বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়ছে
মূল্যস্ফীতি বেশি, ঝুঁকিতে ব্যাংক, আছে নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা। বিশ্বব্যাংক অর্থনীতিতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। বিশেষ করে বিনিময় হার, মুদ্রানীতি, আর্থিক খাত এবং রাজস্ব খাতে বড় সংস্কার করতে হবে। অর্থনীতি এখন বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে। এতে অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থাকে এভাবেই দেখছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক বলছে, এ দেশের অর্থনীতিতে এখন চার ধরনের সংকট ও তা উত্তরণের চ্যালেঞ্জ আছে। এগুলো হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির চাপ, আর্থিক খাতের ঝুঁকি এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে দেশের অর্থনীতি নিয়ে এসব কথা বলা হয়েছে। এই উপলক্ষে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল্লায়ে সেক। প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের দুই কর্মকর্তা বার্নাড হেভেন ও নাজমুস সাদাত খান।
প্রতিবেদনে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পূর্বাভাসও দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক মনে করছে, নানা অনিশ্চয়তায় চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। সংস্থাটির পূর্বাভাস হলো, এবার জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে, গত অর্থবছরের ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে পারলে এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক করা সম্ভব হলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে যা বলেছে:বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি। আগামী দিনেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। এটি নির্ভর করবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য কেমন থাকে, এর ওপর। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস হলো ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশ হবে। এর মানে, চলতি অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতি নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছে না বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। যা আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক চারটি কারণ দেখিয়েছে। এগুলো হলো: দেশের বাজারের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি; দুর্বল মুদ্রানীতি; টাকার অবমূল্যায়ন; সরবরাহব্যবস্থায় বিঘœ এবং কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ।
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল্লায়ে সেক এ নিয়ে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে। মানুষের ভোগ চাপের মুখে পড়েছে। মজুরি বৃদ্ধির তুলনায় খাবারের দাম বেশি বেড়েছে। এতে নি¤œ আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। তাঁদের কেনার সামর্থ্য কমেছে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহারের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সুদের হারের সীমা পর্যায়ক্রমে তুলে দেওয়া উচিত। এ ছাড়া ব্যাংক খাতের কার্যকর তদারকির মাধ্যমে আর্থিক খাতের ঝুঁকি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
ব্যাংক খাতে দরকার কঠোর তদারকি: দেশের আর্থিক খাতের ঝুঁকি বেড়েছে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির প্রতিবেদনে এ নিয়ে বলা হয়েছে, ব্যাংকের দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদ, খেলাপি ঋণ এবং ঋণ অবলোপনের প্রবণতা বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভ কমছে। মূলধন কম এমন ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
ব্যবসা-বাণিজ্যে বহির্বিশ্বের চাপ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলছে, এ ছাড়া রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের গতি কমে যাওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। বিপুলসংখ্যক কর্মী বিদেশে গেলেও সেই অনুযায়ী প্রবাসী আয় আসছে না। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে একাধিক বিনিময় হার চালু হওয়া প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিনিময় হার এখনো বাজারভিত্তিক হয়নি, যা রিজার্ভ কমাচ্ছে।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের কারণেও অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এটিও অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল্লায়ে সেক বলেন, নির্বাচনের কারণে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। বিনিয়োগকারী এ সময় একটু অস্বস্তিতে থাকেন। যেকোনো নীতি পরিবর্তনের শঙ্কায় থাকেন তাঁরা। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়; সব দেশেই নির্বাচনের সময়ে এমন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে। মানুষের ভোগ চাপের মুখে পড়েছে।
বিশ্বব্যাংক অর্থনীতিতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। বিশেষ করে বিনিময় হার ধরাবাঁধার বাইরে রাখা, মুদ্রানীতি আধুনিক করা এবং রাজস্ব খাতের সংস্কারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, বহিঃ খাতের সমস্যা সমাধানে বিনিময় হারে যেসব অসংগতি আছে, তা দূর করতে হবে। এ জন্য বিনিময় হারের সীমা তুলে দেওয়া উচিত; যা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে বিনিময় হারের পার্থক্য কমে আসতে সহায়তা করবে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে, যদি না বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো না হয়। অপ্রত্যাশিত বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে; যা খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে নিত্যপণ্যের ওপর শুল্ক কমানোর সুপারিশ করে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, আর্থিক খাতের ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে, যদি খারাপ ঋণ বেড়ে যায় এবং ব্যাংক খাতের তারল্যের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করে। এ ছাড়া রাজস্ব আদায় বাড়াতে সংস্কারের পরামর্শ দেয় বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের মতে, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও অনিশ্চয়তা বেড়ে গেলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করবে; যা রপ্তানির ক্রয়াদেশ কমিয়ে দেওয়াকে উসকে দেবে। এর ফলে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে আবারও চাপ পড়বে। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিবছর গড়ে ১ দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে দারিদ্র্য কমেছে। অন্যদিকে নগরায়ণ বেড়েছে। এর ফলে বৈষম্যও বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল্লায়ে সেক সবশেষে বলেন, ‘এখনো আমি বাংলাদেশের বিষয়ে আশাবাদী। কয়েক বছরজুড়ে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিল। বাংলাদেশ জনমিতির সুবিধা পাচ্ছে। এখানে তরুণ জনগোষ্ঠী বেশি। এ ছাড়া রপ্তানি বাজারেও বাংলাদেশের অংশীদারত্ব বাড়ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে নীতি সমন্বয় করতে হবে।’