রিজার্ভ সংকট মেটাতে শর্তসাপেক্ষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তফবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ঋণ মেটাতে রাজস্ব আদায় বাড়ানোয় গুরুত্ব দিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসকে (ইএফডি) ‘গেম চেঞ্জার’ বলছে সংস্থাটি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে ইএফডি সম্প্রসারণে এখন পর্যন্ত বড় কোনো অগ্রগতি নেই। এনবিআরের অপারগতায় বেসরকারি সংস্থার হাতে কাজ দিয়েও কাটছে না সংকট।
জানা যায়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিসের হাতে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট সংগ্রহের যন্ত্র ইএফডি দেওয়া হয় ২০২২ সালে। তবে যন্ত্রটি সম্প্রসারণে তারা বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি এখন পর্যন্ত। পৌঁছাতে পারেনি লক্ষ্যে। আবার রাজধানীর কিছু দোকানে ইএফডি যন্ত্র থাকলেও তা ব্যবহার করতে চান না ক্রেতা-বিক্রেতারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুচরা বিপণিগুলোকে ভ্যাটযন্ত্রের আওতায় আনার প্রক্রিয়ায় ব্যর্থ হয়েছে এনবিআর। বেসরকারি খাতে দেওয়ার পরেও এর সম্প্রসারণে দীর্ঘসূত্রতায় হতাশ তারা। এনবিআরের দেখানো পথেই হাঁটছে দায়িত্ব পাওয়া জেনেক্স ইনফোসিস।
চলতি বছর ২০ হাজার মেশিন বসানোর লক্ষ্য রয়েছে জেনেক্স ইনফোসিসের। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বড় শহরের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেশ ভালো এমন উপজেলা সদরের দোকানপাটেও আগামী পাঁচ বছরে ভ্যাটের প্রায় লাখখানেক যন্ত্র বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআরের। খুচরা দোকানগুলোকে ক্যাটাগরাইজড করে দেওয়া হবে যন্ত্র। অর্থাৎ, কোনো এলাকার মিষ্টির দোকানে ওই যন্ত্র বসালে একসঙ্গে সব দোকানেই বসানো হবে। শিগগির ঢাকা-চট্টগ্রামে বসবে আড়াই হাজার মেশিন।
ভ্যাট খাতে আমূল পরিবর্তন নিশ্চিত করা এবং ফাঁকি রোধে ২০১৯ সালের আগস্টে পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাঁচটি ভ্যাট কমিশনারেটে ইএফডি চালু করে এনবিআর। যদিও চার বছর পেরিয়ে গেলেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত মাত্র ৯ হাজার ৪৪৯টি ইএফডি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মূসক নিবন্ধনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চার লাখ ৩২ হাজার ৯৫৫টি। পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব দেখিয়ে ২০২২ সালে জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে এনবিআর। এর আওতায় ইএফডি যন্ত্র আমদানি, দোকানে বসানো ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। যদিও এখনো পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু করেনি জেনেক্স ইনফোসিস। চুক্তির আওতায় আগামী পাঁচ বছরে তিন লাখ ইএফডি বসানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বিনামূল্যে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিপণিবিতানে ইএফডি মেশিন বসাবে। বিনিময়ে প্রতি ১০০ টাকা ভ্যাটে কমিশন হিসেবে পাবে ৫২ পয়সা। কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন যন্ত্র বসানোর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনই করতে পারেনি রাজস্ব বোর্ড।
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, শুধু একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব না দিয়ে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া যেত। এছাড়া সবাইকে একসঙ্গে ইএফডির আওতায় না আনলে বৈষম্য তৈরি হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ব্যবসায়ীরা।
প্রথমে বিনামূল্যে দিলেও ব্যবসায়ীদের ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে যন্ত্রটি ২০ হাজার ৫৩৩ টাকায় কিনতে বলে এনবিআর। সে সময় কোনো ব্যবসায়ী যন্ত্রটি কিনতে আগ্রহ দেখাননি।
জেনেক্স সূত্রে জানা যায়, প্রায় ২০ হাজার ইএফডি যন্ত্র এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) করা হয়েছে। তার মধ্যে তিন হাজার এরই মধ্যে হাতে পৌঁছেছে। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন। শিগগির উদ্বোধনের মাধ্যমে যন্ত্রটি বসানোর কাজ এগিয়ে যাবে। জানতে চাইলে জেনেক্স ইনফোসিসের সেক্রেটারি মোস্তাক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের কার্যক্রম চলমান। কাজ শুরু হয়েছে। এলসি হচ্ছে, আমরা মেশিন আনছি। এটা শিগগির উদ্বোধন হবে। তিন হাজারের বেশি মেশিন আছে। এগুলো নিয়ে পর্যায়ক্রমে কাজ চলছে। এটি বাস্তবায়ন করতেও সময় লাগবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ডলার সংকট, আমদানিতে বাধাসহ নানা কারণে ইএফডি আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। ইএফডির কাজও দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। ভুল থেকে আমরা শিখছি। ভ্যাট সংস্কৃতিতে মানুষ অভ্যস্ত হচ্ছে। আমরা চিন্তা করছি সামনে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়।
দোকানে আছে, ব্যবহার কম
রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মার্কেটের স্বর্ণের দোকানগুলোতে দেওয়া হয়েছে ইএফডি যন্ত্র। যদিও গত ৬ জুলাই মাত্র কয়েকটি দোকানের ডিসপ্লে টেবিলে দেখা যায় যন্ত্রটি।
বুলবুল জুয়েলার্সে গিয়ে দেখা যায়নি ইএফডি যন্ত্রটি। ইএফডির কথা জানতে চাইলে দোকানটির বিক্রয়কর্মী পারভেজ সেলফের ভেতর থেকে ইএফডি যন্ত্রটি বের করে দেখান। ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি করার সময় কেবল যন্ত্রটি বের করা হয় বলে জানান তিনি।
তবে জুয়েলারির দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, ক্রেতা পণ্য কিনে হাতে লেখা রশিদ বুঝে নিচ্ছেন। যদিও জাগো নিউজকে পারভেজ বলেন, সব দোকানে ইএফডি আছে। আমরা এটি দিয়েই ক্রেতাদের চালান তৈরি করি।
আল ইহসান জুয়েলার্সে গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। দোকানটির স্বত্বাধিকারী মাঈনুদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, কাস্টমার ইএফডিতে পেমেন্ট করতে চায় না। ভ্যাট দিতে চায় না। আমরা চেষ্টা করি ইএফডি ব্যবহার করতে। তিনি বলেন, কাস্টমার এক লাখ টাকায় পাঁচ হাজার টাকা ভ্যাট দিতে চায় না। এটা যদি কম হতো তাহলে তারা দিতে চাইতো। এখন এক আনা স্বর্ণের দাম ছয় হাজার টাকা। কেউ এক আনা স্বর্ণের দাম সমান ভ্যাট দিতে চায় না। চোখের সামনে দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা তাদের চলে যায়। অনেকেই ভ্যাট জিনিসটা বোঝেন না।
এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু জাগো নিউজকে বলেন, ইএফডি মেশিন ওপেন করে দেওয়া উচিত। একটি কোম্পানিকে নয়, অনেকগুলা কোম্পানিকে ভ্যাট আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। তাহলে এর কার্যক্রমে গতিশীলতা আসবে।
তিনি বলেন, সব দোকানে এই যন্ত্রটি না থাকায় বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। যে দোকানে ইএফডি মেশিন থাকবে, সে শতভাগ ভ্যাট আদায় করছে। কিন্তু পাশের দোকানে ইএফডি মেশিন নেই, কাস্টমার দেখবে সেখানে তো খরচ কম পড়ছে। কাস্টমার ইএফডি নেই যে দোকানে সেখানে ছুটে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেকেই ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, একটা প্রতিষ্ঠানের হাতে এর দায়িত্ব দেওয়া হলে দীর্ঘসূত্রতা হবে, এটা আগেই বলেছি। এখন তাই হচ্ছে। সবার সঙ্গে বসে এক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। তিনি বলেন, ভ্যাট দেবে জনগণ। আমরা ইএফডি চাই। কিন্তু এনবিআর তো সব দোকানে যন্ত্রটা দিতে পারেনি। যাদের যন্ত্রটা দেওয়া হয়েছে, তারাই বিপদে পড়েছেন।