এই মুহূর্তে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রফতানি করা মংস্য সম্পদের মধ্যে চিংড়ির পরই সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় পণ্য হচ্ছে কাঁকড়া। এর মধ্যে শক্ত খোলসের মধ্যে নরম খোসার কাঁকড়া, যাকে সফটশেল কাঁকড়া বলে তার চাহিদা বিদেশে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশে যেসব জেলায় সফটশেল কাঁকড়া উৎপাদিত হয়, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাতক্ষীরা জেলা। এই জেলার মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেছেন, জুন-অগাস্ট মাসে বিশেষ করে সফটশেল কাঁকড়ার চাহিদা বিদেশে বেশি থাকে। ‘সফটশেল কাঁকড়া যেটা এটারই বেশি চাহিদা এখন। বছরে এটাই প্রায় দুই হাজার মেট্রিক টনের মতো উৎপাদিত হয়,’ বলেছেন আনিছুর রহমান। ‘এমনকি কাঁকড়া যেটা হার্ড থাকে, সেটা খাওয়াটা বেশ কষ্টকর। আর এটার যেহেতু শেল থাকে না, সফট হয়ে যায় পুরো বডিটা, তাই যেকোনো বয়সের মানুষ এটা খেতে পারে,’ বলেন তিনি। খুলনা বিভাগীয় মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দফতরের কর্মকর্তা লিপ্টন সর্দার
বিবিসি বাংলাকে বলেন, সফটশেল কাঁকড়ার রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে। গত চার বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সফটশেল কাঁকড়ার রফতানি উর্ধ্বমুখী রয়েছে। মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপ্টন সর্দার জানান, সফটশেল কাঁকড়া ফ্রোজেন অবস্থায় রফতানি করা হয়।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুধু খুলনা অঞ্চল থেকে ৬২২ মেট্রিকটন সফটশেল কাঁকড়া রফতানি করা হয়েছে। এ খাতে আয় হয়েছে ৮৬ লাখ ৯৮৮মার্কিন ডলার। মূলত যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয় ইউনিয়নভূক্ত কয়েকটি দেশ এবং সিঙ্গাপুরে সফটশেষ কাঁকড়া রফতানি করা হয়। মৎস্যখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই খাতকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হলে এবং এ খাতের সমস্যাগুলো সমাধান করা গেলে কাঁকড়া রফতানি থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।
পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ কাঁকড়া চাষ ও বাজারজাতকরণের সাথে যুক্ত আছেন।
সাতক্ষীরা জেলার মৎস অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, শুধু এই জেলাটিতেই ৩০ হাজার মানুষ কাঁকড়া চাষের সাথে জড়িত।
‘সফটশেল’ কাঁকড়া কী? কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মিঠা ও লবণাক্ত পানি মিলে মোট ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয় ম্যাডক্র্যাব বা শিলা কাঁকড়া। এটির ওজন সর্বোচ্চ সাড়ে তিন কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
দেশে উৎপাদিত এই শিলা কাঁকড়া তার জীবদ্দশায় ১৪-১৬ বার খোলস বদল করে থাকে। খোলস বদল করার সময় তিন ঘণ্টার বেশি সময় এটির দেহ খোলসহীন অবস্থায় পাতলা আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। তখন এটিকে রফতানির জন্য তুলে ফেলা হয়। নরম এই কাঁকড়াকেই বলা হয় ‘সফটশেল’ কাঁকড়া।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: আনিছুর রহমান বলেন, ‘সফটশেল’ কাঁকড়া চাষের ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা পরপরই দেখতে হয় যে কাঁকড়া খোলস পাল্টেছে কিনা। তাই এই কাঁকড়া চাষের সাথে সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও এর আশপাশের অনেক নারী জড়িত। তাদের শ্রম পুরুষদের তুলনায় সস্তা হওয়ার কারণে এই শিল্পে তাদের অংশগ্রহণ বেশি।
কাঁকড়ার দাম কত? বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দেশ থেকে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলারের কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়েছিল। এর মধ্যে শক্ত খোলসের কাঁকড়াও রয়েছে। শক্ত খোলসের কাঁকড়ার প্রধান বাজার চীন। সেখানে এই কাঁকড়া জীবন্ত রফতানি করা হয়।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মথুরাপুর গ্রামের বাসিন্দা তাপস কুমার ম-ল শ্যামনগরের হরিনগর এলাকা থেকে কাঁকড়া ঢাকায় পাঠান। তিনি স্থানীয় ডিলারদের কাছেই কাঁকড়া বিক্রি করেন।
প্রতিদিন ৪০-৫০ কেজির মতো কাঁকড়া সংগ্রহ করেন তিনি। তবে যেদিন কাঁকড়ার দাম বেশি থাকে সেদিন বেশি পরিমাণে পাঠানোর চেষ্টা করেন।
তার নিজের কাঁকড়ার ঘের রয়েছে। সেখানে কাঁকড়া মোটাতাজা করা হয়। কাঁকড়ার দাম সম্পর্কে তাপস ম-ল বলেন, কাঁকড়ার ওজন অনুযায়ী গ্রেড ও দাম ঠিক করা হয়। ওজন যত বেশি, দামও তত বেশি।
পুরুষ কাঁকড়া ৫০০ গ্রাম ওজনের হলে ১৪০০ টাকা করে কেজি বিক্রি হয়। আর স্ত্রী কাঁকড়া ২০০ গ্রাম ওজনের হলেই সেটি ১৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা যায়। এর চেয়ে কম ওজনের কাঁকড়া গড়ে ৮০০-৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় বলেও তিনি জানান। তবে এই দাম ওঠানামা করে বলেও জানান তিনি। সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হয় ‘রিজেক্ট’ কাঁকড়া। অর্থাৎ যেগুলোর ওজন কম, হাত-পা ভেঙে গেছে ইত্যাদি।
তাপস ম-ল বলেন, ‘যেগুলো রিজেক্ট ওগুলো আমরা নেই না। আমরা শুধু ঢাকা পাঠানোর জন্য বড় কাঁকড়া নেই।’
‘মেয়ে কাঁকড়া বড় হয়ে ডিম হলে আমরা উঠায়া বিক্রি করি, ওইটার দাম বেশি হয় আরকি।’ পাইকগাছা এলাকার কাঁকড়ার আড়ৎদার শিবপদ নাথ। তিনি জানান, স্থানীয় কাঁকড়া চাষিদের কাছ থেকে কাঁকড়া সংগ্রহ করে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ কেজি কাঁকড়া ঢাকায় পাঠান তিনি। ‘কাঁকড়ার তো গ্রেড আছে, রেট আছে। বড়টার দাম ১২০০-১৩০০ টাকা কেজি রেট। তার পরেরটা আছে ৯০০ টাকা। সব থেকে কম আছে ২০০ গ্রাম যেটা ৫০০ টাকা কেজি। সবচেয়ে বড়টা হয় ৫০০ গ্রাম-৬০০ গ্রাম।’
শিবপদ নাথ জানান, পাইকগাছা বাজার যেখানে তার আড়ৎ অবস্থিত সেখান থেকে প্রতিদিন ৩-৪ টন কাঁকড়া ঢাকায় পাঠানো হয়।
চিংড়ির তুলনায় কাঁকড়ার ব্যবসায় ঝুঁকি কম বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
তিনি বলেন, চিংড়ি যত সহজে মারা যায়, কাঁকড়া তত সহজে মারা যায় না। পানি ছাড়াও এটি ছয় ঘণ্টার মতো বেঁচে থাকতে পারে। এছাড়া চিংড়ির ঘেরে একবার রোগ ছড়িয়ে পড়লে পুরো ঘেরের চিংড়ি মারা যায়। তবে কাঁকড়ায় এ ধরণের রোগ কম হয় এবং মরেও কম।
বর্তমানে কাঁকড়ার যোগান কিছুটা কম। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ঘের ছোট হয়ে যাওয়া এবং নদ-নদী ছোট হয়ে যাওয়া।
কিভাবে হয় কাঁকড়ার চাষ? বাগদা চিংড়ির মতোই কাঁকড়া উপকূলীয় লবণাক্ত পানিতে চাষ করা হয়। ফলে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল কাঁকড়া চাষের জন্য উপযোগী। নরম দো-আঁশ বা এঁটেল মাটিতে কাঁকড়া চাষ হয়।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে এই কাঁকড়া চাষ হয়ে থাকে। এছাড়া উপকূলীয় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী, বরিশাল, নোয়াখালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ এবং সুন্দরবনের দুবলার চর এলাকায় শিলা কাঁকড়ার দেখা মেলে। তবে খুলনা এবং চকরিয়া সুন্দরবন এলাকায় এদের বেশি দেখা যায়।
সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার পুরোটা জুড়েই কাঁকড়া চাষ হয়। এর মধ্যে হরিনগর, মুন্সীগঞ্জ গ্রাম, এবং নয়াদিঘির এলাকাগুলোতে বেশি পরিমাণ কাঁকড়া চাষ হয়। সাতক্ষীরা জেলার মৎস্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ৩২১ হেক্টর এলাকা জুড়ে কাঁকড়া চাষ হয়। বছরে ২০০০ মেট্রিক টনের বেশি কাঁকড়া চাষ হয় এই জেলা থেকে। নদীর মোহনা বা সাগরের জোয়ারের পানির সাথে বিভিন্ন আকারের কাঁকড়া আসে। এর মধ্যে ছোট ছোট কাঁকড়া বা কিশোর কাঁকড়া সংগ্রহ করে ঘেরে রেখে বড় করা হয়। আর বড় কাঁকড়া আসলে সেগুলো ধরে বিক্রি করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে পালনের ক্ষেত্রে কাঁকড়ার খাবার হিসেবে দেয়া হয়, তেলাপিয়া বা অন্য ছোট মাছ। চিংড়ির তুলনায় কাঁকড়া চাষে সময় কম লাগে। একই সাথে কাঁকড়ার রোগ-বালাইও চিংড়ির চেয়ে কম হয়। সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: আনিছুর রহমান বলেন, কাঁকড়া চাষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এর পোনা। এখনো দেশে কাঁকড়ার ডিম থেকে পোনা উৎপাদনে তেমন সাফল্য অর্জিত হয়নি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কয়েকটি হ্যাচারী স্থাপিত হলেও সেগুলো আশানুরূপ ফল দিতে পারছে না বলে জানান তিনি।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক পোনা বা কিশোর কাঁকড়া সংগ্রহ করে তা মোটাতাজা করা হয়। এটাকেই ঘেরে কাঁকড়া চাষ বলা হয়।
‘কাঁকড়ার পোনা যেটাকে আমরা ক্র্যাবলেট বলি, সেটা সুন্দরবন রিজন থেকে সংগ্রহ করে। কিন্তু এখন সুন্দরবনে কনজারভেশনের জন্য পাঁচ মাস বন্ধ থাকে বছরে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি আর এদিকে জুন-জুলাই-অগাস্ট,’ বলেন আনিছুর রহমান। সাতক্ষীরা জেলার এই মৎস্য কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে দুইভাবে কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। একটা হচ্ছে ফ্যাটেনিং বা মোটাতাজাকরণ, আর আরেকটি হচ্ছে সফট শেষ কাঁকড়া উৎপাদন।
মোটাতাজাকরণ হচ্ছে, একটি জলাশয় জাল বা প্লাস্টিক দিয়ে ঘিরে সেখানে কিশোর কাঁকড়া রেখে পালন করা হয়। এই কাঁকড়া একটি নির্দিষ্ট ওজন পর্যন্ত হলে সেটি বিদেশে রফতানি করা হয়। ঘেরে চাষ করা ছাড়াও হার্ডশেল বা খোসাসহ এই কাঁকড়া বিভিন্ন নদ-নদীতেও পাওয়া যায়। সেগুলো সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়। আরেকটি হচ্ছে সফটশেল কাঁকড়া। এক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বাক্সের ভেতরে চাষ করা হয়। প্রতিটি বাক্সে একটা করে ৮০ গ্রাম বা ১০০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া রেখে পালন করা হয়। এই বাক্সে নিয়মিত খাবার দেয়া হয়। কাঁকড়া যেহেতু খোলস পাল্টায় তাই কাঙ্ক্ষিত ওজনের হলে খোলস পাল্টানোর সময় কাঁকড়া ধরা হয়। এসময় কাঁকড়ার খোলস না থাকায় এটি নরম হয় বলে একে সফটশেল ক্র্যাব বলা হয়। বিদেশে এই সফটশেষ কাঁকড়ারই চাহিদা দিন দিন বাড়ছে বলে জানান আনিছুর রহমান।
তিনি বলেন, এই ঘেরে অনেক মানুষ কাজ করে। প্রতি চার থেকে ছয় ঘণ্টা পর পর বাক্সগুলো চেক করে দেখা হয় যে কোনো কাঁকড়া খোলস পাল্টেছে। যেটা খোলস পাল্টায় সেটা তুলে নিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানায় পাঠানো হয়। ‘এটার যেহেতু শেল থাকে না, সফট হয়ে যায় পুরো বডিটা, তাই এর বডির বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদা করে রেস্টুরেন্টে খাওয়া হয়। এটা আমাদের দেশে চালু করা গেলেও একটা বড় বাজার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ সূত্র : বিবিসি