উন্নয়ন প্রচার প্রগলভতা প্রকাশ তত্ত্বে বিশ্বাসীরা মাঝে মধ্যে বলেই ফেলেন, সাধারণ মানুষ সুশাসন বোঝে না, তারা বোঝে উন্নয়ন। তাদের ধারণা সুশাসন কী জিনিস, দেখতে কেমন, তা খায় না মাথায় মাখে তা আমজনতা জানে না, বোঝেও না। সুতরাং জনগণকে সুশাসন উপেক্ষিত উন্নয়নের চমক দেখানো সহজ। প্রকৃত প্রস্তাবে সুশাসন উপেক্ষিত উন্নয়নের জন্য মোটাদাগে ধারকর্জ, দুর্নীতি সবই চলে সহজে এবং সমাজ ও অর্থনীতিতে বণ্টনবৈষম্য তৈরি হয়। সে কারণেই স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এসব শব্দ প্রায়ই ব্যবহৃত হয় গণতন্ত্রের নান্দিপাঠে, নির্বাচনী ইশতেহারে, কোন কোন পরিবেশ পরিস্থিতিতে বেশি বেশি উচ্চারিত হয় আঁতেল আমলা আর ব্যবহারজীবীদের মুখে। সুশাসনের অভাবহেতু উদ্বেগ-উচ্চারণেই গড়ে ওঠে হরেক প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও সংস্থা এবং এমনকি একে কেন্দ্র করে বড় বড় প্রকল্পে ব্যবহারজীবীরা আয়-রোজগারও করে থাকেন। এটি অনস্বীকার্য যে, সুশাসন সামষ্টিক উন্নয়নের প্রধান পূর্বশর্ত এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠাই পরিচালনার (good governace) অন্যতম অনুষঙ্গ। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা চাইলে চিন্তুাভাবনায়, নীতি পরিকল্পনায় ও কর্মে সবাইকে স্বচ্ছ এবং সর্বত্র জবাবদিহির পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল সব গণপ্রজাতন্ত্রের অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রেরণা। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের জন্য জনগণের দ্বারাই জনগণের সরকার নির্বাচিত হবে এমনটি নিয়ম। রাষ্ট্রে যেকোনো ব্যবস্থাপনায় সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ সাধনার সফলতার ওপর নির্ভর করবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শক্তিশালী অবস্থান ও বিকাশ।
আরেকটি বিষয়, রাষ্ট্রীয় সম্পদ, সৌভাগ্য তথা স্বাধীনতার সুফল সবার মধ্যে সুষম বণ্টন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও সুনিশ্চিত সুশাসন এবং জবাবদিহির সুযোগ ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা গড়ে ওঠে না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য অযুত ত্যাগ স্বীকারের প্রকৃত প্রতিফল অর্জন সম্ভব হয় না সুশাসন সুনিশ্চিত না হলে। সম্পদ অর্জনের নৈতিক ভিত্তি বা প্রক্রিয়া স্বচ্ছ না হলে বণ্টন ব্যবস্থাপনাও সুষ্ঠু হয় না। বাংলাদেশে ধনীর সংখ্যা প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান, দেশের অর্থ খাত, স্বাস্থ্য শিক্ষা, প্রশাসন, ব্যবসায়-বাণিজ্য এমন কি খোদ রাজনীতিও সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে গেলে এটি আশঙ্কা ও উদ্বেগের হেতুতে পরিণত হবে। সমাজে বণ্টনবৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে সুশাসন প্রেরণা ও প্রভাবক ভূমিকা পালন করে থাকে। এটি দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার জন্যও জরুরি। যেমন- আজকাল এক দেশ বা অর্থনীতির প্রচুর অর্থ বিদেশে কিংবা অন্য অর্থনীতিতে দেদার পাচার হয়ে থাকে। বিনা বিনিয়োগে বা বিনা পরিশ্রমে প্রকৃত পণ্য ও সেবা উৎপাদন ব্যতিরেকে অর্থ অর্জিত হলে অবৈধভাবে অর্জিত সেই অর্থ পাচার হবেই। অর্থ বৈধ পন্থায় উপার্জিত না হলে সেই অর্থের মালিকানার প্রতি দায়-দায়িত্ববোধও গড়ে ওঠে না। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি শক্তিশালীকরণেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক পরিবেশের আবশ্যকতা রয়েছে। কেননা, সমাজে একপক্ষ বা কতিপয় কেউ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মধ্যে থাকলে, আর অধিকাংশ অন্যজন কারো কাছে কোনো জবাবদিহির মধ্যে না থাকলে অর্থাৎ একই যাত্রায় ভিন্ন আচরণে নিষ্ঠ হলে পারস্পরিক অভিযোগের নাট্যশালায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই হয় না, জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে না। সমতা বিধানের জন্য, সবার প্রতি সমান আচরণের (যা গণতন্ত্রের মর্মবাণী) জন্যও স্বচ্ছতা তথা আস্থার পরিবেশ প্রয়োজন।
সুশাসনের অবর্তমানে জবাবদিহিশূন্য পরিবেশে, আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতার অবয়বের (cause) অন্যতম প্রতিফল (effect) হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি শুধু ব্যক্তিবিশেষ অর্থাৎ যে দুর্নীতি করে তাকে ন্যায়নীতিহীনতার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করে তা নয়, তার দ্বারা সমাজকে নেতৃত্বদান বা যেকোনো ক্ষেত্রে দৃঢ়চিত্ত অবস্থান গ্রহণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। সর্বত্র তাকে দুর্বল করে দেয়। দুর্নীতিবাজ নেতৃত্বের জন্য বা কারণে সমাজে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়। নেতৃত্বের এই অধোগতির প্রেক্ষাপটই প্রত্যক্ষভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবজনিত পরিবেশ নির্মাণ করে। যেকোনো দেশ সমাজ ও অর্থনীতিতে নেতৃত্বের কার্যকলাপে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকলে সে নেতৃত্বের অধীনে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়। এটি পরস্পর প্রযুক্ত সমস্যা। করোনা প্রতিরোধ মোকাবেলা বা নিরাময় কর্মসূচি বাস্তবায়নে সবার স্বতঃস্ফূর্ত সজ্ঞান সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল। স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনার নামে ব্যয়িত বিপুল অর্থ (করের টাকা, বিদেশী অনুদান ও ধারকর্জের টাকা) বেহাত হয়েছে এ ধরনের গুজব কেন রটবে? টিকার দরদাম ও সাপ্লাই নিয়ে শ্বেতপত্র দেয়া দরকার ছিল। শিক্ষায় যে আসল বিনিয়োগ সেখানে অমনোযোগিতা দেশের ভবিষ্যৎ ইমিউন ক্ষমতাকে খর্ব করতে পারে এ উপলব্ধি শাণিত করতে না পারা সবার জন্য বড় ব্যর্থতা। সব ক্ষেত্রে আস্থার পরিবেশ সৃজন বা বৃদ্ধি ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মানানোর প্রয়াস সফল হয় না। এ প্রসঙ্গে আইএমএফের ‘ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ প্রকাশনাটির WINTER 2021 : THE HEALTH ISSUE msL¨vi Denmark : ItÕs a matter of trust লেখাটার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষিত হতে পারে। দুর্নীতি সূচকে সবার নিচের দেশ ডেনমার্কের জনগণ সে দেশের সরকার গৃহীত অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যসুরক্ষা (জীবন ও জীবিকা) কর্মসূচির প্রতি আস্থাবান হয়েই সাড়া দিয়েছে। আইএমএফের পর্যবেক্ষণ, ‘..Social trust is paramount in Denmark. Citizens trust that the government will enact policies in the publicÕs interest. Government trusts that citizens will maintain the social fabric. People trust that their fellow Danes will do what is required for the greater good. This social phenomenon played out during the pandemic, leading to a remarkably successful effort at stemming the virus at a relatively low human cost.’ স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার অনুপস্থিতির অবসরে আত্মঘাতী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেমন- যেকোনো সেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ। যেমন- স্বেচ্ছাচারিতায়, নানান অনিয়ম ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে শিক্ষায়তনে শিক্ষক, সুশীল সেবক, হাসপাতালে চিকিৎসক কিংবা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীতে কর্মীবাহিনী নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি, তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার সবই প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়ায়। অর্থ বিনিময় ও নানান অনিয়মের কারণে যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে ভালো ও যোগ্য সুশীল সেবক, চিকিৎসক, শিক্ষক আইন রক্ষক নিয়োজিত হতে পারে না। সুশীল সেবক, চিকিৎসক অমেধাবী ও অযোগ্য শিক্ষক ও আইন রক্ষকের কাছ থেকে গুণগতমানসম্পন্ন প্রশাসনিক সেবা, চিকিৎসা, শিক্ষা বা তালিম বা অনুসরণীয় আদর্শ লাভ সম্ভব হয় না।
অবৈধ লেনদেনে নিয়োগপ্রাপ্ত অযোগ্য সেবক, চিকিৎসক কিংবা শিক্ষকের কাছে কার্যকর সেবা, চিকিৎসা ও শিক্ষা পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।
যেসব নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য চলে সেখানে মেধাবী ও উপযুক্ত প্রার্থীরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। তাদের বিপরীতে নিয়োগ পায় অদক্ষ-অযোগ্য লোক। এটি একটি দিক। আরেকটি দিক, কেউ বিশেষ গোষ্ঠীর সমর্থক হয়ে এবং অবৈধভাবে অর্থ দিয়ে নিয়োগ পেলে সে প্রথমে চাইবে গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে সেবা চিকিৎসা ও শিক্ষার পরিবেশকে বিপন্ন করে ওই অর্থ তুলতে। সে ক্ষেত্রে সে প্রয়োজন হলে যেকোনোভাবে (কর্তব্য দায়িত্বহীন হয়ে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করা থেকে শুরু করে নানা ফাঁকিঝুঁকি ও পক্ষপাতিত্ব অবলম্বন করে) ইচ্ছা করে নীতি নৈতিকতা ভুলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ উঠিয়ে নেবে। তখন সে তার চাকরি বা দায়িত্বশীলতার দিকে নজর দেবে না। কোনো পদপ্রার্থী কর্তৃক কোনো সংস্থা ও সংগঠনে স্রেফ প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার সময় কিংবা কোনো সংস্থায় নিয়োগ পাওয়ার সময় যে অর্থ ব্যয় করে তা নিঃসন্দেহে একটি মারাত্মক মন্দ বিনিয়োগ। এতে সমাজ দু’দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমত, একজন ভালো যোগ্য প্রার্থীর স্থলে একজন দুর্নীতিবাজ অদক্ষের অবস্থান সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং দ্বিতীয়ত, সে চিকিৎসা কিংবা লেখাপড়ার পরিবেশ বা প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে করে এমনভাবে কলুষিত করতে পারে তাতে যুগ যুগ ধরে দুষ্ট ক্ষতেরই সৃষ্টি হয়। আজকাল সবাই ভুক্তভোগী যে পাবলিক ও প্রাইভেটসহ সবক্ষেত্রেই যেকোনো সেবা, নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি সব ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা ও দেদার চলে অর্থ লেনদেনের ছড়াছড়ি। অবস্থা এমন অর্থ খরচ ব্যতীত বিনামূল্যে প্রাপ্য কোনো সাধারণ সেবা পর্যন্ত মিলবে না।
উপরির বিনিময়ে যেকোনো ন্যায্য সেবাও বিক্রি করা হয়, সম্পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে আত্মসাৎ অপচয়, অপব্যয় লাগামহীন করে তুলতে পারে। স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে গণপ্রতিনিধিরা নির্বাচনের সময় ভোটারদেরকে বলছেন তাদেরকে ‘সমাজসেবার সুযোগ’ দিতে। কিন্তু সেখানে যদি দেখা যায় সমাজ সেবার সুযোগ পাওয়ার জন্য ভালো পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে তাহলে কথিত ‘সমাজসেবা’ তো বিনিয়োগ ব্যবসায় পরিণত হবে। কেননা, নির্বাচিত হয়ে কোনো পদে গেলে আলোচ্য ব্যক্তি নিজের বিনিয়োজিত অর্থটা আগে তুলে নেবেন। ফলে উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়ে অন্য দিকে চলে যায়। সে ক্ষেত্রে জনস্বার্থ বিঘিœত হয়। তহবিল তছরুপ, আত্মসাৎ, সম্পদের ও ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে স্বচ্ছতা-জবাবদিহির অনুপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায় হলো- যার যা কাজ তাকে সেভাবে করতে দেয়া বা ক্ষমতা দেয়া। যেমন- স্থানীয় সরকার। স্থানীয় সরকার পরিচালনা আয় ব্যয় ব্যবস্থাপনার ভার স্থানীয় সরকারের হাতে দেয়া হলে সে সরকার হবে প্রকৃত প্রস্তাবে তার নির্বাচকম-লীর কাছে জবাবদিহিমূলক স্থানীয় পর্যায়ের সরকার। স্থানীয় সরকারই সেখানকার ভোটারদের কাছে জবাবদিহি করবে। স্থানীয় সরকার পরিচালনার জন্য সেখান থেকে তারা যে কর নেবেন তা থেকেই সেখানে সেবামূলক কাজ নিশ্চিত করবেন, যে প্রতিশ্রুতি তারা দেবেন তা তারাই পূরণ করবেন। তাহলেই সেটি অর্থবহ ও কার্যকর হবে। স্থানীয় সরকারকে পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ থাকতে হবে। তবেই স্থানীয় সরকার শব্দটির যথার্থতা ফুটে উঠবে। জাপানে দেখেছি এক এক প্রিফেকচার বা প্রদেশ বা রাজ্য নিজ নিজ আয় ব্যয় উন্নয়নের জন্য সার্বিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সেখানে এক স্থানীয় সরকার অপর স্থানীয় সরকারের চাইতে সরকার পরিচালনায় কতটা পারদর্শী তার প্রতিযোগিতা চলছে। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনায় দু’টি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে- এক, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হওয়ায় সমাজ সংসারের দোরগোড়ায় পর্যন্ত চলে গেছে বিভক্তির রাজনীতি এবং স্থানীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত, পরিচালিত হয় কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রিত বাজেটে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে এটি একটি অনির্বচনীয় চ্যালেঞ্জ।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান