রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৫ অপরাহ্ন

মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুপিতে বৈদেশিক বাণিজ্য স্থায়ী সমাধান নয়

মো. মাজেদুল হক
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৩

সাধারণত বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তি করা হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অনুমোদিত মুদ্রা (কারেন্সি) দিয়ে। ১৯৬৯ সালে আইএমএফ সৃষ্ট স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) হলো ‘ইন্টারন্যাশন্যাল রিজার্ভ অ্যাসেট’। এসডিআর কোনো মুদ্রা নয়। মূলত পাঁচটি মুদ্রার বাস্কেটকে এসডিআরের মান বা মূল্য বলা হয়। বর্তমানে আইএমএফের এসডিআরে যুক্ত আছে ইউএস ডলার, ইউরো, চাইনিজ রেনমেনবি, জাপানিজ ইয়েন, পাউন্ড স্টারলিং। আর এ মুদ্রাগুলো দিয়ে পরিচালিত হয় বৈদেশিক বাণিজ্য। একমাত্র আইএমএফ নিজে এবং এর সদস্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসডিআর সংরক্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। এসডিআরে অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি মুদ্রার ভেতর বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউএস ডলারের আধিপত্য বেশি। আইএমএফের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া তথ্য অনুযায়ীÍ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ১৪৯ দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার মজুত দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। এর মধ্যে ইউএস ডলারের অংশ ৫৯ দশমিক ০২ শতাংশ, ইউরো ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ, চাইনিজ রেনমেনবি ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ, জাপানিজ ইয়েন ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ, পাউন্ড স্টারলিং ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এ তথ্য থেকে বলা যায় যে, মার্কিন মুদ্রা ‘ডলার’ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখনো সারা বিশ্বে রাজত্ব করছে। ব্যাপক আকারে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তি করা হয় ইউএস ডলারে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ আমদানি ব্যয়ের ৯০ শতাংশের ওপরে পরিশোধ করে ইউএস ডলারের মাধ্যমে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে থাকা অন্য মুদ্রা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং আমদানি ব্যয় পরিশোধে ব্যবহার করা হয় না বললেই চলে। ইউএস ডলারের ব্যবহারের চর্চা বিশ্বের অধিকাংশ আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের মধ্যে এখনো রয়েছে। ইউএস ডলার ব্যবহারের অভ্যাস রাতারাতি দূর করা সহজ কাজ নয়। বাংলাদেশের পক্ষেও সম্ভব নয়।
২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে আইএমএফ তার এসডিআর বাস্কেটে চাইনিজ রেনমেনবি অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এত বছরেও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চাইনিজ রেনমেনবি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশেও চাইনিজ রেনমেনবি এখনো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে চাইনিজ রেনমেনবির মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্য করার অনুমোদন দিলেও আকাঙ্ক্ষিত সাড়া মেলেনি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ীÍ২০১৭ সালে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে চাইনিজ রেনমেনবি ছিল মাত্র ১ শতাংশ। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে এসে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৩২ শতাংশ, যেখানে ২০১৭ সালে মোট বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ইউএস ডলারের মজুত ছিল ৮১ শতাংশ।
ইদানীং দেখা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন দেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তি করছে কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে। নতুন করে অনেক দেশ কারেন্সি সোয়াপের চুক্তি করার জন্য আলোচনা করছে। নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করে দুই দেশের মধ্যে যখন বৈদেশিক বাণিজ্য হয়, তখন এ পরিস্থিতিকে কারেন্সি সোয়াপ বলে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ এবং রাশিয়ার মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে কারেন্সি সোয়াপ চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত এ চুক্তি হয়নি । এখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্য হচ্ছে ভারতীয় মুদ্রায় রুপিতে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকায় হবে। দুই দেশে মার্কিন ডলার সংকটের কারণে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রুপিতে বাণিজ্য করলে আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারকের দুই বার মুদ্রা বিনিময় করার খরচ কমে যাবে। অতি দ্রুত রুপিতে বাণিজ্য নিষ্পত্তি সম্ভব হবে। এ সিদ্ধান্তের ফলে অনেক ইতিবাচক দিক থাকলেও নেতিবাচক দিকও আছে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে বাংলাদেশের ডলার-সংকট কি নিরসন হবে, না ডলার-সংকট আরো বাড়বে? বর্তমানে আসিয়ান জোটের দেশগুলো রুপিতে বৈদেশিক বাণিজ্য করতে চাইছে। এছাড়াও ভারতের ডাকে সাড়া দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের কিছু দেশ ভারতীয় মুদ্রায় বাণিজ্য করার জন্য এগিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ ১৮টি দেশকে রুপিতে বৈদেশিক বাণিজ্য করার অনুমোদন দিয়েছে। দেশগুলো হলোÍবতসোয়ানা, ফিজি, জার্মানি, গায়ানা, ইসরাইল, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, মরিশাস, মায়ানমার, নিউজিল্যান্ড, ওমান, রাশিয়া, সিচিলিস, সিংগাপুর, শ্রীলঙ্কা, তানজানিয়া, উগান্ডা, যুক্তরাজ্য। এ সিদ্ধান্ত এসেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। আমদানি খরচ কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ার অনেক দেশ মার্কিন ডলারের সংকটে পড়েছে। এটা সত্য। কিন্তু এটাও সত্য যে, এখানে ভূরাজনীতি জড়িত।
ডলার-সংকটের সুযোগ নিয়ে বিশ্বেও অনেক দেশ এখন নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করতে চাইছে। ডলারের আধিপত্য এখনো ব্যাপক। এটাকে সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা বলে। ডলারের আধিপত্যকে কমানোর লক্ষ্যে চীন ও রাশিয়া বিভিন্নভাবে তাদের মুদ্রা প্রচলন করতে চাইছে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা মিলে ব্রিকস নামে যে জোট সৃষ্টি করেছে, তা এখন মার্কিন ডলারের বিপরীতে নতুন মুদ্রা চালু করে বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী করতে চাইছে। ব্রিকসের নেতৃত্বে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) করা হয়েছে। এটা মূলত করা হয়েছে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের বিকল্প হিসেবে। এনডিবি বিভিন্ন মুদ্রায় ঋণ প্রদান করার কথা ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ এবং ভারত রুপিতে লেনদেন করার কথা ভাবছে এক দশক আগে থেকে। ২০১৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে দ্ইু দেশের কেদ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে টাকা-রুপিতে বাণিজ্য করার কথা অলোচনা হয়। প্রস্তাবনা আসে প্রথমে ভারতের দিক থেকে। এখন দুই দেশে যে ডলার-সংকট চলছে, ২০১৩ সালে কি এ ধরনের সংকট ছিল? সংকট থাকতে পারে। কিন্তু এত প্রকট ছিল না। রুপিতে বাণিজ্যের সিদ্ধান্ত কেবল ডলার-সংকটকে দায়ী করলে ভুল হবে। ভারত মূলত চাইছে তার মুদ্রাকে বিশ্বের দরবারে শক্তিশালী করার জন্য। এ ইচ্ছা সবারই থাকে। এ ধরনের ইচ্ছাকে আমি সাধুবাদ জানাই। ভারত তার ভিশন সফল করার জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। রুপিতে বাণিজ্যের সিদ্ধান্ত হয় দুই দেশের ডলার বাঁচানোর লক্ষ্য নিয়ে। বাংলাদেশের এ লক্ষ্য কখনো পূরণ হবে না।
ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয় ১৬ থেকে ১৮ বিলিয়নের। ভারতের পক্ষেই এ বাণিজ্য। অর্থাৎ ভারত রপ্তানি করে বেশি, আমদানি করে কম। ভারত এবং বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ব্যাপক। আবার রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বাংলাদেশে না হওয়ায় ভারতে রপ্তানির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি করা হয় মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারের। মোট আমদানির ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ চীন থেকে আমদানি করে ভারত। এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাত, আমেরিকা, সৌদি আরব, ইরাক থেকে আমদানি করে ভারত। ভারতের আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে ইলেকট্রনিকস পণ্য, খনিজ তেল, মেশিনারিজ ও কেমিক্যাল। এ পণ্যগুলো বাংলাদেশ রপ্তানি করে না। সুতরাং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমার সম্ভাবনা নেই। বরং বাড়বে। রুপিতে বাণিজ্য করলে ২ বিলিয়ন ডলার রক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থেকে মাইনাস হলো না। ভালো কথা। কিন্তু এটা কি ডলার বাঁচানোর স্থায়ী সমাধান? এখন অনেক হিসাবনিকাশ করে ডলার বাঁচানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত যখন ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল, তখন এই রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। শ্রীলঙ্কা কি সঠিক সময়ে এই ঋণ ফেরত দিতে পেরেছে? আবার পরবর্তী সময়ে এই রিজার্ভ দিয়ে বাংলাদেশ ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (বিআইডিএফ) সৃষ্টি করা হয়েছিল মেগা প্রকল্পগুলোকে সহায়তা করার জন্য। বলা প্রয়োজন যে, উন্নত দেশগুলো ১৫ থেকে ২০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য রিজার্ভ সংরক্ষণ থাকে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কীভাবে রিজার্ভ নিয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়? বাংলাদেশে মার্কিন ডলারের উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয়। বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এখনো মোট দেশজ উৎপাদনের ১ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশ এখনো রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে পারে নাই। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারিত করতে পারেনি। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ৭৬ শতাংশ হয়ে থাকে মাত্র ১২টি দেশে। প্রবাসীরা অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। বাংলাদেশ আমদানি-নির্ভর অর্থনীতি। আমদানি ব্যয়ের ৯০ শতাংশের ওপরে মার্কিন ডলারে করা হয়। এছাড়াও আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক থেকে যে ঋণ নেওয়া হয় তা পরিশোধ করতে হয় মার্কিন ডলারে। ২০২৪ সাল থেকে বড় আকারে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। এতে প্রয়োজন হবে মার্কিন ডলার। কিছুদিন আগে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে যে বাণিজ্য হয়েছিল, সেটা রুপির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার জন্য রাশিয়া রাজি হয়নি। কারণ, রাশিয়া এই রুপি দিয়ে ভারত ছাড়া কোথাও লেনদেন করতে পারবে না। বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশের অনুমোদিত সোনালী ব্যাংক লিমিটেড এবং বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড রুপিতে বানিজ্য করানোর জন্য গ্রাহক খুঁজছে। এমনকি গ্রাহককে বোঝানোর জন্য এই দুই ব্যাংকে আলাদা ডেস্ক খোলা হয়েছে। বাংলাদেশকে এখন চেষ্টা করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে মার্কিন ডলার বাড়ানো। এ বছরের জুনের শেষে আইএমএফকে ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রার মজুত দেখাতে ব্যর্থ হয়েছি। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে যেন আইএমএফের নির্দেশনা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার মজুত দেখাতে পারি, সে চেষ্টা করতে হবে। ভূরাজনীতির খপ্পরে না পড়ে আইএমএফ সৃষ্ট এসডিআরে অন্তর্ভুক্ত মুদ্রা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়তে চেষ্টা করি। এটাই হবে স্থায়ী সমাধান। লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com