মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের কালাপুর গ্রামে অবস্থিত মরহুম ‘হাজী আলফত মিয়া এতিমখানা’ কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে রয়েছে ভিন্ন চিত্র। এতিমখানা পরচালনা কমিটির সভাপতি ও কালাপুর হাফেজিয়া মাদরাসার পরিচালক আব্দুল জলিল নূরী এবং সাধারণ সম্পাদক তার পুত্র দেলোওয়ার হোসেন আল কাদরীর বিরুদ্ধে জীবিত ব্যক্তিদের মৃত দেখিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এতিমদের নামে আসা সরকারি অর্থ বছরের পর বছর আত্মসাৎ, এতিমখানা নিয়ে বাণিজ্য এবং দাদন (সুদ) ব্যবসাসহ নানা অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগ ওঠেছে। গত জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ নিয়ে ‘দৈনিক খবরপত্র’র অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে পিতা-পুত্র সিন্ডিকেটের নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়নের কালাপুর গ্রামে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কালাপুর মরহুম হাজী আলফত মিয়া এতিমখানা। ২০১৭ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট প্রাপ্ত হয়। রেজি. নং : মৌলভী-৪৫৪/২০১৭। এর পর থেকে এতিমের নামে সরকারি অনুদানের টাকা দেওয়া হচ্ছে ওই এতিমখানায়। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রলায়ের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায় ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ২য় কিস্তি (জানুয়ারি ২০২৩ হতে জুন ২০২৩ পর্যন্ত) কালাপুর মরহুম হাজী আলফত মিয়া এতিমখানায় ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট বরাদ্দ পেয়েছেন ১৭জন এতিম। যার পরিমাণ ২,০৪০০০/-। ভুয়া এতিম দেখিয়ে সরকারি বরাদ্দ নিয়মিত গ্রহণ করেন আব্দুল জলিল নূরী। গত দুই মাসে এতিমখানায় কয়েকদিন সরেজমিন ঘুরেও কোনো এতিম পাওয়া যায়নি। তবে হাফেজিয়া মাদরাসায় কয়েকজন শিক্ষার্থীদেরর দেখা মিললো। প্রকৃতপক্ষে কোনো এতিম আছে কিনা এবিষয়ে একাধিকবার সরেজমিন মাদরাসায় গিয়ে এতিমদের ভর্তি রেজিস্টার খাতা, জন্মনিবন্ধন এবং তালিকা দেখতে চাইলে বারবার ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসতে হয়েছে। এলাকায় সরেজমিন ঘুরে স্থানীয়দেও কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, কাগজে কলমে এতিম দেখানো হলেও বাস্তবে এতিম নয়, এমন শিক্ষার্থীদের নাম ব্যবহার করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ভুয়া এতিমের তালিকা পাঠিয়ে এতিমদের নামে আসা সরকারি অর্থ নিয়মিত উত্তোলন করছেন কমিটির সভাপতি আব্দুল জলিল নূরী। আর দুয়েকজন এতিম থাকলে তাদের পেছনে যাথাযথভাবে সরকারি অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে না বলেও জানান এলাকাবাসি। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান কালাপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসায় চলছে অধর্মের কাজ কারবার। জীবিত পিতাকে কাগজে-কলমে মেরে ফেলে শিশু শিক্ষার্থীদের ভুয়া এতিম দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয় তাদের নামে আসা সরকারি টাকা। উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে পাওয়া ৩৭জন এতিমের তালিকা যাচাই করতে সরজমিন শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় যাওয়া হয়। এতে দেখা যায় তালিকায় থাকা অধিকাংশেরও বেশি শিক্ষার্থীদের অভিভাবক জীবিত রয়েছেন। এতিমখানা থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তালিকায় এতিম দেখানো কয়েকজন শিশুর মা-বাবার সাথে কথা হয়। তালিকায় দেখানো এতিম হলেও বাস্তবে এতিম নয় তারা। এতিমখানা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি পদে আব্দুল জলিল এবং সাধারণ সম্পাদক পদে তার ছেলে দেলোয়ার হোসেনকে দেখিয়ে পিতা-পুত্রের কমিটি কর্তৃক এতিমদের ভুয়া তালিকা তৈরি করে সরকারের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা। এতিমখানাটি সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ডপ্রাপ্ত হবার পর প্রতি বছর এখানে অবস্থানরত এতিম নিবাসীদের জন্য সরকারের তহবিল থেকে প্রতি মাসে সরকারি বরাদ্দের ক্যাপিট্যাশন গ্রান্ডের জনপ্রতি ২ হাজার টাকা করে এতিমের নামে দুই কিস্তিতে মাসিক দুই হাজার টাকা করে বছরে ৩৪ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়। এ এতিমখানা হাজী আলফত মিয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও তার পরিবারের কোন সদস্যকে এটির পরিচালনা কমিটিতে রাখা হয়নি। এলাকাবাসি সূত্রে জানা যায়, যার নামে এ এতিমখানা তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নে। এতিমখানার প্রতিষ্ঠাতা হাজী আলফত মিয়ার পুরো পরিবার ইউরোপে বসবাস করছেন। বিত্তশালী পরিবারের মরহুম হাজী আলফত মিয়ার সন্তানরা সমাজের কল্যাণে আত্মনিয়োগের লক্ষ্যে তাদের বাবার নামে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। পূর্ব পরিচিত হিসেবে আব্দুল জলিল নূরী তার গ্রামে এতিমখানা করার প্রস্তাব করলে আলফত মিয়ার পরিবার সাচ্ছন্দে রাজি হন এবং তাদের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে প্রবাসী অনেকেই এ এতিমখানা পরিচালনার জন্য আর্থিক অনুদান প্রদান করেন। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে এ এতিমখানা থেকে পিতা-পুত্র সিন্ডিকেট ৭০ জনের নাম শ্রীমঙ্গল উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে প্রদান করেন। এর মধ্যে সমাজসেবা কার্যালয় প্রথমে ৭ জন পরে আরও ১০ জনের নাম তালিকাভুক্ত করে মোট ১৭ জনকে প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে অর্থ বরাদ্দ প্রদান করে। পরে চলতি বছরের ২২ আগস্ট পুনরায় পিতা-পুত্র স্বাক্ষরিত ৩৭ জন এতিমের নামের অপর একটি তালিকা সমাজসেবা কার্যালয়ে জমা প্রদান করা হয়। এর আগের এতিম নিবাসীদের কোন তালিকা ওই এতিমখানা কর্তৃপক্ষ বা শ্রীমঙ্গল উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় দিতে পারেনি। গত আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে কালাপুর গ্রামে মরহুম হাজী আলফত মিয়া এতিমখানায় একাধিক দিন সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ওই এতিমাখানা নিচতলায় ‘হযরত শাহপরাণ (রহ.) হল’ রয়েছে। বর্তমানে এ হলে খানকা শরীফ ও অফিস কক্ষ রয়েছে। এ খানকা শরীফে বসে তাবিজ-পানিপড়াসহ চিকিৎসা করেন আব্দুল জলিল নূরী। দ্বিতীয় তলায় ‘হযরত শাহজালাল (রহ.) হল’ এ কোন এতিম শিশু নেই। মাদ্রাসার শিক্ষক মিলনায়তনে রয়েছে একটি ক্যান্টিন। এ ব্যাপারে মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের শিক্ষক হাফেজ শিব্বির আহমেদ বলেন, ‘এখানে বর্তমানে কোন এতিমখানা নেই, এতিমও নেই। দুই মাস ধরে এতিমখানা সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। এর আগে কয়েকজন এতিম ছিল। তবে এর সংখ্যা জানি না। অপরদিকে এতিমখানার অফিস সহকারী মো. আব্দুস ছামাদ বলেন, ‘এতিমখানায় বর্তমানে মোট ৩৭ জন এতিম ছাত্র রয়েছে।
এতিমখানা বন্ধ নয়, এটি চালু আছে। সরেজমিনে ঘুরে মরহুম হাজী আলফত মিয়া এতিমখানা থেকে শ্রীমঙ্গল উপজেলা সমাসেবা কার্যালয়ে প্রদত্ত প্রথম ৭০ জন ও দ্বিতীয় ৩৭ জন কথিত এতিমের মধ্যে কয়েকজনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সকলের পিতাই জীবিত রয়েছেন। অথচ তালিকায় তাদের মৃত দেখিয়ে সরকারি অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। শ্রীমঙ্গল শহরতলীর সুনগইড় আবাসিক এলাকার বাসিন্দা, শ্রীমঙ্গল সাইফুর রহমান মার্কেটস্থ টেইলারিং কাটিং মাস্টার আক্কাছ বেপারীর কাছে সরেজমিন গিয়ে বলা হলো আপনি তো মরে গেছেন কবেই! জীবিত হলেন কিভাবে? তিনি প্রশ্ন শুনে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে জানতে চাইলেন, বিষয়টি পরিস্কার করে বলুন। পরে বলা হলো আপনার নাম কি আক্কাছ বেপারী? আপনার স্ত্রীর নাম কি কুলসুম বিবি? ছেলের নাম কি মহিবুর রহমান শাকিল? তিনি বলেন হ্যা। জানতে চাইলাম আপনার ছেলে কোথায় পড়ে? তিনি বললেন কালাপুর হাফেজিয়া মাদরাসায়। বললাম এ মাদরাসার পরিচালক কর্তৃক পরিচালিত হাজী আলফত মিয়া এতিমখানার তালিকায় আপনি মৃত! এসময় তিনি বলেন আমার ছেলে মহিবুর রহমান শাকিল-কে হাফেজ বানানোর জন্য কালাপুর মাদ্রাসায় কয়েক বছর আগে ভর্তি করি। কিন্তু এট কি শুনলাম। আমি জানতাম না তাদের তালিকায় আমি মৃত ও আমার ছেলে এতিম। এখন জানলাম। আমার ছেলেকে এতিম বানিয়ে সরকারি টাকা লোপাট মেনে নেয়া যায় না। সমাজসেবা অফিসে জমা দেয়া এতিমখানার তালিকায় আক্কাছ বেপারীও মৃত। কালাপুর ইউনিয়নের ভাগলপুর গ্রামের মসাহিদ মিয়া বলেন,‘আমি আমার ছেলে ছামাদ মিয়াকে দুই মাস আগে কালাপুর মাদ্রাসায় ভর্তি করেছি। তারা আমাকে মৃত বানিয়ে আমার ছেলের নামে এতিম হিসেবে সরকারের ভাতা নেয়। আমি এর প্রতিবাদ জানাই। কালাপুর গ্রামের দিনমজুর আহাদ মিয়া জানান, তার ছেলে সুজেল আহমদ কালাপুর মাদ্রাসায় লেখাপড়া করছে। তিনি জানেন না তাকে মৃত বানিয়ে তার ছেলেকে এতিম হিসেবে সরকারের দপ্তরে তালিকা প্রদান করা হয়েছে। একই ধরণের বক্তব্য দিয়েছেন মোস্তফা মিয়া, খালিক মিয়া, ছুরুক মিয়া প্রমুখরা। ওই মাদরাসার ছাত্র জামিল আহমদকে এতিম দেখানো হয়েছে। তার পিতা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমি অক্সি কোম্পানিতে কাজ করছি। ছেলেকে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পাঠিয়েছি মাদ্রাসায়। এখন শুনছি আমি মৃত আর আমার ছেলে এতিম!’ শিক্ষার্থী সিফাত মিয়ার পিতা রশিদ মিয়া বলেন, ‘ছেলেকে মাদ্রাসায় দিয়েছি মানুষের মতো মানুষ হবার জন্য। প্রতি মাসে মাদ্রাসায় সাামন্য টাকা বেতনও দেই। কিন্তু আমি জীবিত থাকার পরও তারা আমার ছেলেকে এতিম বানিয়ে দিলো।’ এছাড়া কালাপুর গ্রামের আরো বেশ কয়েকজনের নাম রয়েছে এ তালিকায়। যাদের অস্থিত্বই নেই ওই গ্রামে। গত কয়েকদিন পুরো কালাপুর, উত্তর কালাপুর, গাজীপুর, পারেরটংসহ বিভিন্ন গ্রাম চষে বেড়ালেও এতিমের তালিকায় থাকা ওই নামের মানুষদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুর রহমান(৫৫), ফুল মিয়া(৪৮), আলাল মিয়া(৩৮), আব্দুল হান্নান(২৬) ও সোহান মিয়া(১৮) এর সাথে কথা বললে তারা জানান এসব নামে কোন মানুষ আমাদের গ্রামে নেই। মাদরাসা ও এতিমখানার পরিচালক আব্দুল জলিল নূরী এবং তার পুত্র দেলোয়ার হোসেন স্বীকৃত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কামিল বা টাইটেল পাশ না করেও তারা নিজেদেরকে দাবি করেন মাওলানা হিসেবে। এলাকাবাসীর কাছে পিতা আব্দুল জলিল নূরী বড় হুজুর ও পুত্র দেলোয়ার হোসেন আল ক্বাদরী ছোট হুজুর নামে পরিচিত। শীত মৌসুমসহ বিভিন্ন সময় তারা বক্তা হিসেবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিলে অংশ নেন। সুললিত কণ্ঠে ওয়াজ মাহফিলে তিনি সাধারণ মানুষকে হিদায়ের বাণী শুনান। হালাল, হারাম, সুদ ঘোষ, মানুষের হকসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি বয়ান করেন। স্থানীয় সচেতন মানুষেরা বলেন, আব্দুল জলিল নূরী এবং দেলোয়ার হোসেন সাদা লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবী এবং লম্বা উচুঁ টুপি মাথায় পড়ে আলেমের লেবাসে চলাফেরা করে সরলমনা মুসলমানদের ধোকা দিয়ে এতিমখানা এবং মাদরাসার নামে দেশ বিদেশ থেকে চাঁদা এনে আত্মসাৎ করে রাতারাতি প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক বনে গেছেন। তথাকথিত মাওলানা আব্দুল জলিল নূরী ও দাখিল পাশ না করা বক্তা দেলোওয়ার হোসেন দেশের অনেক জায়গায় ওয়াজ মাহফিল করেন। ইউটিউবসহ অনলাইনেও এ দুই বক্তার বয়ান পাওয়া যায়। তারা মাহফিলে মানুষকে হালাল উপার্জন করা, মানুষের হকে ব্যাপাওে সচেতন থাকাসহ সুদ মুক্ত সমাজ গড়ার আহ্বান জানালেও তিনি ও তার বড় পুত্র নিজেরাই চালিয়ে যাচ্ছেন জমজমাট সুদের কারবার। শ্রীমঙ্গল শহরের পোস্ট অফিস রোডস্থ সাইফুর রহমান সুপার মার্কেটের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায়, আব্দুল জলিল নূরীর পুত্র দেলোয়ার হোসেন আল ক্বাদরী সুদের কারবারে বিনিয়োগ করেছের বিপুল অঙ্কের টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি মাসে প্রতি এক লক্ষ টাকায় তিনি সুদ নেন ৩ হাজার টাকা করে। দৈনিক খবরপত্র –এর সাথে আলাপকালে কালাপুর গ্রামের ব্যবসায়ী লোকমান মিয়া বলেন, ‘আমি দুই লক্ষ টাকা নিয়েছিলাম এক বছরের জন্য। জলিল মোল্লার সাথে আমার কথা ছিল এক বছরে দুই লক্ষ টাকায় নব্বই হাজার টাকা দিতে হবে। এই শর্তে আমি দুই লক্ষ টাকা নিয়েছিলাম। দুই লক্ষ বিশ হাজার টাকা পরিশোধ করার পর এখন সত্তর হাজার টাকা লাভের জন্য আমাকে চাপ প্রয়োগ করে চলেছে। তার চাপে আমি কঠিন অবস্থায় রয়েছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরো এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি গত ঈদের আগে দোকানে মাল তোলার জন্য এক লক্ষ টাকা দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে এনেছিলাম। টাকা আনার ৫-৭ দিন পর ঈদের আগেই দেলোয়ার হোসেনকে পুরো টাকা পরিশোধ করি। তথাপিও তিন হাজার টাকা লাভ দিতে হয়েছে। একই কথা জানালেন শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য অজয় সিং। তিনি বলেন, ‘জলিল নূরী সাহেবের ছেলে দেলোয়ার হোসেনের নিকট থেকে আমি কিছু টাকা এনেছিলাম। ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্থ হলে আমি আসল টাকা এবং লাভের কিছু টাকা পরিশোধ করার পরও আরো লাভের টাকার জন্য আমাকে চাপ দেয়া হয়। পরে তার পিতার উপস্থিতিতে ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. কামাল হোসেনের অফিসে সালিশ হয় এবং আরো কিছু টাকা আমি পরিশোধ করি। এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. কামাল হোসেন শালিসের বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘আমার অফিসে দেলোয়ার হোসেনের সাথে অজয় সিং এর একটি বিচার হয়েছিল। আব্দুল জলিল নূরী নিজেকে মাওলানা হিসেবে দাবি করেন। মাওলানা হতে হলে কামিল বা টাইটেল উত্তীর্ণ হতে হয়। কিন্তু তিনি এসব পরীক্ষায় পাশ দুরের কথা মাধ্যমিক সমমান পর্যন্তও লেখাপড়া করেননি। তার ছেলেরা লেখাপড়া করেছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিরাজনগর গাউছিয়া জালালিয়া মমতাজিয়া ছুন্নীয়া ফাযিল (ডিগ্রী) মাদরাসায়। ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ শেখ শিব্বির আহমদ বলেন, ‘আব্দুল নূরী খুব সম্ভবত সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন বলে শুনেছি। তার পুত্র দেলোয়ার হোসেনসহ অন্যান্য ছেলেরা আমাদের মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিলেন। তারা কেউ দাখিল পাশও করেননি। এর আগেই লেখাপড়া ছেড়ে দেন। তারা জীবিত মানুষকে যে মৃত বানিয়ে এতিমখানা চালাচ্ছে তা ভয়ঙ্কর। এটি কোনভাবেই কাম্য নয়। অভিযোগের ব্যাপারে বেশ কয়েকদিন কালাপুর মাদ্রাসা ও এতিমখানায় গিয়ে আব্দুল জলিল নূরী বা তার ছেলে দেলোয়ার হোসেনকে পাওয়া যায়নি। পরে আব্দুল জলিল নূরীর মুঠোফোনে কল করা হলে প্রথম দিন তিনি বলেন আগামীকাল অফিসে আসেন। তার কথামেতো নির্ধারিত তারিখে মাদরাসায় গেলে তাকে না পেয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি মৌলভীবাজার আছেন, খুব ব্যস্ত বলে কেটে দেন। এর কয়েকদিন পর আবার যোগাযোগ করলে বলেন তথ্য সমাজসেবা অফিসে দেয়া আছে এখান থেকে আনে। তালিকা দিতে তিনি অনেকদিন নানা টালবাহানা করেছেন। সর্বশেষ ৯ সেপ্টেম্বর পরিচালক নূরীর নম্বরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি পরিচয় জানার পর আরেকজ ব্যক্তির কাছে মুঠোফোন তুলে দেন। এসময় তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন আপনি যার নম্বরে কল দিছইন আমি তানর ছেলে। তিনি বলেন, ‘আপনারা কিতার লাগি এইভাবে লাগিয়া ফরিয়া উঠছইন? আপনারা ইতা কি আরম্ভ করছইন। আমরার এতিমখানা বন্ধ আপনারা ইতা জানইন না? এতিমখানা বন্ধ আছে। আমরা ট্যাকা পাইতাম ৭ জনের আর আপনারে কইন ১৭ জনের? সমাজসেবা অফিসে যাইন। তারা কইবোনে। আর আমারে ফন দিইওইন না। এই নম্বরে কল দিলে তোমার …!এ কথা বলেই তিনি কল কেটে দেন। এ ব্যাপারে আব্দুল জলিল নূরী বলেন, ‘ঝামেলার কারণে এখন এতিমখানা বন্ধ রয়েছে। আমার এতিমখানায় যারা ছিলো তারা এতিমই ছিল। মাত্র তিনজন এতিম ছিল না। ওই তিন জন ভর্তির সময় আমি আছলাম না। বাকি সব এতিম ছিল। ২০২২ সালে তারা ভর্তি হয়েছিল। পরে তাদের এতিমখানা থেকে বাদ দিয়েছিলাম। এ তিনজনকে ভর্তি করা আমার ভুল হয়েছে। না জাইননা আমি অপরাধ করেছি। তিনি ও তার পুত্র দেলোয়ার হোসেনের সুদের ব্যবসার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সুদের কারবারের সাথে আমি বা আমরা জড়িত নই। এসব মিথ্যা কথা। তার শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সামান্য লেখাপড়া করেছি। এই শিক্ষা দিয়ে আপনি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হলেন কি করে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি নিরোত্তর থাকেন। শ্রীমঙ্গল উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. সুয়েব হোসেন চৌধুরী বলেন, ২০২২ সালে কালাপুরস্থ হাজী আলফত মিয়া এতিমখানা থেকে আমাদের কাছে ৭০ জন এতিমের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে আমরা ৭ জনের নামে বরাদ্দ দেই। পরবর্তীতে আরো ১০ জনের বরাদ্দ হয়। ৭০ জনের মধ্যে কোন ১৭ জন বরাদ্দপ্রাপ্ত তা এতিমখানা কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন। পরবর্তীতে এতিমখানা থেকে ৩৭ জনের নামের তালিকা আমাদের দেওয়া হয়েছে। গত প্রায় এক মাস পূর্বে এতিমখানা সভাপতি আব্দুল জলিল নূরী আমাকে মৌখিকভাবে জানান, কিছু ঝামেলার কারণে এতিমখানা বন্ধ রয়েছে। এর আগে তিনি ১৭ জনের বরাদ্দ প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে নিয়েছেন। এখন উনাদের কথা অনুযায়ী যেহেতু এতিমখানা বন্ধ রয়েছে সেহেতু আমরা বরাদ্দ বন্ধ রেখেছি। এতিমখানা চালু হলে পুনরায় তারা বরাদ্দ পাবে। আমরা তাদের তালিকা অনুযায়ী বরাদ্দ দিয়ে থাকি। ভুয়া এতিম দেখিয়ে সরকারি বরাদ্দ আত্মসাৎ করার অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমার কাছে কেউ লিখিতভাবে কোনো অভিযোগ করেনি। আপনাদের মাধ্যমে যেহেতেু বিষয়টি আবগত হয়েছি আমি তদন্ত করবো। তবে কোনো শিক্ষার্থীর অভিভাবক যদি লিখিতভাবে এ বিষয়ে অভিযোগ দেন তাহলে এই এতিমখানা এবং যারা অনিয়ম বা আত্মসাতে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।