সাম্প্রতিক সময়ে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। চলতি বছরের গেল কয়েক মাসে বড় বড় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের মুখোমুখি হয়েছে নগরবাসী। এমন ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পর অগ্নিসচেতনতা নিয়ে এখনও উদাসীন লোকজন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি অগ্নিকা-ের পরপরই একাধিক সংস্থা তদন্ত কমিটি গঠন করে। শুরু হয় নানা রকম আলোচনা। আগুনের সূত্রপাত, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ও বেশ কিছু সুপারিশ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছায়। কিন্তু মাস ঘুরে বছর যায়, সেই সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয় না। অপরাধীদের কোনও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। আর সেসব কারণেই দিন দিন বাড়ছে বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা।
চলতি বছরের ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজার মার্কেটে আগুন লেগে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান পুড়ে গিয়েছে। ১১ এপ্রিল চকবাজারের বিসমিল্লাহ টাওয়ারের পাশে বহুতল ভবনের চতুর্থ তলায় সিরামিক ওয়ার হাউস ভস্মীভূত হয়েছে। ১৩ এপ্রিল নবাবপুরের মোহাম্মাদিয়া মার্কেটে ২০টি দোকান ও ওয়ার হাউস পুড়ে গিয়েছে। ১৫ এপ্রিল নিউমার্কেট সংলগ্ন নিউ সুপারমার্কেটে প্রায় ৩০০ দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ঈদের আগে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ২৪ ঘণ্টায় ২২টি স্থানে আগুন লেগেছে। দেখা গেছে, এসব বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড অবহেলা, উদাসীনতা আর সচেতনতার অভাবে ঘটেছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যমতে, ২০২২ সালে সারা দেশে গড়ে প্রতিদিন ৬৬টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া শুধু অগ্নিকাণ্ডে এক বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ২০২১ সালে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে ২১ হাজার ৬০১টি। অপর দিকে ২০২২ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ হাজার ১০২টি। অর্থাৎ গত এক বছরে দৈনিক হারে বেড়েছে ছয়টি ঘটনা।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলছে, আমাদের বসবাসের এলাকাগুলো এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ। সড়ক-ফুটপাত, মসজিদ-উপাসনালয়, আবাসিক ভবন, শিল্প-কারখানার, বাণিজ্যিক ভবন বিপণিবিতান কিংবা খাবারের রেস্টুরেন্ট কোনও স্থানই আর আমাদের জন্য অগ্নি ও বিস্ফোরণের ঝুঁকি থেকে নিরাপদ নয়। সর্বত্র আহাজারি, হাহাকার আর বিপন্ন মানুষের উন্মাদনা অগ্নিকা- ও বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো এখন আর হিসাবে থাকছে না। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতকরণের জন্য সরকারের বিশেষায়িত যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিতে, অদক্ষতা আর খামখেয়ালিপনায় হারিয়ে যাচ্ছে অনেকগুলো প্রাণ।
মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মামলা হয়নি। আবার দু-একটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাজার কোনও নজির নেই! অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তবে কমিশন মনে করে, অগ্নিনির্বাপণে শুধু দমকল বিভাগই নয়, পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ পরিষেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন দফতরগুলোর সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। এসব বিভাগ সমন্বিতভাবে অগ্নিকা- ও বিস্ফোরণ মোকাবিলায় একটি রূপরেখা তৈরি করে সে অনুসারে অগ্নিনির্বাপণ কর্মকা- সমন্বয় করতে কেন ব্যর্থ হচ্ছে, সেটি বিশ্লেষণ প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠান ও দফতরগুলোর সমন্বয়হীনতার বলি হচ্ছে কতগুলো তাজা প্রাণ, এ থেকে উত্তরণ আবশ্যক!
কমিশন আরও বলছে, অধিকাংশ বিপণিবিতানে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা বলে কিছু নেই। ভবনের ভেতরেও ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং, যত্রতত্র মালামাল রয়েছে এবং ভবনের চারদিকে ফুটপাতে বসেছে অসংখ্য দোকান, সেখানে উন্মুক্ত অবস্থায় বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়া হয়েছে। বৈদ্যুতিক তার ঝুলে আছে যেখানে-সেখানে। এ কারণে আগুন লাগলে দ্রুততম সময়ে পুরো ভবনে তা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। ঢাকা ট্রেড সেন্টারের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের দুটি মালিক সমিতিকেই এসব বিষয় অবগত করে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে তাদের কোনও উদ্যোগ নেই। মালিকরাও এসব ক্ষেত্রে উদাসীন। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ২০১৯ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরির চার বছর পরও পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি। রাজধানীর ৫৮টি বিপণিবিতানকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। এসব মার্কেটে অগ্নিনিরাপত্তা আইন মানার ক্ষেত্রে চরম অবহেলা দেখা গেছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে রাজধানীর ১ হাজার ৫১৭টি মার্কেট ও শপিং মল, রেস্টুরেন্ট ও আবাসিক হোটেলে জরিপ চালানো হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৬৩টি ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর।
সংস্থাটি মনে করে, তাদের কাজ সচেতনতা বৃদ্ধি করা, ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা, এরপর সচেতন করতে তারা ব্যানার টানিয়ে দেয়৷ ভবনমালিক ব্যবস্থা না নিলে তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন ও রাজউককে জানায়। যে প্রতিষ্ঠান ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়, তাদেরই আইন প্রয়োগ করার কথা। কিন্তু আইন অমান্য করা হলেও ফায়ার সার্ভিস কারও ওপর জোর করতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, সচেতন হতে বেশি কিছু লাগে না। আমরা বাসস্থান, অফিস বা যেকোনও প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে যদি ১০০ টাকা থেকে ২ টাকা অগ্নিনিরাপত্তার জন্য ব্যয় করি, তাহলে অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে পারি। এদিকে পানির উৎস কমে যাচ্ছে। ঢাকা শহরে পাঁচ বছর আগে ১০০টি পুকুর ছিল। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫-এ। আগামী পাঁচ বছর পর এই ২৫টি পুকুর থাকবে কিনা, সেটার কোনও নিশ্চয়তা নেই। অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে সব সচেতন হতে হবে।
বিস্ফোরণের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, পরিত্যক্ত লাইনের বের হওয়া গ্যাস জমে এ বিস্ফোরণ ঘটে। বিশেষজ্ঞের মতে, যদি লিকেজ থেকে বের হওয়া গ্যাস কোন একটি বদ্ধ স্থানে বা পকেটে সি ত হয় এবং এর ঘনত্ব যদি শতকরা পাঁচ ভাগের ঊর্ধ্বে হয়, তাহলে একটি বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ঢাকা শহরের সাম্প্রতিক বিস্ফোরণগুলো এর মাধ্যমেই হয়েছে।
বহু সংখ্যক গ্যাস লিকেজজনিত দুর্ঘটনার সূত্রপাত হচ্ছে এবং বহু হতাহতের ঘটনা ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সূত্রে জানা গেছে, তিতাস, কর্ণফুলী ও জালালাবাদ এর গ্যাস পাইপলাইনগুলো কমপক্ষে ৩০ বচর বছরের পুরনো এবং প্রতি মাসে ৫০০-এর বেশি গ্যাস লিকেজের রিপোর্ট আসছে। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, তাদের সম্প্রসারণ লাইনগুলো ৪০ বছরের পুরনো এবং ১০ বছর আগে এগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে।
কোনও অগ্নিকা- বা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলেই প্রায় সময় গ্যাসের লাইন থেকে হয়েছে, লোকজন এমনটা দোষারোপ করেন। এ ছাড়া অনেক পুরনো গ্যাস লাইনের ত্রুটিপূর্ণ অবস্থা থাকায় মাঝেমধ্যে এসব গ্যাস লাইন থেকে আগুনের সূত্রপাত হচ্ছে সাম্প্রতিক সময় দেখা গেছে। এসব ত্রুটিপূর্ণ গ্যাসলাইন নতুনভাবে নির্মাণ করার কি কোনও প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন।
এমন প্রশ্নের জবাবে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লা বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে গ্যাসের লাইনগুলো প্রযুক্তিনির্ভর এবং আধুনিকভাবে নির্মাণ করার পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়েছি। এ প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হলে আমরা দূর থেকে আমরা প্রযুক্তির মাধ্যমে লাইনগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। অগ্নিকা-ের মতো কোনও দুর্ঘটনা কিংবা লাইনের কোনও ত্রুটি থাকলে, লিকেজ থাকলে প্রযুক্তির মাধ্যমে সেই মেসেজ আমরা পেয়ে যাবো। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে।-সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন