানাত (১৮), আমির হামজা (৫), ইয়ামিন আহমদজাই (১) এবং জহির খান (৪)। রহমত শাহই বাংলাদেশের বোলারদের সামনে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে দাঁড়ান। কিন্তু ৭৩ বল খেলে ৩০ রান করার পর তাসকিনের বলে লিটনের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান তিনি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ রান করেন করিম জানাত। তাসকিনের বলে বোল্ড হয়ে যান তিনি। আফগানদের মিডল অর্ডার এবং লেট অর্ডারে বড় আঘাতটি হানেন তাসকিনই। ৯ ওভারে ৩৭ রান দিয়ে ৪ উইকেট নেন দিনি। শরিফুল নেন ৩ উইকেট। ১টি করে উইকেট নেন মেহেদী হাসান মিরাজ এবং এবাদত হোসেন।