রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২০ অপরাহ্ন

হিজল বনের কবি গোলাম মোহাম্মদ

শরীফ আবদুল গোফরান
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৩

কবি গোলাম মোহাম্মদ জন্ম হয় ১৯৫৯ সালের ২৩ এপ্রিল, মাগুরা জেলার মহম্মদপুর থানার গোপাল নগর গ্রামে। মাগুরা থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম। কবি যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে বাড়ি আজ আর নেই। মধুমতী নদী ভেঙ্গে নিয়ে গেছে তার জন্মভূমির সেই বসতভিটা। আজ শুধু বাড়ির একটি অংশ নদীর পাড় হিসেবে কবির স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। মধুমতীর ভাঙ্গা তীরে গোপাল নগর গ্রামে গেলে কবির স্মৃতি মনে করিয়ে দেবে। মনে হবে এইতো এখানেইতো কবি ভূমিষ্ঠ হয়ে কেঁদে উঠেছিলেন। মনে হবে এই বুঝি একটু আগে কবি গান গেয়ে গেয়ে নদীর তীর ধরে সামনে গিয়েছেন। কল্পনায় ভেসে উঠবে কবির গানের কলিÑ
“নদীর তীরে বসতরে ভাই
নদীর তীরে ঘর
কখন সে ঘর ভেঙ্গে পড়ে
বুক করে থর থর।”
সেই মধুমতীর পাড়েই আর একটু দূরে কবির বাবা বেঁধে যান নতুন আর এক বসতভিটা। যেখানে কবি বেঁধেছিলেন একটি নতুন ঘর। কিন্তু সেই ঘরের কাজ সমাপ্ত করতে পারেননি তিনি। তাকে চলে যেতে হয় পরপারে।
শহরের জীবন থেকে বহুদূরে সবুজ ক্ষেত আর আম কাঁঠাল-জাম ভরা এই গাঁয়ে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকেন তিনি। কবি গোলাম মোহাম্মদের পিতার নাম আবদুল মালেক মোল্লা। আর মাতার নাম করিমুন্নেসা। গোলাম মোহাম্মদের আব্বা আবদুল মালেক মোল্লা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার আর্থিক অবস্থা তেমন সচ্ছল ছিল না। বলিষ্ঠ চরিত্রগুণে তিনি নিজ গ্রামে এবং আশপাশের গ্রামে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
কবি গোলাম মোহাম্মদের মা করিমুন্নেসা একজন ধর্মপরায়ণ মহিলা। বুদ্ধিমতি, শান্ত ও পর্দানশীন এই মহিলাটিই তার জীবন সঁপে দিয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য।
পাঁচ বোন দুই ভাই নিয়ে ছিল তাদের পরিবার। ভাইদের মধ্যে কবি বড়। তার একমাত্র ছোট ভাই গোলাম আহমদ ইসলামী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। কবি গোলাম মোহাম্মদের জন্মের আগে তার কোনো ভাই বাঁচতো না। পর পর কয়েক ভাইয়ের মৃত্যু পরিবারকে কাঁদিয়েছিল। ফলে পরিবারের সকলের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন অকৃত্রিম আদর ও স্নেহ। কবি যখন ছোট তখন বনে বনে ঘুরে বেড়াতেন। একটু সময়ের জন্যও তাকে ঘরে আটকিয়ে রাখা যেতো না। ফলে বাবা তাকে খুঁজতেন। আর দেখামাত্র হাসতে হাসতে রস করে ডাকতেন, এই “বাগানে”। এরপর থেকে সবাই তাকে আদর করে “বাগানে” বলেই ডাকতো। ছোট বেলায় নাকি কবি খুব দুষ্টুমি করতেন। অনেক সময় অন্য পাড়ার ছেলেদের ধরে মারতেন। একবার নাকি অন্য পাড়ার ছেলেরা কবিকে ধরে নিয়ে লোহার রড আগুনে পুড়িয়ে কবির পিঠে লাগিয়ে দেয়। তিনি নিজেও আবার অন্যদের জোর করে নিজ পাড়ায় ধরে এনে কষে মার দিতেন। পাড়ার অন্যসব দুষ্টু ছেলেরা কবি গোলাম মোহাম্মদের ভয়ে অস্থির থাকতো। কে জানতো বাগানে বাগানে ঘুরা আর নদীর তীরে ছুটে বেড়ানো এই দুরন্ত বালক একদিন এতো শান্ত হয়ে যাবেন। এতো জ্ঞান অর্জন করবেন। বড় মানুষ হয়ে জাতির মুখ উজ্জ্বল করবেন।
অবশেষে পিতা আবদুল মালেক কবিকে মহম্মদপুর মাদরাসার ওস্তাদ ক্বারী শুকুরের হাতে তুলে দেন। ক্বারী সাহেব তার প্রিয় ছাত্রকে কুরআন শিক্ষা দিয়ে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেন। ফলে দুষ্টুমি বাদ দিয়ে লেখাপড়ায় মন দিলেন। আব্বা-আম্মার পথ নির্দেশনায় নিজের জীবনে পরিবর্তন আনলেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার মনের মধ্যে আস্তে আস্তে ইসলামী জ্ঞান ও আমল শিকড় গেড়ে বসে। ছোটবেলা থেকেই তার সব কিছু জানার প্রবল আগ্রহ। পরিচিতদের তিনি সব সময় নানা প্রশ্নে অস্থির করে রাখতেন। মাঝে মধ্যে নাকি স্কুরে যেতে চাইতেন না। একদিনতো বাবা ভর্ৎসনা করে মেরেছিলেন। আর সেইদিন থেকে শুরু হলো তার শিক্ষাজীবন, থামেনি আর কখনো। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি শিখেছেন, শিখিয়েছেন। নিজে যেমন স্বপ্ন দেখেছেন, তেমনি গোটা জাতিকেও স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
মরহুম কবি গোলাম মোহাম্মদের অসাধারণ প্রতিভা। পাঠের প্রতি আগ্রহ, পাঠশালার প্রধান শিক্ষককে আকৃষ্ট করলো। ভালো ছাত্র হিসেবেও স্কুলে তার নাম পরিচিত হলো। সব ক্লাসের পরীক্ষায় তিনি প্রথম হতে লাগলেন। তাছাড়া তার চরিত্রের দৃঢ়তা, সত্যবাদিতা, বিনয়, সরলতা সবকিছু স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। তিনি যে স্কুরে পড়তেন সেই স্কুলের নাম গোপালনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়, এই বিদ্যালয় থেকেই কবি প্রাথমিক বৃত্তিলাভ করেন।
মহম্মদপুর পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল হাইয়ের নজর পড়লো কবি গোলাম মোহাম্মদের দিকে। তিনি তার স্কুলে নিয়ে কবিকে ভর্তি করে দিলেন। পড়াশোনার প্রবল ইচ্ছা ও বড় হওয়ার দুরন্ত আশায় শেষ পর্যন্ত তাকে বাড়ির মায়া ত্যাগ করতে হয়। এখন অন্য কোনদিকে তার আর নজর নেই। শুধু লেখাপড়া, ভাবনা তার অনেক। তাকে অনেক বড় হতে হবে। অবশেষে ১৯৭৫ সালে এমকেএইচ ইনস্টিটিউট থেকে তিনি বিজ্ঞান বিভাগে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর কবি ঝিনাইদহ ফেন্সি কলেজে ভর্তি হন। কলেজে পড়াকালে কবি ঝিনাইদহ সদরের মধুরাপুর গ্রামে লজিং থাকতেন। এক সময় তিনি ভুটিয়ার গাতির জোয়ারদার পাড়ায়ও থাকতেন। অতঃপর কৃতিত্বের সাথে আইএসসি পাস করেন। তারপর চলে আসেন মাগুরা শহরে। ভর্তি হলেন মাগুরা কলেজে। এ কলেজ থেকে তিনি বিএসসি পাস করেন। তখন কবি রায়নাখালী গ্রামে লজিং থাকতেন। স্কুলে যাওয়া আসা শুরু হওয়ার পর থেকে তার চরিত্র, প্রতিভা চাল চলনে পরবর্তী জীবনের পূর্বাভাস ছিল। তিনি নিয়মিত নামায আদায় এবং রোজা পালন করতেন। মিথ্যা কথা তিনি বলতেন না। অন্যের কিছুতে তার লোভ ছিল না। সহজ সরলভাবে চলাফেরা করতেন। তখন তার সরলতা, সচ্চরিত্র, প্রতিভা ও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ, জানার দূরত্ব ইচ্ছা সকলকেই আকৃষ্ট করতো। কবি গোলাম মোহাম্মদ যেমনি ছিলেন ভালো ছাত্র তেমনি গান ও ফুল দূয়ের প্রতিই ছিল তার প্রাণের টান। তিনি ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াতেন। পাখি আর প্রজাপতিদের সাথে কথা বলতেন। টুনটুনিদের ঘুম ভাঙ্গাতেন। তার ডাকে সাড়া দিতো কামিনি, গোলাপ, জবা আর নাম না জানা কতো ফুল। ফুলে ফুলে ভরে যেতো তার ভোর। তার মনও ছিল ফুলের মতো সুন্দর। যেন সারাক্ষণ গন্ধ বিলিয়ে বেড়াতেন। তার গ্রামের দিনগুলো ছিল অত্যন্ত মধুর। পড়াশোনা, গান, ফুল, মাঠের শোভা এসব নিয়েই কাটে তার গ্রামে থাকার দিনগুলো। সেখানকার মায়া ত্যাগ করে কবিকে এক সময় চলে আসতে হয় শহরে। ছেড়ে আসতে হয় প্রিয় মধুমতী। যে মধুমতী ছিল তার নিত্যসঙ্গী। কি শীত কি গ্রীষ্মে লাফ দিয়ে পড়তেন নদীতে। সাঁতার কাটতেন, নদীর পানিতে ডুব দিয়ে খেলতেন, বিকেল হলে মধুমতীর তীর ঘেঁষে হেঁটে বেড়াতেন আর গুন গুন করে গাইতেন।
গান। তাঁর গানের ঝংকার এক সময় নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে চলে যেত দূরে বহু দূরে। তাইতো পরিণত বয়সে কবি লিখেনÑ
“একটি নদী ছলাৎ ছলাৎ বয়রে
সেই নদীটি কোন কথাটি কয়রে
¯্রােতের টানে চলতে থাকো
জীবন গতি ময়রে।”
এখন আর কেউ বলে না মধুমতী আমার জন্ম ভিটা ফিরিয়ে দাও। আবার সান্ত¦Íনার সুরে কেউ এ কথাও বলে না মধুমতী তুমি আমার জন্মস্থান বিলীন করে দিলেও তুমি আমার প্রিয় মধুমতী, আমার বন্ধু তুমি। তোমার বুকে লুকিয়ে আছে আমার বসতভিটা, যেখানে আমি ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রথম মাটি স্পর্শ করেছি। সে মাটি আজ তুমি লুকিয়ে রেখেছ। তুমি সে মাটিকে আঁকড়িয়ে ধরে রেখো বন্ধু…
“স্বপ্ন যেন ঝিলের শালুক ফুল
দুঃখ যেন খুকীর নরম চুল
কান্না এলে চাঁদকে পড়ে মনে
মন উড়ে যায় কনক চাঁপার বনে
চলতি ভেসে তুফান তুফান গতি
বন্ধু আমার পদ্মা-মধুমতী।”
এক সময় কবি চলে আসেন ঢাকায়। সব বন্ধুরাই শিল্প-সংস্কৃতির সাথে জড়িত। লেখালেখি, গান, কবিতা লেখা এসব তাদের কাজ। কবির জন্য ভালই হলো। তার লেখার গতিও বেড়ে গেলো। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হতে লাগলো নতুন নতুন কবিতা। প্রতিটি কবিতাই যেন রঙ্গরসে ভরা টইটুম্বুর। ঢাকায় এসে কবি প্রথমে একটি বড় প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনায় সেবামূলক কাজ করলেন। তারপর ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ এডুকেশন সোসাইটিতে চাকরি নেন। কিন্তু এই চাকরি তার বেশিদিন ভালো লাগেনি। যার মন উড়– উড়–, তার কি এক জায়গায় স্থির থাকতে ভাল লাগে? তাছাড়া এই নিরহঙ্কার কবির কোন লোভ-লালসাও ছিল না। ফলে বড় কোন চাকরি যা অনেক টাকা পয়সা রোজগারের চিন্তা তিনি কখনো করেননি। তিনি চেয়েছিলেন সরল সহজভাবে জীবনযাপন করতে। অবশেষে ১৯৮৯ সালে ‘শিল্পকোণ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
প্রতিদিন নিয়মিত শিল্পকোণে বসেন। এই শিল্পকোণই এক সময় সব কবির মিলন কেন্দ্রে পরিণত হলো। অনেক সময় এতো বেশি লোক হতো যে, যেই আসতেন কবি হাসি মুখে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। গল্প করতেন। আলোচনা করতেন। কিন্তু আপ্যায়ন না করে কাউকে যেতে দিতেন না। শিল্পকোণ থেকে একটু দূরেই ছিল রাজামিয়ার চায়ের দোকান। এই দোকানের চা ছিল কবির খুবই প্রিয়। প্রতিদিন বিকালে রাজামিয়ার চা দোকানে গিয়ে চা খেতেন। একটু আধটু পান যে খেতেন না তা নয়। একটু পানও খেতেন। তাঁর প্রিয় পান ছিল চাষিকল্যাণ গেটের আবদুর রহিমের পানের দোকান। এসব ছোট খাটো দোকানগুলোর সাথে কবির খুব ভাব। সবাইকে আদর করতেন। ফলে ওরাও কবিকে দেখলে শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে যেতো। সবাই যেন কবির ভালোবাসার কাঙ্গাল ছিল। কবিতো সবাইকে ভালো বাসতেন। কাকে যে বেশি ভালোবাসতেন আর কাকে যে কম ভালোবাসতেন তা বুঝাই যেতো না। তার মানে সবাইকে সমান ভালোবাসা দিতেন। যে কবির মধ্যে অহঙ্কারের লেশমাত্র নেই, তার ভালোবাসার মধ্যেও তো কোন তারতম্য হতে পারে না। ঈমানদার এই উদার কবি সবার প্রিয় মানুষ, সবার প্রিয় বন্ধু।
কবি এক সময় সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সাহিত্য পাতায়ও কাজ করতেন। তাছাড়া বাংলা সাহিত্য পরিষদ ছিল তার আত্মার আত্মীয়। তিনি বাংলা সাহিত্য পরিষদের সাহিত্য সভা পরিচালনা করতেন। ফলে সারাদিন কবিরা তার পেছন পেছন ঘুর ঘুর কতো।
যার কথা মধুর। লেখা মধুর। সবার সাথে সম্পর্ক মধুর মতো, তার জীবনটা মধুর না হয়ে পারে? ফলে তার দাম্পত্য জীবনটাও গড়ে তোলেন মধুর করে। জীবন সঙ্গিনী করলেন যাকে, সত্যি বলতে কি তাঁর নামও মধুর। কি চমৎকার মিল। এ যেনো কবির স্বপ্নের বাস্তবরূপ।
এক সময় কবির সংসারে এলেন দুজন নতুন মেহমান। আদনান ও আবদুল্লাহ সোহায়েম, আর একজন আনিকা আঞ্জুমি। প্রতিটি নামের সাথে যেন মধু মিশ্রিত। দু’সন্তান আর স্ত্রী মধুকে নিয়ে কবির সংসার খুব সুন্দরই চলতেছিল।
শিল্পকোণের যে আয় হতো এ দিয়ে তার সংসার ভালই চলছিল। কারণ তারতো আর বেশি চাওয়া-পাওয়া নেই। যা রোজগার করতেন তা দিয়ে মাসের হিসাব চুকিয়ে নিতেন। এতে একটু কষ্ট হলেও তা সহজ করে নিতেন।
এক সময় কবি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন ঠিকভাবে নিজের ব্যবসার দিকে নজর দিতে পারতেন না। ফলে দিন দিন ব্যবসা কমে গেলো। অনেকেই তখন তার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে চাইতেন না। ফলে শিল্পকোণ তাঁর আয়ের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ালো শূন্যের কোটায়। এখন প্রতিষ্ঠান থেকে আয় তো দূরের কথা বিভিন্ন জায়গা থেকে এনে শিল্পকোণের পেটেই ঢুকাতে হয়। এমনিভাবে অনেক টাকা ঋণী হয়ে গেলেন। অনেক বন্ধু দূরে সরে গেলেন। শিল্পকোণে কাজ দেয়া বন্ধ করে দিলেন। তখন মাসিক স্থায়ী আয় দাঁড়ালো মাত্র আড়াই হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে কি চারজনের সংসার চলে? কিন্তু কবি কখনো কারো কাছে তাঁর অভাবের কথা বলতেন না। কোন বন্ধুর কাছে হাত পাততেন না। বিরক্ত করতেন না কাউকে, কিন্তু তবুও কেউ কেউ কবিকে দেখলে বিরক্ত হতেন। আমার ধারণা হয়তো কবি ছিঁড়া জামা গায়ে দিতেন বলে পছন্দ হতো না, অথবা যে কোন সময় টাকা ধার চেয়ে বসতে পারেন এ জন্যে অথবা আমাদের চেয়ে তার কাম বেশি হয়ে যাচ্ছে এই প্রতিহিংসা করে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতেন। আড়াল করে রাখতেন। কিন্তু কবিকি কাউকে বিরক্ত করেছেন? না। দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছেন, ছিঁড়া জামা পরেছেন, টাকার অভাবে বাজার করতে পারেননি, খালি ব্যাগটি নিয়ে বাসায় ফিরেছেন, ৫ টাকার জন্য একটি টেবলেট কিনে খেতে পারেননি বলে নিজের ঘাড়, চুল নিজে টেনেছেন, মাত্র একশটি টাকা জোগাড় করতে না পারায় দোকান থেকে চশমা আনতে না পেরে অন্ধের মতো হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে চলেছেন, কিন্তু যে কবি মাথা উঁচু করে এসেছেন সে কবি তার মাথা উঁচুই রেখেছেন। কারো কাছে মাথানত করেননি কখনো। টাকার জন্যে নিজের বিবেককে বিক্রি করেননি। কোন বন্ধুকেও বিরক্ত করেননি। হয়তো তার অনেক বন্ধু তার অবস্থা জানতো, জেনেও না জানার ভান করে থাকতেন।
অবশেষে কবি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একদিকে দারিদ্র্যতা অন্যদিকে অসুস্থতা কবিকে তিলে তিলে শেষ করে দিল। কবির কোন কোন বন্ধু মুখ খুললেন। দু-একজনের সাথে আলোচনাও করলেন কবির চিকিৎসার জন্য। কিন্তু যারা ইচ্ছা করলে কবির জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন তারা মুখ খুললেন না। কবির চিকিৎসার জন্য এগিয়ে এলেন না কেউ। এক সময় ঢাকা সাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মানছুর কবির সব বিষয় জানার চেষ্টা করলেন। নিজের হক আদায়ের জন্যে পাগলপারা হয়ে গেলেন, নিজের প্রতিষ্ঠান স্পন্দনে কবিকে চাকরি দিলেন। সেই সময়টি হলো ২০০২ সালের মার্চ মাস। স্পন্দনে কবির সাথে তাঁর গানের সুর দিতেন শিল্পী মশিউর রহমান, ছয় মাস দু-প্রতিভার কর্মচাঞ্চল্যতায় ভরে ওঠে স্পন্দনের সেই স্টুডিও। এতো গান লিখেছেন তিনি স্পন্দনে বসে যা ইতিহাস হয়ে থাকবে। গোলাম মোহাম্মদকে নিয়ে যতো লেখা হবে তার সাথে যোগ হবে স্পন্দনের কথা এর সাথে জড়িয়ে থাকবে শিল্পী মশিউর রহমান। স্পন্দনে বসেই কবি লিখেন,
‘পদ্মা নদীর পাড়ের মতো
ভাঙছে যেন মন
ঘূর্ণিপাকে যাচ্ছে ভেঙ্গে
তাল তেঁতুলের বন।”
কবি গোলাম মোহাম্মদ ঢাকার রাজপথে ঘুরেছেন, অনেক ঘুরেছেন কিন্তু তার অর্থ কষ্ট দূর করতে পারেননি। চিকিৎসা করার অর্থও ছিল না। সেদিন কোন বন্ধুও এগিয়ে আসেননি। তার মৃত্যুর পরে জেনেছি ২০ আগস্ট ’০২ বিভিন্ন দোকানে দোকানে ঘুরেছেন বাকিতে কয়টা টেবলেট কিনার জন্য কিন্তু তাও সংগ্রহ করতে পারেননি। অবশেষে ২১ আগস্ট সম্পূর্ণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কবির আত্মীয়রা ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু বলা হয়েছে সিট খালি নেই, ইবনেসিনা ক্লিনিকে নেয়া হলেও বলা হয়েছে সিট খালি নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের ধারণা, কবি গোলাম মোহাম্মদ হয়তো হাসপাতালের টাকা পরিশোধ করতে পারবেন না। অবশেষে তাকে গ্যাসট্রোলিভার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ততক্ষণে তার সব শেষ হয়ে গেছে, হাত পা ছেড়ে দিয়েছেন। কবির বন্ধু ডাক্তার রফি ভাই বলেছেন, এখন মাত্র সময়ের ব্যাপার। ২১ তারিখ দিবাগত রাত যখন চারদিকে ফজরের আযান ভেসে এলো চারদিকে আবছা অন্ধকার, তখনই কবি এ দুনিয়ার সব মায়া ছেড়ে চলে গেছেন পরপারে, আর চারদিকে শোর উঠলোÑ
“হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি
তাইতো তারে করুণ কেঁদে ডাকি।”




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com