ক্রাইমিয়ার তাতাররা রাশিয়ার অধিকৃত ক্রাইমিয়া উপদ্বীপের একটি মুসলমান জাতিগোষ্ঠী। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধে তারা এখন বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। তারা একটি সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেছে যার নাম ‘আতেশ,’ অর্থাৎ আগুন। ইউক্রেনে রুশ হামলাকারীদের বিরুদ্ধে তারা অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছে। আতেশ গেরিলা বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এই গোষ্ঠীটির লক্ষ্য রুশ রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত করা, প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে নাশকতা চালানো এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সামরিক বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করা। আতেশ এজন্য যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা বেশ নির্মম। ২০২২ সালের নভেম্বরে সিমফেরোপল শহরের এক হাসপাতালে ৩০ জন রুশ সৈন্যকে হত্যা করে তারা প্রমাণ করেছে তারা কী করতে চায়। তবে তারা অন্যান্য যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাও বেশ কার্যকর এবং অভিনব।
এবছরের ফেব্রুয়ারিতে আতেশ গোষ্ঠী দাবি করেছিল যে চার হাজারেরও বেশি রুশ সৈন্য “আতেশ স্কুলে”র একটি অনলাইন কোর্সে যোগ দিয়েছে, যেখানে তাদের শেখানো হয়েছে কীভাবে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র নষ্ট করে তারা নাশকতার মাধ্যমে ঐ যুদ্ধের মধ্যে টিকে থাকতে পারেন। তাতার নেতা মুস্তাফা জামিলেভ, রুশ সরকার যাকে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত ক্রাইমিয়ায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, তিনি সম্প্রতি বলেছেন, “আতেশ গেরিলারা চরম গোপনীয়তা বজায় রাখেন, কিন্তু তারা ক্রাইমিয়ার ভূখ-ের ভেতরে থেকে কাজ করছেন এবং বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা চালাচ্ছেন।“
কিয়েভ-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কোঅপারেশনের প্রধান সেরহি কুজান বলছেন: “এদের যুদ্ধের রীতি হলো, দখলদার বাহিনী সব সময় এদের উপস্থিতি টের পাবে এবং কখনই তারা নিরাপদ বোধ করবে না।” ক্রাইমিয়ার ভেতরে, এবং এমনকি এই অঞ্চলের সীমানার বাইরেও, রুশ সামরিক শক্তিকে দুর্বল করার লক্ষ্যে আতেশসহ অন্যান্য গেরিলা গোষ্ঠী নানা ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করছে।
সিমফেরোপল হাসপাতালে রুশ সৈন্যদের উপর হামলার দায় স্বীকার করার পর এক বিবৃতিতে আতেশ বলেছে: “ওয়ার্ডগুলিতে গিয়ে দেখুন, মর্গগুলিতে যেয়ে দেখুন … এই সত্যটি আপনি ৩০০বার যাচাই করতে পারেন, তবে এটিই হচ্ছে একমাত্র সত্য।” এই যুদ্ধের অনেক ঘটনাবলীর মতো, এবং সব পক্ষের জন্যই যা প্রযোজ্য, মাঠ পর্যায়ে এধরনের দাবি যাচাই করা অত্যন্ত কঠিন কাজ।
তবে আমরা এটুক জানি যে, খারকিভ, জাপোরিশা এবং খেরসন অঞ্চলের গেরিলা বাহিনীগুলি স্টিকার এবং প্রচারপত্র বিতরণের মাধ্যমে রুশদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি একটি সমন্বিত প্রচারণা অভিযান শুরু করেছে।
এছাড়া, আগের যুদ্ধের কৌশল অনুকরণ করে, ইউক্রেন সরকার রুশ সেনা ইউনিটগুলির অবস্থানের ওপর লিফলেট ফেলেছে। এতে বলা হয়েছিল: “রাশিয়ার সৈনিক, আপনি যদি একুশ শতকের নাৎসি হতে না চান, তাহলে আমাদের মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যান! অন্যথায় হিটলারের সৈন্যদের ভাগ্য এবং নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল [যুদ্ধাপরাধের বিচার] আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।” অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়ার ব্যাপারটি কিয়েভ সরকারের জন্য বেশ লোভনীয়, কারণ রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ (১৯১৭-১৯২৩) এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়া যাকে “মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধ” (১৯৪১-১৯৪৫) হিসাবে স্মরণ করে, দুটি ক্ষেত্রেই জয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল গেরিলা যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউক্রেনের ওপর নাৎসি জার্মানির হামলার সাথে বর্তমান রুশ সেনাবাহিনীর তুলনার মাধ্যমে কিয়েভ সরকার ইতিহাস সম্পর্কে মি. পুতিনের ব্যাখ্যার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করছে। নাৎসি দখলদারির সময় গণহত্যায় সহযোগিতা করার জন্য ক্রেমলিন সরকার ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদীদের দায়ী করে থাকে। রাশিয়ার সরকার প্রচার করে যে ইউক্রেনকে ‘ডিনাৎসিফাই’ করা অর্থাৎ নাৎসীবাদীদের উৎখাত করার লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান যুদ্ধটি চালানো হচ্ছে।
কারা এই তাতার?
রাশিয়া, ইউক্রেন এবং ক্রাইমিয়ান তাতারদের ইতিহাস সম্পর্কে যারা জানেন, তারা রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদের এই সর্বশেষ সংস্করণের বিরুদ্ধে তাতারদের শত্রুতা দেখে মোটেই অবাক হবেন না। ক্রাইমিয়ান তাতাররা ক্রাইমিয়ান উপদ্বীপের বাসিন্দা একটি তুর্কি জাতিগত গোষ্ঠী। এরা স্লাভিক রাশিয়ানদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্রাইমিয়ান তাতার জাতি গঠিত হয়েছিল চার শতাব্দী আগে (১২০০-১৬৫০ শতাব্দীতে) এবং ঐ অঞ্চলে আসা অন্যান্য অভিবাসীদের সাথে তারা মিশে গিয়েছিল। রাশিয়ার জারিনা ক্যাথরিন দ্য গ্রেট ১৭৮৩ সালে ক্রাইমিয়াকে সংযুক্ত করেন এবং রুশ সাম্রাজ্য পরবর্তীকালে ১৯১৭ সালের বিপ্লবের আগে ক্রাইমিয়ান তাতারদের ‘রুশী’ বানানোর চেষ্টা করে। জোসেফ স্ট্যালিনের শাসনামলে (১৯২৪-১৯৫৩) তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার ক্রাইমিয়ান তাতারদের সক্রিয়ভাবে দমন করেছিল। এর ফলে ১৯৪১ সালের জুনে ইউক্রেনের ওপর নাৎসি আক্রমণের পর বেশ কিছু তাতার জার্মানদের সাথে সহযোগিতা করেছিলেন। স্ট্যালিন ক্রাইমিয়ান তাতারদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনেন এবং পুরো জাতিগোষ্ঠীকে সাইবেরিয়ায় গুলাগ নামে পরিচিত শ্রম শিবিরে নির্বাসিত করেন।
তবে জার্মান অক্ষ শক্তির পক্ষে ছিলেন স্বল্প কিছু ক্রাইমিয়ান, কিন্তু এর চেয়ে বড় সংখ্যক ক্রাইমিয়ান কাজ করেছিলেন সোভিয়েত রেড আর্মিতে।
বেদনাদায়ক এক অতীত: উনিশশো চুয়াল্লিশে মধ্য এশিয়া থেকে অন্তত ১৮০,০০০ লোকের নির্বাসন ছিল তাতার জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়গুলির একটি, যাকে সুরগুন (নির্বাসন) নামে স্মরণ করা হয়।
উনিশশো ষাটের দশকে তাতার অধিকার আন্দোলন কর্মীদের গবেষণা থেকে জানা যায়, ঐ নির্বাসিতদের মধ্যে প্রায় এক লক্ষ ক্রাইমিয়ান মারা গিয়েছিলেন। এমনকি সোভিয়েত সরকারের দলিলপত্রও স্বীকার করে নেয় যে, অন্তত ৩০,০০০ ক্রাইমিয়ান তাতার নির্বাসনের দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছিলেন।
শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা সুপ্রিম সোভিয়েত স্বীকার করে নেয় যে ক্রাইমিয়ার পুরো তাতার জাতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনার পদক্ষেপটি ছিল একেবারেই ‘অযৌক্তিক।’ তেরো বছর আগে সুপ্রিম সোভিয়েত রুশ প্রজাতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ক্রাইমিয়াকে ইউক্রেন প্রজাতন্ত্রের কাছে হস্তান্তর করার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। সে সময়ে এধরনের পদক্ষেপ ততটা বিতর্কিত ছিল না, কারণ দুটি দেশই তখন পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির ঘটনা পুরো পরিস্থিতিকে একেবারে পাল্টে দিয়েছিল।
সংস্কারপন্থী সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের সময়ে ১৯৮৯ সালে বেশিরভাগ তাতারকে আবার ক্রাইমিয়ায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ঐ অন্যায্য নির্বাসনের জন্য তাতাররা কোন ধরনের ক্ষতিপূরণ পাননি, এবং স্বদেশে ফিরে আসার পর তাদের সাথে জাতিগত রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয়দের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। এসব রুশ এবং ইউক্রেনিয়ানরা ১৯৪৪ সালের পর ঐ উপদ্বীপে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
‘ক্রাইমিয়ার সেরা ইউক্রেনীয়’: উনিশশো একানব্বই সালে ইউক্রেন স্বাধীন হওয়ার পর তাতার নেতারা অভিযোগ করেন যে কিয়েভ সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে তাতারদের সরকারি চাকরি পেতে বাধা দিচ্ছে, এবং গোপনে তাতার “জমি দখলের” অনুমতি দিচ্ছে। তবে, ধীরে ধীরে ক্রাইমিয়ান এবং ইউক্রেনীয় তাতাররা তাদের সম্মিলিত শত্রুর বিরুদ্ধে একত্রিত হন। পরে ক্রাইমিয়ান তাতাররা নতুন ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রের প্রবল সমর্থক হয়ে ওঠেন এবং এর স্বীকৃতি হিসেবে কখনও কখনও এদের “ক্রাইমিয়ার সেরা ইউক্রেনিয়ান” নামে ডাকা হয়। উনিশ শতকে স্থানীয় ক্রাইমিয়ান তাতাররা ছিলেন ঐ উপদ্বীপের মোট জনসংখ্যার ৩৪.১%। স্ট্যালিনের জাতিগত নির্মূলের পদক্ষেপ বন্ধ হওয়ার পরও ২০০১ সালে রুশরা ছিল ক্রাইমিয়ান জনসংখ্যার ৫৮%, যেখানে আদিবাসী তাতাররা ছিল মাত্র ১২ শতাংশ। ক্রাইমিয়ায় ২০১৪ সালের রুশ আক্রমণের ঘটনা ক্রাইমিয়ান তাতারদের আরেকবার তাদের বিপর্যয়কর অতীতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। সেখানকার রুশ প্রশাসন দখল কায়েমের লক্ষ্যে সাথে সাথেই সেখানে নিয়মিতভাবে তাতারদের ওপর নানা অত্যাচার শুরু করে যা আজও চলছে। ক্রাইমিয়ান তাতারদের দল, যা তাতার মজলিস নামে পরিচিত, এবং এর সভাপতি মুস্তাফা জামিলেভকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একইভাবে স্তালিনবাদী নির্বাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোন কথা বলাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দু’হাজার চৌদ্দ সালের পর হাজার হাজার তাতার রুশ-অধিকৃত ক্রাইমিয়া ছেড়ে ইউক্রেনে চলে যান। তাতার অধিকার আন্দোলন কর্মী ও রাজনীতিবিদ ইলমি উমারভ একবার রুশ অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবিকে বলেছিলেন যে তিনি “ক্রাইমিয়াকে রুশ ফেডারেশনের অংশ বলে মনে করেন না।” এই মন্তব্য করার দায়ে তাকে জোর করে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ইউক্রেনীয় ও তাতারদের মধ্যে সংহতি প্রকাশ করে ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে ভারখোভনা রাদা (ইউক্রেনীয় সংসদ) ১৯৪৪ সালের তাতার নির্বাসনকে ‘গণহত্যা’ হিসাবে নিন্দা করে একটি প্রস্তাব পাস করে। এটি ছিল এমন এক নজির যা লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং ক্যানাডাকেও ২০১৯ সালে একই কাজ করতে উৎসাহ যুগিয়েছিল। দু’হাজার একুশ সালে ভারখোভনা রাদা ক্রাইমিয়ান তাতারদের ইউক্রেনের আদিবাসীদের মধ্যে অন্যতম হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি আইন পাস করে।
ইউক্রেনে এখন যেভাবে যুদ্ধ চলছে এবং তাতে ক্রাইমিয়ান তাতারদের যে উল্লেখযোগ্য সামরিক অবদান রয়েছে, সে কারণেই কিয়েভ সরকার ভবিষ্যতে ক্রাইমিয়ান তাতার জাতির স্বাধিকারের বিষয়টিকে সুনজরে দেখবে বলে ধারণা করা হয়। ইউক্রেন বিষয়ক গবেষক রোরি ফিনিন বলেন, বর্তমান যুদ্ধের অবসানের পর যে কোনো চুক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে ক্রাইমিয়ার ভবিষ্যৎ। ইউক্রেন ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল, কিন্তু বর্তমান যুদ্ধে রাশিয়ার হাতে পরাজয় এড়াতে কিয়েভের সামরিক ক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন এই ক্রাইমিয়ান তাতাররা। সূত্র: বিবিসি বাংলা। লেখক: *জেরাল্ড হিউজ হলেন ওয়েলসের অ্যাবারেস্টউইথ ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভাগের সামরিক ইতিহাস এবং ইন্টেলিজেন্স স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক।