রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১১ পূর্বাহ্ন

চৌরঙ্গী

শংকর
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০২৩

(শংকর এক জন জনপ্রিয় লেখক । তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়তাঁর ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জনঅরণ্য’ কাহিনী অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়করেছেন উত্তম কুমার। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড?াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায়শুরু করেন লেখালেখি। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায়জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময়‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি আশি পেরিয়েছেন শংকর। এখনও সমান তালে লিখে চলেছেন। ইদানীং তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।)
(পূর্ব প্রকাশের পর)
তারপর জানলা দিয়ে বাইরের একটুকরো আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তখনও সূর্য অস্ত যায়নি, কিন্তু সন্ধ্যা হতেও বেশি দেরি নেই।
এবার তিনি যা বললেন, তা শোনবার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম। মাথাটা নাড়াতে নাড়াতে, চোখ দুটো ছোট করে বললেন, তুমি অত্যন্ত ক্লেভার। অনেক জেনেও তুমি মুখটাকে ইনোসেন্ট রাখতে পেরেছ।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তার কথাতে একটু রহস্যের গন্ধ পেলাম। তিনি হয়তো সন্দেহ করছেন, আমি কিছু সংবাদ জানি, অথচ বলছি না। বললাম, আপনার কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারছি না, স্যর।
মার্কোপোলো এবার লজ্জিত হয়ে পড়লেন। বললেন, না না, তুমি রাগ কোরো না, এমনি মজা করছিলাম।
হঠাৎ কথা বন্ধ করে মার্কোপোলো এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ওঁর ওই বিশাল চোখের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাকিয়ে থাকার মতো সাহস বা শক্তি আমার ছিল না। তাই চোখ নামিয়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। একটু পরে আবার ওঁর মুখের দিকে তাকালাম। মনে হল, বড়ো করুণভাবে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
ধীরে ধীরে মার্কোপোলো বললেন, আমার একটা উপকার করবে? বায়রনের সঙ্গে একবার দেখা করে আসবে? প্লিজ।
বলতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বলতে হবে? না, কিছুই বলতে হবে না। যদি ওঁর সঙ্গে দেখা হয়, ওঁকে জানিও, আমি অধৈর্য হয়ে পড়েছি।
তখনই বেরোতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সায়েব বাধা দিলেন। বললেন, ইয?ংম্যান, চা-এর সময় হয়ে গিয়েছে। এখনই চা আসবে। আগে চা খাও।
মার্কোপোলো বেল টিপলেন। হোটেলের ঘড়ির কাঁটা তখন চায়ের ঘরেই হাজির হয়েছে। দুশো, আড়াইশো ঘরে একই সঙ্গে চা পৌঁছে দিতে হবে। বেয়ারারা এতক্ষণে প্যান্ট্রির সামনে দাঁড়িয়ে, চাপা গলায় বলছেÍজলদি, জলদি।
বেলের উত্তরে বেয়ারা এসে হাজির হল না। সে নিশ্চয় ততক্ষণ প্যান্ট্রির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে দুজন লোক দ্রুতবেগে কেটলির মধ্যে গরম জল ঢালছে। আর একজন লোক যন্ত্রের মতো প্রতি কেটলিতে চা ঢেলে যাচ্ছে। বেয়ারারা ইতিমধ্যেই ফ্রিজ থেকে দুধ এবং আলমারি থেকে চিনি বার করে নিয়েছে। এত কেটলি এবং ডিস কাপ যে একসঙ্গে হাজির হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
ম্যানেজার সায়েবের ঘরে চা আসতে দেরি হল না। কেটলির টোপর খুলে দিয়ে মথুরা সিং সেলাম করে দাঁড়াল। এই সেলামের জিজ্ঞাসা, সায়েব নিজের খুশিমতো চা তৈরি করবেন, না সে দায়িত্ব মথুরার উপর অর্পণ করবেন।
মার্কোপোলো মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক হ্যায়। মথুরা সিং আর একটা সেলাম দিয়ে বিদায় নিল।
অভ্যস্ত হাতে কেটলির ভিতরটা চামচে দিয়ে নেড়ে নিয়েই ম্যানেজার সায়েব আঁতকে উঠলেন। বললেন, খারাপ কোয়ালিটির চা।
মথুরার ডাক পড়ল। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সে বললে, না হুজুর, সকালে যে চা খেয়েছেন, সেই একই চা।
ম্যানেজার সায়েব স্টুয়ার্ডকে সেলাম দিলেন। তিনিই হোটেলের ভাড়ারী; সুতরাং কোনো দোষ বেরুলে প্রথম ঘা তাকেই সামলাতে হবে।
দরজায় টোকা পড়তেই ম্যানেজার জিমিকে ভিতরে আসতে বললেন। চেয়ারে বসতে দিয়ে, ম্যানেজার বললেন, তোমার সঙ্গে চা খাবার জন্য প্রাণটা আইঢাই করছিল, তাই ডেকে পাঠালাম!
ব্যাপারটা যে সুবিধের নয়, তা জিমি ভাবে বুঝলেন। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো কিছু খারাপ আছে নাকি?
ম্যানেজার এবার বোমা ফাটালেন। মাইডিয়ার ফেলল, তোমার এই চা খেয়ে কোনো গেস্ট যদি এই হোটেলে আগুন ধরিয়ে দেয়, তাহলে আমি আশ্চর্য হব না। তোমার ওই চা স্টম্যাকে গেলে খুন করবার ইচ্ছেও হতে পারে।
অপ্রস্তুত স্টুয়ার্ড বললেন, বোধহয় আপনাদের কেটলিতে কোনো গোলমাল হয়ে গিয়েছে।
মুখ খিঁচিয়ে ম্যানেজার বললেন, এ প্রশ্নের উত্তর এখানকার নিকটতম আস্তাবলের ঘোড়ারা দিতে পারবে।
বিনয়ে গলে গিয়ে স্টুয়ার্ড বললেন, নতুন প্যাকেট খুলে চা তৈরি করে আমি এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি।
মার্কোপোলো এবার হা-হা করে হেসে ফেললেন। বললেন, জিমি, তুমি পারবে। খুব শিগগির তুমি আমার চেয়ারে বসতে পারবে।
আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তোমাদের ফিউচার বড় সায়েবকে দেখে রাখো।
মথুরা সিং আবার নতুন চা নিয়ে এল। চা তৈরি করে, আমাদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে মার্কোপোলো বললেন, মুখের জোরেই হোটেল চলে। তোমাদের কলকাতাতেই একজন হোটেলওয়ালা ছিলেন। নাম স্টিফেন। কথার জোরে রাজত্ব করে গেলেন।
হু ওয়াজ হি? স্টুয়ার্ড জিজ্ঞাসা করলেন।
কলকাতার সবচেয়ে বড় হোটেলের ফাউন্ডার। কলকাতার বাইরেও একটা নামকরা হোটেল তার কীর্তি। আর ডালহৌসির স্টিফেন হাউস তো তোমরা রোজই দেখছ। গল্প আছে, উনি তোমার থেকেও খারাপ অবস্থায় পড়েছিলেন। চা-এর কেটলিতে চামচ চালাতে গিয়ে, এক ভদ্রলোক দেখলেন, শুধু চা নয়, চা-এর সঙ্গে একটা আরশোলাও গরম জলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
স্টুয়ার্ড অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, তখন কী হল?
ভদ্রলোক টি-পট হাতে করে সোজা স্টিফেনের ঘরে এসে ঢুকলেন। রাগে তিনি ঠক ঠক করে কাঁপছেন। কিন্তু স্টিফেন ঘাবড়ে যাবার পাত্র নন। অমায়িকভাবে, নিজের বেয়ারাকে ডেকে আর এক পট চা আনতে বললেন। তারপর নিজের হাতে চা তৈরি করে, ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিলেন।
ভদ্রলোক দেখলেন স্টিফেন যেন মনে মনে কী একটা হিসেব করবার চেষ্টা করছেন। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী হিসেব করছেন?
আজ্ঞে, আমাদের পাঁচশো ঘর। তার মানে পাঁচশো পট চা। একটা আরশোলা। তার মানে পাঁচশোয় একটা।
গল্প শেষ করে ম্যানেজার আবার চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
স্টুয়ার্ড হা-হা করে হাসতে আরম্ভ করলেন। বাঃ! চমৎকার ব্যাখ্যা। ভদ্রলোকের আশ্চর্য বুদ্ধি ছিল।
হুঁ। কিন্তু দিনকাল দ্রুতবেগে পালটাচ্ছে, জিমি। এখন শুধু কথায় আর চিড়ে ভিজছে না, ম্যানেজার গম্ভীর হয়ে বললেন।খুব সাবধানে না চললে অনেক দুর্ভোগ পোয়াতে হবে।
জিমি উঠে পড়লেন, আমাকেও উঠতে হল।
মার্কোপোলো বললেন, হোটেলের গাড়িতে তোমাকে পাঠাতে পারতাম, কিন্তু জিনিসটা জানাজানি হোক আমি চাই না।
নমস্কার করে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় নেমে ট্রামের শরণাপন্ন হওয়া গেল।
কোনো বিশেষ শ্রেণির লোক দলবদ্ধভাবে কোথাও বাস করলে সে পাড়ার বাতাসে পর্যন্ত তাদের বৈশিষ্ট্য যে কেমন করে ছড়িয়ে পড়ে আমি বুঝতে পারি না। ছাতাওয়ালা গলির সঙ্গে ডেকার্স লেনের যে পার্থক্য আছে, তা আমার চোখ বেঁধে দিলেও বলে দিতে পারি। ব্যক্তি-জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলো কেন যে গন্ধেও ধরা দেয় তা বলা শক্ত। এসপ্লানেড-পার্ক সার্কাসের ট্রামটা যখন ওয়েলেসলির মধ্য দিয়ে এলিয়ট রোডে ঢুকে পড়ল, তখনও এক ধরনের গন্ধ পেলাম। সত্যি কথা বলতে কী, এই গন্ধ কেউ বিশেষ উপভোগ করেন না। নোংরামির দিক থেকে এই অঞ্চল কলকাতা কর্পোরেশনের খাতায় কিছু প্রথম স্থান অধিকার করে নেই, এর থেকেও অনেক নোংরা গলিতে প্রতিদিন বহু সময় অতিবাহিত করি, কিন্তু কখনও এমন অস্বস্তি বোধ করি না।
পার্ক সার্কাসের ট্রাম থেকে নেমে পড়ে, বায়রন সাহেবের গলিটা কোনদিকে হবে ভাবছিলাম। আমার সামনেই গোটাকয়েক অধউলঙ্গ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাচ্চা দেশি মতে রাস্তার উপর ড্যাংগুলি খেলছিল। ছেলেরা যেখানে ঘোরাঘুরি করে, খেলাধুলা করে, সে জায়গার প্রকৃতি সম্বন্ধে কিছুটা আশ্বস্ত হওয়া যায়। কিন্তু মাত্র গজ কয়েক দূরেই একটা মদের দোকান। রাস্তার উপর থেকে সাইনবোর্ড ছাড়া দোকানের আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সাইনবোর্ডের উপর একটা নিষ্প্রভ ইলেকট্রিক বাতি অকারণে রহস্য সৃষ্টি করে নিস্পাপ পথচারীদের মনে নিষিদ্ধ কৌতূহল সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।
ড্যাংগুলি খেলা বন্ধ করে ছেলেরা এবার আমার দিকে নজর দিলে।
পকেট থেকে কাগজ বার করে লেনের নাম জিজ্ঞেস করাতে, ছেলেরা রাজভাষা ও রাষ্ট্রভাষার ককটেলে তৈরি এক বিচিত্র ভাষায় আমাকে পথ দেখিয়ে দিল।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসছিলাম। কিন্তু ওদেরই মধ্যে সিনিয়র এক ছোকরা এসে বললে, যে-সার্ভিস তারা দিয়েছে তার প্রতিদানে তারা কিছু আশা করে।
ট্যাক্সি ধরে দেবার জন্য চৌরঙ্গীতে ছোকরাদের পয়সা দিতে হয় জানতাম, কিন্তু ঠিকানা খুঁজে দেবার জন্য কলকাতা শহরে এই প্রথম চার আনা খরচ করে যখন বায়রন সায়েবের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালাম তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।
প্লাসটিকের অক্ষর দিয়ে দরজার সামনে বোধহয় নাম লেখা ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ অক্ষর কোন সময়ে বন্ধনমুক্ত হয়ে দরজা থেকে বিদায় নিয়েছে, শুধু জ ঙ ঘ অক্ষরগুলো মালিকের মায়া কাটাতে না পেরে, কোনোরকমে ভাঙা আসর জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
দরজায় বেল ছিল। কয়েকবার টেপার পরও কোনো উত্তর না-পেয়ে বুঝলাম, ওই যন্ত্রটির শরীরও সুস্থ নয়। তখন আদি ও অকৃত্রিম ভারতীয় পদ্ধতিতে ধাক্কা মারা শুরু করলাম। এবার ফল হল। ভিতর থেকে এক শৃঙ্খলবদ্ধ কুকুরের স্বাধীনতার-দাবি-জানানো স্লোগান শুনতে পেলাম। দরজা খোলার শব্দ হল; এবং পরের মুহূর্তেই যিনি ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি খোদ বায়রন সায়েব।
চোখ মুছতে মুছতে বায়রন বললেন, আরে, কী ব্যাপার?
প্রচুর আদর করে তিনি আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। এই ভরসন্ধ্যাবেলায় উনি কি ঘুমোচ্ছিলেন?
একটা ছেঁড়া বেতের চেয়ারে বসতে বলে বায়রন সায়েব চোখে মুখে জল দেবার জন্য বাথরুমে গেলেন। দেখলাম, টেবিলের উপর এক কাড়ি পুরনো আমেরিকান ডিটেকটিভ ম্যাগাজিন ছড়ানো রয়েছে। দেওয়ালের কোণে কোণে ঝুল এবং নোংরা জড়ো হয়ে আছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে একটা ময়লা তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বায়রন বললেন, খুব অবাক হয়ে গিয়েছ, তাই না? ভাবছ লোকটা এখন ঘুমোচ্ছিল কেন? তার উত্তর দিচ্ছি। কিন্তু ফার্স্ট থিং ফাস্ট। আগে একটু চা তৈরি করি।
বললাম, এইমাত্র খোদ মার্কোপোলোর সঙ্গে চা খেয়ে এসেছি।
মার্কোপোলোর সঙ্গে বসে তুমি সেন্ট পারসেন্ট পিওর আগমার্কা অমৃত খেলেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমার সঙ্গে একটু চা খাবে না, তা কি হয়? তোমার এখনও বিয়াল্লিশ কাপ চা পাওনা।
বায়রন সায়েব নিজেই চা-এর ব্যবস্থা করতে আরম্ভ করলেন। বললেন, আমার স্ত্রী আজ ফিরবেন না। আপিস থেকে সোজা বাটানগরে এক বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে যাবেন।
হিটারে কেটলি চাপিয়ে বায়রন বললেন, যা বলছিলাম, আমাকে ঘুমোতে দেখে তুমি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে গিয়েছ। কিন্তু এটা জেনে রাখো, আমরা ডিটেটিভরা যা করি তার প্রত্যেকটারই পিছনে একটা গোপন উদ্দেশ্য থাকে।
তা তো বটেই, আমি সায় দিলাম।
হ্যাঁ, বায়রন সায়েব বললেন। আমার স্ত্রীকেও সবসময় ওই কথাটা বোঝাবার চেষ্টা করি। কিন্তু তুমি যেমন সহজেই আমার স্টেটমেন্ট মেনে নিলে, তিনি তা করবেন না। তিনি তখন হাজারটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন। অথচ, সবসময়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না। গোপনীয়তাটাই আমাদের ব্যবসা। আমাদের প্রফেশনে এমন অনেক কথা আছে, যা নিজের স্ত্রীকেও বলা সেফ নয়। হাজার হোক আমরা ইন্ডিয়াতে বাস করছি। দেওয়ালের কান যদি কোথাও থাকে সে এই দেশেতেই,Íপার্টিকুলারলি এই ক্যালকাটাতেই আছে।
বললাম, আপনার তাহলে বেশ কষ্ট হয়।
বায়রন সায়েব ঘাড় নাড়লেন। সেই জন্যই আমাদের ডিটেকটিভ ওয়ার্লডে একটা মতবাদ আছে, ডিটেকটিভদের বিয়ে করাই উচিত নয়।
অ্যাঁ! নতুন থিওরির কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম।
বায়রন সায়েব বললেন, এতে চমকাবার কিছু নেই। পাদ্রিরা বিয়ে করবে, না চিরকুমার থাকবে এই নিয়ে চার্চে যেমন অনেকদিন মতদ্বৈধ ছিল, এটাও তেমনি। চিরকুমার স্কুল অফ ডিটেকটিভরা বলছেন, এই পেশার পক্ষে ওয়াইফরা পজিটিভ নুইসেন্স।
হাইকোর্টের অনেক বড় বড় ব্যারিস্টারও গোপনে এ মত পোষণ করেন, আমি বললাম।
করতে বাধ্য। প্রত্যেকটি উচ্চাভিলাষী অথচ বুদ্ধিমান লোক ওই কথা বলবেন।
হিটার থেকে কেটলিটা নামিয়ে বায়রন সায়েব বললেন, তবে কি জানো, আমার ওয়াইফকে আমি দোষ দিতে পারি না। সাসপিশন অর্থাৎ সন্দেহটাও আমাদের পেশার প্রথম কথাÍশেষ কথাও বটে। আমার সেই গুণ আছে, অথচ আমার ওয়াইফের সন্দেহবাতিক থাকবে না, সেটাও ভালো কথা নয়। হাজার হোক, একটা ব্রেন সবসময় নিখুঁত কাজ করতে পারে না, ডবল ইঞ্জিন থাকলে বিপদের আশঙ্কা কম।
আমি চুপচাপ তাঁর কথা শুনছিলাম। গরম চা এক কাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, যা বলছিলাম, কেন এই অসময়ে ঘুমোচ্ছিলাম জানো? আজ রাত্রে আমার হয়তো একটুও ঘুম হবে না। সারারাত আমাকে একজনকে খুঁজে বেড়াতে হবে। কাকে খুঁজে বেড়াব, তার নাম হয়তো তোমার জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন নয়, পরে বলব। এই সিক্রেটটা গভর্নমেন্টের বাজেটের মতো; যতক্ষণ না পার্লামেন্টে অ্যানাউন্স করছি ততক্ষণ টপ সিক্রেট, কিন্তু তারপরই জনসাধারণের প্রপার্টি।
বায়রন সায়েব এবার আমার খোঁজ নিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, খবর কী? কাজকর্ম ঠিক চলছে তো?
বললাম, আজ্ঞে, হ্যাঁ। মেয়েটা এখনও ফেরেনি।
হুঁ, রোজির খবরটা তো নেওয়া হয়নি। কয়েকদিন খুব ব্যস্ত আছি। মেয়েটা ফিরবে কি না, খবরটা নিতেই হচ্ছে এবার। মিসেস ব্যানার্জিও খুব উতলা হয়ে পড়েছেন। দুদিন ওঁর মেয়েকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন।
বায়রন সায়েব এতক্ষণে ম্যানেজারের খবর জিজ্ঞাসা করলেন। আমাকে বলতে হল, তার জন্যই এই সন্ধ্যাবেলায় আমি এখানে এসেছি।
কিছু বলেছেন তিনি? বায়রন প্রশ্ন করলেন।
মার্কোপোলো খুব অধৈর্য হয়ে পড়েছেন, এ কথাটাই আপনাকে জানাতে বলেছেন।
বায়রন এবার বেশ গম্ভীর হয়ে উঠলেন। চা-এর কাপটা পাশে সরিয়ে দিয়ে, পকেট থেকে একটা সস্তা দামের সিগারেট বার করে ধরালেন। বললেন, বাবু, বড় ডাক্তার হওয়ার বাধা কী জানো? ইউ মাস্ট নট ফিল টু মাচ ফর দি পেসেন্ট-রোগী সম্বন্ধে তুমি খুব বেশি অভিভূত হবে না। আমাদেরও তাই। বিপদে পড়ে এসেছ। তোমাকে সাহায্য করবার জন্যে চেষ্টা করলাম, এই পর্যন্ত। পারলাম ভালো, না পারলে বেটার লাক নেস্ট টাইম। কিন্তু পারি না। জানো, চেষ্টা করেও পারি না। বেচারা মার্কোপোলো। ওর জন্যে সত্যিই আমার দুঃখ হয়।
একটা অশিক্ষিত, আধা-ভাঁড়, দরিদ্র এবং অখ্যাত ফিরিঙ্গির মুখের দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মুখের সিগারেট শেষ করে ভদ্রলোক। আর একটা সিগারেট ধরালেন। বদ্ধ ঘরের মধ্যে অনেকটা ধোঁয়া জমে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
বায়রন বললেন, তোমার অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু জানালাটা খুলে দিলে এখনই চারপাশের বাড়ির আধপোড়া কয়লার ধোঁয়া ঢুকে অবস্থা আরও খারাপ করে তুলবে।
একটু থামলেন বায়রন। তারপর বললেন, জীবনটাই ওই রকম। নিজের দুঃখের ধোঁয়ায় কাতর হয়ে, বাইরে গিয়ে দেখেছি সেখানে আরও খারাপ অবস্থা। আমার দুঃখকে ছাপিয়ে, সে-দুঃখ জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। তুমি তো আইনপাড়ায় অনেকদিন ছিলে। জীবনকে তুমি তো শাজাহান হোটেলের রঙিন শো-কেসের মধ্য দিয়ে দেখোনি। মার্কোপোলো বেচারার ইতিহাস তোমার ভালো লাগবে।
বায়রন সায়েবের মুখে সেদিন মার্কোপোলোর কাহিনি শুনেছিলাম।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ভেনিসের অভিজাত বংশীয় যে সন্তান অজানার আহ্বানে কুবলাই খানের দরবারে হাজির হয়েছিলেন, এ-কাহিনি আমার কাছে তার মতোই চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছিল।
বাইরে থেকে ওঁকে দেখলে খুবই সুখী মনে হয়, তাই না?
বায়রন সায়েব জিজ্ঞাসা করেছিলেন। দু হাজার টাকা মাইনের চাকরি।
দু হাজার টাকা! আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
আজ্ঞে হ্যাঁ। যুদ্ধের পর ইউরোপে একটা জিনিস হয়েছে, কাজের মানুষ আর বেশি বেঁচে নেই। যারা আছে, তাদের সস্তা দামে পাওয়া যায় না। বড় হোটেল ভালোভাবে চালাতে গেলে ওই মাইনেতে আজকাল ম্যানেজার পাওয়া যায় না। রেঙ্গুনে ভদ্রলোক এ ছাড়াও বিক্রির উপর কমিশন পেতেন।
কিন্তু মার্কোপোলোর জীবন চিরকাল কিছু এমন সুখের ছিল না। মিডল-ইস্টে এক গ্রিক সরাইওয়ালার ছেলে। বিদেশে বেশ কিছুদিন থেকে, সামান্য পয়সা জমিয়ে সরাইওয়ালা নবজাত শিশু এবং স্ত্রীকে নিয়ে দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু পথে দুঃখের অভিজ্ঞতা প্রস্তুত হয়ে ছিল। নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে তারা আরবের এক শহরে হাজির হলেন। রাত্রি কাটাবার জন্যে ওঁরা শহরের এক হোটেলে ঘরভাড়া করলেন। কিন্তু সেই হোটেলের বিল তাদের শোধ করতে হয়নি; হোটেলের ঘর থেকে তাদের আর বেরিয়েও আসতে হয়নি। সেই রাত্রেই এক সর্বনাশা ভূমিকম্পে শহরটা ধ্বংস হয়ে যায়।
দেশ-বিদেশের লোকেরা প্রকৃতির এই অভিশপ্ত শহরকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এলেন। কয়েক হাজার লোক নাকি সেবার ধ্বংসস্তুপের নীচে চাপা পড়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
ওই শহর থেকে মাইল তিরিশেক দূরে একদল ইতালীয় পাদ্রি সেই সময় কাজ করছিলেন। তাঁবু ফেলে তারা চোখের চিকিৎসা করেন। দৃষ্টিহীনদের দৃষ্টিদানের জন্য পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোই তাদের কাজ। দুটো রেডক্রশচিহ্নিত অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে মালপত্তর চড়িয়ে সার্কাস পার্টির মতো তাঁরা কোনো গ্রামে এসে হাজির হন। মাঠের মধ্যে তাঁবু পড়ে। আকাশে পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়। পোর্টেবল লোহার খাটগুলো জোড়া লাগিয়ে গোটা-পনেরো বিছানার ব্যবস্থা হয়ে যায়। আর-একটা ছোট তাঁবুর মধ্যে যন্ত্রপাতি সাজিয়ে তৈরি হয় অপারেশন থিয়েটার।
স্থানীয় দাতব্য প্রতিষ্ঠানদের আগে থেকে খবর দেওয়া থাকে। ঢাক বাজিয়ে, পোস্টার বিলিয়ে, দূর-দূরান্তে জানিয়ে দেওয়া হয়Íঅন্ধজনকে আলো দেবার জন্য ফাদাররা এসে গিয়েছেন। নদীর ধারে গ্রামের তাঁবুতে তারা দিন পনেরো থাকেন, বহু রকমের সর্বনাশা চোখের রোগের চিকিৎসা করেন, প্রয়োজন হলে অস্ত্রোপচার করেন। তারপর কাজ শেষ হলে ক্যাম্প গুটিয়ে আবার অন্য গ্রামের দিকে রওনা হয়ে যান।
ভূমিকম্পের খবর পেয়ে ক্যাম্প থেকে ইতালীয় ফাদাররা ছুটে এলেন। ধ্বংসস্তুপ সরাতে গিয়ে তারা এক ইউরোপীয় শিশুকে আবিষ্কার করলেন। তারই অনতিদুরে শিশুর বাবা ও মার প্রাণহীন দেহ পাওয়া গেল।
পিতৃমাতৃহীন শিশুকে ফাদাররা সঙ্গে নিয়ে গেলেন। ইতালিতে ফিরে নিজেদের অনাথ আশ্রমে মানুষ করতে লাগলেন।
শিশুর নাম কী হবে? প্রধান পুরোহিত বললেন, এর ভ্রমণ যোগ আছে। কোথায় এর জন্ম, কোথায় একে আমরা আবিষ্কার করলাম, এবং কোথায় একে আমরা নিয়ে এলাম। এর একমাত্র নাম হতে পারে মার্কোপোলো।
ভ্রমণের ভক্ত ছিলেন বোধহয় সেই ফাদার, আর সেই সঙ্গে ইতিহাসেরও।
অন্য কেউ-ই তেমন আপত্তি করলেন না। ফলে বিংশ শতকে ইতালির ভৌগোলিক সীমানায় ভেনিসের মার্কোপোলো আবার জন্মগ্রহণ করলেন।
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনাথ শিশুরা যাতে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে, সেদিকে ধর্মীয় পিতাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। মার্কোপোলোকে তারা পাঠালেন কলেজ অফ হোটেলিং-এ। এ-দেশে যার আর কিছু হয় না, সে হোমিওপ্যাথি করে, শর্টহ্যান্ড শেখে, নয় হিন্দু হোটেল খুলে বসে। ও-দেশে তা নয়। কন্টিনেন্টে লোকেরা, বিশেষ করে সুইশ এবং ইতালিয়ানরা, হোটেল ব্যবসাকে হালকাভাবে নেয়নি। হোটেল-বিজ্ঞানে প-িত হবার জন্য দেশ-বিদেশের ছাত্ররা এখানকার হোটেল-কলেজে পড়তে আসে। এই কলেজের ডিপ্লোমা এবং ডিগ্রি পাওয়া ছেলেদের পৃথিবীর সর্বপ্রান্তে বড় বড় হোটেলে দেখতে পাওয়া যায়।
এই একটি ব্যবসা, যেখানে ইংরেজরা বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারেনি। নিজেদের রাজত্ব এই কলকাতা শহরেই, দু-একটা ছাড়া সব হোটেল, এবং কনফেকশনারি দোকান কন্টিনেন্টের লোকদের হাতে ছিল। এবং যে দু-একটার মালিকানা ইংরেজদের ছিল, তাদের উপরের দিকের কর্মচারী সবই সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স কিংবা ইতালি থেকে আসত।
চলবে…….




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com