ডেঙ্গু ভাইরাসের আক্রমণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুর হার আমাদের চরম আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে। মৃতের পরিবারে নেমে এসেছে অমানিশার অন্ধকার। দিশাহারা হয়ে পড়েছে আত্মীয়-স্বজন। এই ভয়ের ঢেউ আন্দোলিত করছে পুরো দেশকে। এ সংকট মুহূর্তে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র ভরসা কীটনাশক। কীটনাশকের কার্যকারিতা নিয়ে সর্বমহলে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে এত এত কথা হচ্ছে, কিন্তু এডিস রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুর হার প্রতিদিন রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাহলে কীটনাশক কি অকার্যকর? অনেক গণমাধ্যম কর্মী ভাই ও বোনেরা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেছেনÍআসলেই কি কীটনাশকে কোনো পূর্ণাঙ্গ মশা বা লার্ভা মারা যাচ্ছে। অনেক সভা-সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা এর কার্যকারিতার কথাও বলে আসছেন। এখানে কিছু অতিসাধারণ বিষয় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। মশার লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশা দমনে ব্যবহৃত টেমিফস (লার্ভিসাইড) ও ম্যালাথিয়ন (এডাল্টিসাইড) দুটোই অর্গানোফসফরাস ইনসেক্টিসাইড এবং এরা কন্ট্রাক ইনসেক্টিসাইড। এ দুই ইনসেক্টিসাইডই নিউরোটক্সিক। অর্থাৎ এগুলোর অবশ্যই মশা বা লার্ভার শরীরের সংস্পর্শে আসতে হবে। তাই আমাদের প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে মশার শরীরের যেসব স্থান দিয়ে এ কীটনাশকগুলো প্রবেশ করে সেসব স্থানের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা। অর্থাৎ মশার কিউটিকল, স্পাইরাকল, মুখাপাঙ্গ বা পুঞ্জাক্ষি প্রভৃতির স্বাভাবিক গঠন ও কার্যকারিতা ঠিক আছে কিনা। মশা বা লার্ভা যখন কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠবে তখন মশার এসব মরফোলোজিক্যাল পরিবর্তন হবে যা কীটনাশকের যথাযথ প্রবেশ প্রতিরোধ করবে। এ প্রতিরোধী হওয়ার পেছনে কীটনাশকের উৎস অর্থাৎ কোন ধরনের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হয়েছে তার অ্যাকটিভ উপাদান ও ব্যবহৃত ফরমুলেন্ট কেমন এবং প্রয়োগের সময়, পরিমাণ ড্রপলেট সাইজ এবং প্রয়োগের দূরত্বের সঙ্গে স্প্রে কাভারেজ কেমন হচ্ছে, অর্থাৎ যে প্রয়োগ করছে তার চলার গতিবেগ এবং স্প্রে প্রবাহিত নজলের কোনো ফ্রিকুয়েন্ট মুভমেন্ট আছে কিনা। অর্থাৎ নজল সামান্য ঘোরাফেরা করলে এর ডায়ামিটার চেঞ্জ হয়ে যাবে যা ড্রপলেট সাইজের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি ডায়ামিটার ১৫০ মাইক্রন হতে ১৯০ মাইক্রন হয় তবে ড্রপলেট সাইজের আয়তন দ্বিগুণ হবে। একইভাবে যদি ৩০০ মাইক্রন হয় তবে ড্রপলেট সাইজের আয়তন আট গুণ হবে। একইভাবে কমে গেলে আয়তনও একই হারে কমে যাবে যা বাতাসের বাধা অতিক্রম করে স্বাভাবিকভাবে মশা বা লার্ভার শরীরের পৌঁছতে পারবেন না। ফলে কীটনাশক লিথাল ডোজে প্রয়োগ করলেও তা সাব লিথাল ডোজে পরিণত হবে এবং মশা ও লার্ভা ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠবে।
এবার আসি মশা কীভাবে বায়োরাসায়নিকভাবে প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। আগেই বলেছি টেমিফোস ও ম্যালাথিয়ন নিউরোটক্সিক। অর্থাৎ এরা মশার স্নায়ুতন্ত্রের সাইনাপসে কলিনার্জিক প্রভাব তৈরি করে এসি টাইল কলিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটিয়ে ডিপোলারাইজেশনে বাধাদান করে আর এ কাজটি হয় কীটনাশকের এসিটাইল কলিনাস্টারেজ এনজাইমের ইনহিবিটর হিসেবে কাজ করার ফলে। এই এনজাইমের প্রভাবে এসিটাইল কোলেন ভেঙে যায় এবং পোস্ট সিনাপটিক লার্ভে ডিপোলারাইজেশন ঘটে। কিন্তু কীটনাশকের প্রভাবে এসিটাইল কোলিন সাইন্যাপটিক ক্লেফ্টে জমা হতে থাকে। এর ফলে নিউরোটক্সিসিটি তৈরি হয় এবং মশা ও লার্ভা মারা যায়। যদি কীটনাশকের এই কলিনার্জিক প্রভাব না থাকে তাহলে মশা বা লার্ভা কোনোটিই মারা যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো, এই কলিনার্জিক প্রভাব কীভাবে নষ্ট হয় এবং কীটনাশকের টক্সিসিটি নষ্ট হয়ে কীভাবে ডি টক্সিফাইং হয় এবং মশা ও লার্ভার প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় সেই বিষয়টিই আমি আলোকপাত করতে চাই। মশার ওপর অর্গানোফসফরাস ইনসেক্টিসাইডের মেটাবলিক ডি-টক্সিফাইং ঘটে জেনেটিক পরিবর্তনের ফলে যা ডি-টক্সিফাইং এনজাইম যেমন এসটারেজ, গ্লুটাথিয়ন এস ট্রান্সফারেজ এবং সাইটোক্রম পি ৪৫০ প্রভৃতি এনজাইমের ডি-টক্সিফাইং ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে মশা বা লার্ভা তাদের নিউরোটক্সিসিটি প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। এখন প্রশ্ন হলো, এই জিনগত পরিবর্তন কতটা পরিবেশগত উপাদান দিয়ে হচ্ছে আর কতটা প্রায়োগিক ত্রুটি বা সাব লিথাল ডোজে ব্যবহৃত একই মুড অব অ্যাকশনের কীটনাশক ব্যবহারের ফলে তৈরি হচ্ছে তা সুস্পষ্ট গবেষণার দাবি রাখে। গবেষণালব্ধ ফলাফলই বলে দিতে পারে পরবর্তী কীটনাশকের গ্রুপ, ডোজ ও প্রয়োগ পদ্ধতি। এজন্যই অভিজ্ঞ মেডিকেল এন্টোমোলজিস্ট প্রয়োজন।
এখন মশার আচরণগত পরিবর্তনের কথা। কীটনাশকের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ নিশ্চিত না হওয়ার কারণে মশা দ্রুত তার আচরণগত পরিবর্তন সাধন করতে পারে। যেমন এন্ডোফিলিক মানে মশা রক্তপান করার পর বাইরে রেস্ট না নিয়ে ভেতরে রেস্ট নেয়ার আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে। তাই মশার প্রতিরোধী হয়ে ওঠার সব বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েই কীটনাশক নির্বাচন ও প্রয়োগ পদ্ধতি প্রণয়ন করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে হিতে বিপরীত ফলাফলে নিপতিত হতে হবে। অথবা এক্সোফিলিক অর্থাৎ ভেতরে রেস্ট না নিয়ে বাইরে রেস্ট নেয়ার অভ্যাস করে ফেলে একইভাবে মেটিং পিরিয়ড পরিবর্তন করে। কারণ মেটিংয়ের পর পরই তাদের রক্তপান করার প্রয়োজন হয়। একইভাবে ডিম পাড়ার সময়ও স্থান পরিবর্তন করে কীটনাশকের বিষক্রিয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করে। খাদ্য গ্রহণের সময়ও স্থান পরিবর্তন করে বিষাক্ততা থেকে নিজেদের রক্ষা করে। এভাবে কীটনাশক প্রয়োগের সময় ও স্থান থেকে নিজেদের রক্ষা করে। লেখক: ড. মো. গোলাম ছারোয়ার: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ ,জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)