সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৪ পূর্বাহ্ন

চৌরঙ্গী

শংকর
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৭ জুলাই, ২০২৩

(শংকর এক জন জনপ্রিয় লেখক । তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়তাঁর ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জনঅরণ্য’ কাহিনী অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়করেছেন উত্তম কুমার। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড?াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায়শুরু করেন লেখালেখি। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায়জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময়‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি আশি পেরিয়েছেন শংকর। এখনও সমান তালে লিখে চলেছেন। ইদানীং তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।)
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আর স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কা? মনে হল, তিনি যেন আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তাঁর পদতলে বসে আমার ঠোঁট থর থর করে কেঁপে উঠল। হাত জোড় করে সভয়ে বললাম, স্যর হরিরাম, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার কোনো দোষ নেই। ক্লাইভ স্ট্রিটের এক স্বল্পবুদ্ধি নিরক্ষর দারোয়ান আমার মধ্যে আপনার ছায়া দেখেছে। আমার কোনো হাত ছিল না তাতে। বিশ্বাস করুন, আপনাকে অপমান করার কোনো অভিসন্ধিই ছিল না আমার।
কতক্ষণ একভাবে বসেছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আপিসের ফাঁকিবাজ ছ্কোরা কেরানির মতো সূর্যও কখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিজের দপ্তর গুটিয়ে ফেলে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছেন। শুধু আমি বসে আছি।
আমার কী আছে?
আমি কোথায় যাব?
হ্যাল্লো স্যর। হঠাৎ চমকে উঠলাম।
আমারই সামনে অ্যাটাচি কেস হাতে কোট-প্যান্ট-পরা এক সায়েব দাঁড়িয়ে রয়েছেন। গায়ের রং আমার থেকেও কালো। (মা নিতান্ত স্নেহবশেই আমাকে উজ্জ্বল শ্যাম বলতেন।)
অ্যাটাচি কেসটা দেখেই চিনেছি। বায়রন সায়েব। পার্কের মধ্যে আমাকে ঘুমোতে দেখে বায়রন সায়েব অবাক হয়ে গিয়েছেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বায়রন সায়েব বললেন, বাবু!
বায়রন সায়েবের আশ্চর্য হয়ে যাবারই কথা। ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটে আমার প্রতিপত্তি এক সময় তিনি তো নিজের চোখেই দেখেছেন।
সেই দিনটার কথা আজও ভুলিনি। বেশ মনে আছে, চেম্বারে বসে টাইপ করছিলাম। এমন সময় অ্যাটাচি কেস হাতে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। আবলুস কাঠের মতো রং। কিন্তু সে রংয়েরও কেমন একটা জেল্লা আছেÍঠিক যেন ধর্মতলা স্ট্রিটে চার-আনা-দিয়ে-রং-করা সু।
সায়েব প্রথমেই আমাকে সুপ্রভাত জানালেন। তারপর আমার বিনা অনুমতিতেই সামনের চেয়ারে এমনভাবে বসে পড়লেন, যেন আমাদের কতদিনের আলাপ। চেয়ারে বসেই পকেটে হাত ঢোকালেন, এবং এমন এক ব্র্যান্ডের সিগারেট বার করলেন যার প্রতি প্যাকেট সেই দুর্মূল্যের বাজারেও সাত পয়সায় বিক্রি হত।
সিগারেটের প্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, একটা ট্রাই করে দেখুন।
আমি প্রত্যাখ্যান করতেই হা-হা করে হেসে উঠলেন। এই ব্রান্ড বুঝি আপনার পছন্দ হয় না? আপনি বুঝি খুব ফেথফুল? একবার যাকে ভালোবেসে ফেলেন, তাকে কিছুতেই ত্যাগ করতে পারেন না!
প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল, উনি বোধহয় ওই সিগারেট কোম্পানির সেলসম্যান। কিন্তু, আমার মতো অরসিকের কাছে রস নিবেদন করে যে লাভ নেই, এই বক্তব্যটি যখন পেশ করতে যাচ্ছিলাম, তখন তিনি আবার মুখ খুললেন, কোনো কে আছে নাকি?
কে? আমরাই তো অন্য লোকের কাছ থেকে কে নিয়ে থাকি। আমাকে উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে, বায়রন সায়েব নিজেই বললেন, যে কোনো পারিবারিক বা ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের প্রয়োজন হলে আমাকে পাওয়া যেতে পারে।
বায়রন আরও বললেন, এনি কেস্। সে কেস্ যতই জটিল এবং রহস্যময় হোক না কেন, আমি তাকে জলের মতো তরল এবং দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ করে দেব।
আমি বললাম, আমার হাতে এখন কোনো কেস্ নেই।
টুপিটা মাথায় চড়িয়ে বায়রন উঠে পড়লেন। দ্যাটস্ অল রাইট। দ্যাটস অল রাইট। কিন্তু কেউ বলতে পারে নাÍকবে, কখন আমাকে দরকার পড়বে। তোমার দরকার না পড়–ক, তোমার ফ্রেন্ডদের দরকার পড়তে পারে।
সেই জন্যই বায়রন সায়েব আমাকে একটা কার্ড দিলেন। ওঁর নাম লেখা আছেই ইুৎড়হ, ুড়ঁৎ ভৎরবহফ রহ হববফ. টেলিফোন নম্বর : তার পাশেই লম্বা দাগ। কিন্তু কোনো নম্বর নেই।
বায়রন বললেন, টেলিফোন এখনও হয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতে হবেই। সেই জন্যে জায়গা রেখে দিয়েছি।
বায়রন বলেছিলেন, হবে, ক্রমশ আমার সব হবে। শুধু টেলিফোন কেন, গাড়ি হবে, বাড়ি হবে, মস্ত আপিস হবে। বাবু, ইউ ডোন্ট নো, প্রাইভেট ডিটেটিভ তেমন ভাবে কাজ করলে কী হতে পারে; তোমাদের চিফ জাস্টিসের থেকেও সে বেশি রোজগার করতে পারে।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ! এতদিন তো এঁদের কথা শুধু বইতেই পড়ে এসেছি। বর্ণ-পরিচয়ের পর থেকেই কৈশোরের শেষ দিন পর্যন্ত এই শখের গোয়েন্দাদের অন্তত হাজারখানেক কাহিনি গোপনে এবং প্রকাশ্যে গলাধঃকরণ করেছি। ছাত্রজীবনে যে নিষ্ঠা ও ভক্তি সহকারে ব্যোমকেশ, জয়ন্ত-মানিক, সুব্রত-কিরীটি ও ব্লেক-স্মিথের পুজো করেছি, তার অর্ধেকও যদি যাদব চক্রবর্তী, কে পি বসু, আর নেসফিল্ডের সেবায় ব্যয় করতাম, তাহলে আজ আমার এই দুর্দশা হত না। কিন্তু এতদিন কেবল আমারই মনোরাজ্যে এই সব সত্যানুসন্ধানী রহস্যভেদীরা বিচরণ করতেন। এই মরজগতেÍএই কলকাতা শহরেই যে তারা সশরীরে ঘোরাফেরা করেন তা আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।
পরম বিস্ময় ও শ্রদ্ধা সহকারে বায়রন সায়েবকে আবার বসতে অনুরোধ করলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, চা পানে আপত্তি আছে কি না।
একবার অনুরোধেই উনি রাজি হলেন। চা-এর কাপটা দেড় মিনিটে নিঃশেষ হয়ে গেল। বিদায় নেবার আগে বায়রন বললেন, আমাকে তা হলে ভুলো না।
আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। গোয়েন্দাদের আবার কাজের জন্য লোকের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াতে হয় নাকি? আমি তো জানি, গোয়েন্দা যখন ভোরবেলায় লেক প্লেসের বাড়িতে টোস্ট এবং ওমলেট সহযোগে চা খেতে খেতে সহকারীর সঙ্গে গল্প করতে থাকেন, তখন হঠাৎ টেলিফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বাজতে আরম্ভ করে। একটু বিরক্ত হয়েই নরম সোফা থেকে উঠে এসে রহস্যভেদী টেলিফোন ধরেন। তখন তাকে শিবগড় মার্ডার কেস্ গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। নিহত রাজাবাহাদুরের বিধবা মহিষী কিংবা তার একমাত্র কন্যা নিজে করুণ কণ্ঠে রহস্যভেদীকে অনুনয় করেন, এই কেল্টা আপনাকে নিতেই হবে। টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। আপনি যা চাইবেন তাই দেব।
কিংবা কোনো বর্ষামুখর শ্রাবণ সন্ধ্যায় যখন কলকাতার বুকে দুর্যোগের ঘনঘটা নেমে আসে। ট্রাম-বাস বন্ধ হয়ে যায়, বাইরে বেরোবার কোনো উপায় থাকে না; তখন আপাদমস্তক রেন্ কোট চাপা দিয়ে কোনো অজ্ঞাত পরিচয় অতিথি রহস্যভেদীর ড্রইং রুমে ঢুকে পড়েন। মোটা অঙ্কের একটা চেক টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আগন্তুক তার রহস্যময় অতীতের রোমাঞ্চকর কাহিনি বর্ণনা করতে আরম্ভ করেন। একটুও বিচলিত না হয়ে, রহস্যভেদী বার্মা সিগারের ধোঁয়া ছেড়ে ঠান্ডা মাথায় বলেন, পুলিসের কাছে গেলেই বোধহয় আপনার ভালো হত।
আগন্তুক তখন চেয়ার থেকে উঠে পড়ে তার হাত দুটি ধরে করুণ কণ্ঠে বলেন, প্লিজ, আমাকে নিরাশ করবেন না।
কিন্তু বায়রন সায়েবের একি অবস্থা? নিজেই কাজের সন্ধানে বেরিয়েছেন।
ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের আদালতী কর্মক্ষেত্রে কত বিচিত্র মানুষের আনাগোনা। ভেবেছিলুম বায়রন সায়েবকে সাহায্য করতে পারব। আমারই অনুরোধে আমারই কোনো পরিচিত জনের রহস্য ভেদ করে বায়রন সায়েব হয়তো ভারত-জোড়া খ্যাতি অর্জন করবেন। তাই তাকে বলেছিলাম, মাঝে মাঝে আসবেন।
বার্নিশ করা কালো চেহারা নিয়ে বায়রন সায়েব আবার টেম্পল চেম্বারে এসেছিলেন। এবার ওঁর হাতে কতকগুলো জীবনবীমার কাগজপত্র। প্রথমে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। সামান্য কয়েক মাসের চাকরি-জীবনে আমাকে অন্তত দুডজন এজেন্টের খপ্পরে পড়তে হয়েছে। আড় চোখে বায়রন সায়েবের কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের কর্তব্য স্থির করছিলাম। কিন্তু বায়রন যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারলেন। চেয়ারে বসে বললেন, ভয় নেই, তোমাকে ইন্সিওর করতে বলব না।
লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। আমাকে উত্তর দেবার সুযোগ দিয়েই বায়রন বললেন, ডিটেকটিভের কাজ করতে গেলে অনেক সময় বহুরূপী হতে হয়। ইন্সিওরের দালালিটাও আমার মেকআপ। .
বায়রন সায়েবের জন্য চা আনিয়েছে। চা খেয়ে উনি বিদায় নিয়েছেন।
সত্যি আমার লজ্জা লাগত। যদি ওঁর কোনো উপকার করতে পারতাম তাহলে বিশেষ আনন্দিত হতাম। কিন্তু সাধ থাকলেই সাধ্য হয় না, কোনো কাজই জোগাড় করতে পারিনি। ছোকাদাকে বলেছিলাম, আপনাদের কোনো এনকোয়ারি থাকলে বায়রনকে দিন না।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছোকাদা বলেছিলেন, তোমার হালচাল তো সুবিধে মনে হচ্ছে না, ছোকরা। ওই টেসসা সায়েবের জন্য তোমার এত দরদ কেন? খুব সাবধান। এলিয়ট রোডের ওই মালেদের পাল্লায় পড়ে কত ছোকরার যে টুয়েলভ-ও-ক্লক হয়ে গিয়েছে তা তো জানেন না।
ছোকাদার কথায় কান দিইনি। বায়রনকে বলেছি, আমার লজ্জা লাগে। আপনি কষ্ট করে আসেন অথচ কোনো কাজ দিতে পারি না।
বায়রন আশাবাদী। হা-হা করে হাসতে হাসতে বলেছেন, কে যে কখন কাকে সাহায্য করতে পারে কিছুই বলা যায় না। অন্তত আমাদের লাইনে কেউ বলতে পারে না।
এই সামান্য পরিচয়ের জোরেই বায়রন সায়েব কার্জন পার্কে আমার ক্লান্ত অবসন্ন দেহটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। হ্যাল্লো বাবু! হোয়াট ইজ দি ম্যাটার?
উত্তর না দিয়ে, স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার মূর্তির দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলাম। বায়রন সায়েব কিন্তু ছাড়লেন না। আমার হাত দুটো চেপে ধরলেন। আমাকে না-জিজ্ঞেস করেও এবার বোধহয় সব বুঝতে পারলেন। বললেন, দি ইজ ব্যাড়। ভেরি ব্যাড়।
মানে?
মানে, বি এ সোলজার। সৈন্যের মতো ব্যবহার করো। এই আনফ্রেন্ডলি ওয়ার্ল্ড-এ আমাদের সবাইকে লড়াই করে বাঁচতে হবে। ফাইট টু দি লাস্ট।
বায়রন সায়েবের দেহের দিকে এতক্ষণে ভালো করে নজর দিলাম। বোধ হয় ওঁর দিনকাল একটু ভালো হয়েছে। ধপধপে কোট-প্যান্ট পরেছেন। পায়ে চকচকে জুতো।
জীবনের মূল্য সম্বন্ধে অনেক সারগর্ভ উপদেশ বায়রন সায়েব হুড় হুড় করে বর্ষণ করলেন। হয়তো ভেবেছেন, খেয়ালের বশে জীবনটাকে খরচ করে ফেলার সর্বনাশা অভিসন্ধি নিয়েই আমি এখানে বসে রয়েছি।
উপদেশ বস্তুটি কোনো দিনই আমার তেমন সহ্য হয় না। ঈষৎ তিক্ত কণ্ঠে বললাম, পাষাণ-হৃদয় স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কা কে-টি, সি-আই ই-র চোখের সামনে ওই গাছটাতে অনেক অশান্ত প্রাণ চিরদিনের শান্তি লাভ করেছে। খবরের কাগজে নিশ্চয় দেখে থাকবেন। কিন্তু ভয় নেই, মিস্টার বায়রন, আমি ওই রকম কিছু একটা করে বসব না।
আমার দার্শনিক উত্তরের উপর বায়রন সায়েব কোনো গুরুত্বই আরোপ করলেন না। নিজের মনেই বললেন, চিয়ার আপ। আরও খারাপ হতে পারত। আরো অনেক খারাপ হতে পারত আমাদের।
দূরে পিতলের ঘড়া থেকে এক হিন্দুস্থানি চা বিক্রি করছিল। বায়রন সাহেব হাঁক দিয়ে চা-ওলাকে ডাকলেন। আমি বারণ করেছিলাম, কিন্তু তিনি শুনলেন না। পকেট থেকে ডাইরি খুলে বললেন, এক কাপ শোধ করলাম। এখনও বিয়াল্লিশ কাপ পাওনা রইল।
চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার ফর্সা কোট প্যান্ট আছে?
বললাম, বাড়িতে আছে।
বায়রন সায়েব আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। তাহলে আর ভাববার কিছু নেই। সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা। না-হলে আজই তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে কেন?
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বায়রন সায়েব বললেন, সবই বুঝবে। সময় হলে সবই বুঝতে পারবে। শাজাহান হোটেলের মেয়েটাকে আমিই কি প্রথমে বুঝতে পেরেছিলাম!
কথা থামিয়ে বায়রন সায়েব ঘড়ির দিকে তাকালেন। কতক্ষণ লাগবে? বাড়ি থেকে কোট প্যান্ট পরে এখনই ফিরে আসতে হবে।
কোথায় যেতে হবে?
সে সব পরের কথা। এক ঘন্টার মধ্যে স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার স্ট্যাচুর তলায় তোমাকে ফিরে আসতে হবে। পরের প্রশ্ন পরে করবে, এখন হারি আপ-কুইক্?।
চৌরঙ্গী থেকে কিভাবে সেদিন যে চৌধুরী বাগানে ফিরে এসেছিলাম ভাবতেও আশ্চর্য লাগে। তাড়াতাড়ির মাথায় চলন্ত বাসে উঠতে গিয়ে অনেকের পা মাড়িয়ে দিয়েছি। বাসের প্যাসেঞ্জাররা হাঁ হাঁ করে উঠেছেন। কিন্তু আমি বেপরোয়া। কিল-চড়-ঘুষি খেয়েও বাসে উঠতে প্রস্তুত ছিলাম।
দাড়ি কামিয়ে এবং সবেধন নীলমণি স্যুটটি পরে যখন কার্জন পার্কে ফিরে এলাম তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। চৌরঙ্গীর রাত্রি ইতিমধ্যেই মোহিনী রূপ ধারণ করেছে। চোখধাঁধানো নিয়ন আলোর ঝলকানিতে কার্জন পার্ককেও যেন আর-এক কার্জন পার্ক মনে হচ্ছে। দুপুরে যে কার্জন পার্কের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল সে যেন কোথায় উবে গিয়েছে। বহুদিনের বেকার ছোকরা যেন হঠাৎ হাজার-টাকা-মাইনের-চাকরি পেয়ে বান্ধবীর সঙ্গে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে।
কাব্য বা কোটেশন কোনোটারই ভক্ত নই আমি। কিন্তু অনেকদিন আগে পড়া কয়েকটা কবিতার লাইন মনে করবার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। এই কার্জন পার্ক দেখেই সমর সেন লিখেছিলেন :
আজ বহুদিনের তুষার স্তব্ধতার পর
পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ।
তাই বসন্তের কার্জন পার্কে
বর্ষার সিক্ত পশুর মতো স্তব্ধ বসে
বক্?দেহ নায়কের দল
বিগলিত বিষণ্ণতায় ক্ষুরধার স্বপ্ন দেখে
ময়দানে নষ্টনীড় মানুষের দল।
ফরাসি ছবির আমন্ত্রণে, ফিটনের ইঙ্গিতে আহ্বানে
খনির আগুনে রক্ত মেঘ সূর্যাস্ত এল।
দেখলাম, মালিশওয়ালা, বাদামওয়ালা, চাওয়ালারা দল বেঁধে পার্কের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে। ধোপভাঙা স্যুটে আমাকেও যে আর বেকারের মতো দেখাচ্ছিল না, তার প্রমাণ হাতে-নাতে পেলাম। মালিশওয়ালা কাছে এগিয়ে এসে বললে, মালিশ সাব।
না, বলে এগিয়ে যেতে, মালিশওয়ালা আরো কাছে সরে এসে চাপা গলায় বললে, গার্ল ফ্রেন্ড সা? কলেজ গার্ল-পাঞ্জাবি, বেঙ্গলি, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানৃ। তালিকা হয়তো আরও দীর্ঘ হত, কিন্তু আমি তখন বায়রন সায়েবকে ধরবার জন্য উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছি। আমার জন্য অপেক্ষা করে করে হয়তো তিনি এতক্ষণে চলে গিয়েছেন। হয়তো চিরদিনের জন্য একটা অমূল্য সুযোগ আমার হাতছাড়া হয়ে গেল।
না। বায়রন সায়েব চলে যাননি। স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার পায়ের তলায় চুপচাপ বসে আছেন। রাতের অন্ধকারের সঙ্গে ওঁর কালো দেহটা যেন একেবারে মিশে গিয়েছে। ওঁর সাদা শার্ট আর প্যান্টটা যেন কোনো অদৃশ্য মানুষের লজ্জা নিবারণ করছে।
আমাকে দেখেই বায়রন সায়েব উঠে পড়লেন। বললেন, তুমি যাবার পর অন্তত দশটা সিগারেট ধ্বংস করেছি। ধোঁয়া ছেড়েছি আর ভেবেছি, ভালোই হল। তোমারও ভালো হবে, আমারও!
কার্জন পার্ক থেকে বেরিয়ে স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তিকে বাঁ দিকে রেখে সেন্ট্রাল এভিন ধরে আমরা শাজাহান হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি।
হাঁটতে হাঁটতে বায়রন সায়েবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল। ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটে তার কোনো উপকারই করতে পারিনি। হঠাৎ মনে হল, আমি ভালোভাবে চেষ্টাও করিনি। অনেক অ্যাটর্নির সঙ্গেই তো আমার পরিচয় ছিলÍসায়েব ব্যারিস্টারের বাবুর অনুরোধ উপেক্ষা করা তাঁদের পক্ষে বেশ মুশকিল হত। কিন্তু নিজের সম্মান রক্ষার জন্য সেদিন কারুর কাছে মাথা নত করিনি। আর আজ বায়রন সায়েবই আমার জীবনপথের দিশারি। বায়রন সায়েব বললেন, তোমার চাকরি হবেই। ওদের ম্যানেজার আমার কথা ঠেলতে পারবে না।
ওই শাজাহান হোটেলÍবায়রন দূর থেকে দেখালেন।
কলকাতার হোটেলকুলচূড়ামণি শাজাহান হোটেলকে আমিও দেখলাম। গেটের কাছে খান পঁচিশেক গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরও গাড়ি আসছে। দারোয়ানজি বুকে আট-দশখানা মেডেল ঝুলিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আর মাঝে মাঝে গাড়ি-বারান্দার কাছে এগিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিচ্ছেন। রাতের পোশাক-পরা এক মেমসায়েব টুপ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। তার পিছনে বো-টাই পরা এক সায়েব। লিপস্টিক মাখা ঠোঁটটা সামান্য বেঁকিয়ে ঢেকুর তোলার মতো কায়দায় মেমসায়েব বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। সায়েব এতক্ষণে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাতটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি। মেমসায়েব সেটিকে নিজের হাতের মধ্যে গ্রহণ করে ভিতরে ঢুকে পড়লেন। দারোয়ানজি সেই সুযোগে বুটের সঙ্গে বুট ঠুকে সামরিক কায়দায় সেলাম জানালেন। প্রত্যুত্তরে ওঁদের দুজনের মাথাও স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো একটু নড়ে উঠে আবার স্থির হয়ে গেল।
দারোয়ানজি এবার বায়রন সায়েবকে দেখতে পেলেন। এবং বিনয়ে বিগলিত হয়ে একটা ডবল সাইজের সেলাম ঠুকলেন।
ভিতরে পা দিয়েই আমার মানসিক অবস্থা যা হয়েছিল তা ভাবলে আজও আশ্চর্য লাগে। হাইকোর্টে সায়েবের দৌলতে অনেক বিলাসকেই দেখেছি। হোটেলও দেখেছি কয়েকটা কিন্তু শাজাহান হোটেলের জাত অন্য। কোনো কিছুর সঙ্গেই যেন তুলনা চলে না।
বাড়ি নয়তো, যেন ছোটখাটো একটা শহর। বারান্দার প্রস্থ কলকাতার অনেক স্ট্রিট, রোড, এমনকি এভিন্যুকে লজ্জা দিতে পারে।
বায়রন সায়েবের পিছন পিছন লিফটে উঠে পড়লাম। লিফট থেকে নেমেও তাকে অনুসরণ করলাম। কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। মে মাসের সন্ধ্যায় যেন ডিসেম্বরের শীতের নমুনা পেলাম।
বায়রন সায়েবের পিছনে পিছনে কতবার যে বাঁ দিকে আর ডান দিকে মোড় ফিরেছিলাম মনে নেই। সেই গোলকবাঁধা থেকে একলা বেরিয়ে আসা যে আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল তা নিশ্চিত। বায়রন সায়েব অবশেষে একটা দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালেন।
বাইরে তকমা পরা এক বেয়ারা দাঁড়িয়েছিল। সে বললে, সায়েব কিছুক্ষণ হল ফিরেছেন। কিচেন ইন্সপেকশন ছিল। ফিরেই গোসল শেষ করলেন। এখন একটু বিশ্রাম করছেন।
বায়রন মোটেই দমলেন না। কোঁকড়া চুলগুলোর মধ্যে আঙুল চালিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর বেয়ারাকে বললেন, বলো বায়রন সায়েব।
মন্ত্রের মতো কাজ হল। বেয়ারা ভিতরে ঢুকে চার সেকেন্ডের মধ্যে বেরিয়ে এল। বিনয়ে ঝুঁকে পড়ে বললে, ভিতর যাইয়ে।
শাজাহান হোটেলের দ-মু-ের কর্তা মার্কোপোলোকে এই অবস্থায় দেখবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। একটা হাতকাটা গেঞ্জি আর একটা ছোট্ট আন্ডার প্যান্ট লাল রংয়ের পুরুষালি দেহটার প্রয়োজনীয় অংশগুলোকে কোনোরকমে ঢেকে রাখবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। বস্ত্রস্বল্পতা সম্বন্ধে ওঁর কিন্তু কোনো খেয়াল নেই, যেন কোনো সুইমিং ক্লাবের চৌবাচ্চার ধারে বসে রয়েছেন।
কিন্তু আমাকে দেখেই মার্কোপোলো আঁতকে উঠলেন। এক্সকিউজ মি, এক্সকিউজ মি, বলতে বলতে উনি তড?াং করে বিছানা থেকে উঠে আলমারির দিকে ছুটে গেলেন। ওয়ারড্রোব খুলে একটা হাফপ্যান্ট বের করে তাড়াতাড়ি পরে ফেললেন। তারপর পায়ে রবারের চটিটা গলিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। দেখলাম সায়েবের গলায় মোটা চেনের হার; হারের লকেটটা কালো রংয়ের, তাতে কী সব লেখা। বাঁ হাতে বিরাট উল্কি। রোমশ বুকেও একটা উল্কি আছে; তার কিছুটা গেঞ্জির আড়াল থেকে উঁকি মারছে।
ভেবেছিলাম বায়রন সায়েবই প্রথম কথা পাড়বেন। কিন্তু ম্যানেজারই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন। সিগারেটের টিনটা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো খবর আছে নাকি?
চলবে…….




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com