রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪০ পূর্বাহ্ন

অপরিকল্পিত সুইসগেট অস্তিত্ব হারাচ্ছে চলনবিলের নদ-নদী

গুরুদাসপুর (নাটোর) প্রতিনিধি :
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৩

পদ্মায় জন্ম আর যমুনায় বিলীন। নদীটির নাম প্রমত্তা বড়াল। ২২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই নদীর পেট চিরে জন্মেছে নদ-নদী, খাল-বিল। পদ্মা ও যমুনার পানি এই নদী হয়েই গড়িয়ে পড়ে দেশের সর্ববৃহৎ চলনবিলে। অথচ ৫০০ ফুট প্রস্থের নদীটির উৎসমুখে ১৯৮৪ সালে নির্মিত হয়েছে তিন কপাটের একটি সুইসগেট। সেই থেকে বড়াল হারালো তার যৌবন। শুধু বড়াল নয়, এই সুইসগেটের কারণে যৌবন হারিয়েছে নন্দকুঁজা, নারদ, চিকনাই, রূপনাইয়ের মতো চারটি বড় নদ ও নদী। একই সাথে চলনবিলের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ৪০টির মতো ছোট নদীও। সেই সাথে প্রায় ২০০টি নালা এবং অন্তত ২৫০টি বিল মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। ১৯৮৪ থেকে ২০২৩ সাল- দীর্ঘ এই ৩৯টি বছর ধরে সুইসগেটের বন্ধনে আটকা পড়ে মিলিয়ে গেছে মির্জামামুদ, তুলশীগঙ্গার মতো ছোট ছোট নদীর চিহ্নটুকুও। রাজশাহীর চারঘাট থেকে উৎপত্তি হয়ে চলনবিলের বুক চিরে বয়ে চলা বড়াল নদীটি মুশাখাঁ, আত্রাই, গুমানি, নন্দকুঁজা, চিকনাইসহ বেশ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির হুড়াসাগর হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে। চলনবিল রক্ষা ও বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান জানান, দেশের বৃহত্তম পদ্মা, যমুনা নদী এবং বিশাল জলাভূমির চলনবিলের মধ্যে প্রধান সংযোগ নদী বড়াল। আশির দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড অপরিকল্পিতভাবে নদীর উৎসমুখ ও ৪৬ কিলোমিটার ভাটি এলাকার আটঘরিতে সুইসগেট নির্মাণ করার পর থেকেই মরতে বসেছে বড়াল, মরতে বসেছে বড়ালের পানি পানে তৃষ্ণা মেটানোর চলনবিল। জানা গেছে, উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই ১৯৮৪ সালে রাজশাহীর চারঘাট এলাকায় প্রায় সাড়ে ৫০০ ফিট প্রস্থের বড়ালের উৎসমুখে মাটির বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয় নদীটির পানিপ্রবাহ। একটি বিশাল নদীর পানিপ্রবাহ কী কারণে বন্ধ করে দেয়া হলো তা ভাটি অঞ্চলের মানুষরা কেউ জানলো না। ওই মাটির বাঁধের কারণে উত্তাল পদ্মার পানি আর বড়ালে গড়ায়নি। ফলে খরায় ও তৃষ্ণায় মরতে থাকে চলনবিল ও বিল সংশ্লিষ্ট নদ-নদী-নালা। পরবর্তীতে ভাটির মানুষের দাবির মুখে ওই মাটির বাঁধে সাড়ে ৫০০ ফুট প্রস্থের ২১ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহের বড়ালের উৎসমুখে মাত্র ৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহের জন্য ৩০ ফুট প্রস্থের জলকপাট নির্মাণ করা হয়। এভাবেই ২১ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহের বড়ালের বুকে মাত্র ৫ হাজার কিউসেক নিয়ন্ত্রিত পানি প্রবাহের ফলে খরস্রোতা বড়াল হারিয়ে ফেলল তার জৌলুশ। শুধু তাই-ই নয়, ২২০ কিলোমিটার নদীপথের মধ্যে গত ৪০ বছরে বড়ালের ১২০ কিলোমিটার বেদখল হয়ে যায়। বড়ালের পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় চলনবিলের নদী ও খালের মধ্যে আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, গুড়, করতোয়া, বড়াল, তুলসি চেঁচিয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, নবীরহাজির জোলা, হকসাহেবের খাল, নিমাইচড়াখাল, বেশানীরখাল, গুমানীরখাল, উলিপুরখাল, সাঙ্গুয়াখাল, দোবিলাখাল, কিশোরখালির খাল, বেহুলারখাড়ি, বাঁকইখাড়া, গোহালখাড়া, গাড়াবাড়ি খাল, কুমারভাঙ্গাখাল, জানিগাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধরসহ অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে খরায় পুড়ে মরছে। বড়ালের এই মুমূর্ষদশা থেকে উদ্ধার কল্পে গত ২০০৮ সাল থেকে বড়াল ও চলনবিলের নদ-নদী রক্ষার আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংকে (আই ডব্লিউ এম) বড়াল নদীর পানি সম্পদ পুনরুদ্ধারে সমীক্ষা প্রকল্প শুরু হয়। ওই সমীক্ষার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বড়ালের উৎসমুখে চারঘাট এলাকায় দেয়া সুইসগেট অপসারণ করে সেখানে ব্রিজ নির্মাণ এবং বেহাত হওয়া ১২০ কিলোমিটার দখলমুক্ত করাসহ ২২০ কিলোমিটার নদী খননের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড চারঘাটের সুইসগেট বহাল রেখে প্রকল্পটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে বাস্তবায়ন করতে চাইছে। এতে শুধু দীর্ঘসূত্রিতাই বাড়বে। কাজের কাজ কিছুই হবে না। নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বড়ালের উৎসমুখে নির্মিত সুইসগেটটি বর্তমানে কোনো কাজে আসছে না। তবে এটি তৎকালীন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণের কারণে। নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডে তথ্য মতে, বছরখানেক আগে ‘বড়াল নদীর অববাহিকায় পানি সম্পদ পুনরুদ্ধার’ নামে একটি প্রকল্প জমা দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়ে দুই হাজার ৫২ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় বড়াল নদীর ১০৪ কিলোমিটার, নারোদ নদীর ৪৩ কিলোমিটার এবং মুসাখাঁ নদীর ৬ কিলোমিটার খননের কথা বলা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, বিগত ৩০ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এসব নদ-নদীতে সারা বছর জুড়েই ৬-১২ ফুট পানি থাকত। বছরজুড়েই নৌচলাচল করত। বর্তমানে পানিপ্রবাহ না থাকায় পলি জমে নদী ও খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে। ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, একদিকে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব, অন্যদিকে বড়ালের উৎসমুখে অপরিকল্পিত সুইসগেট নির্মাণের ফলে চলনবিলের বিভিন্ন নদ-নদী-বিল, জলাশয় ও খালগুলোতে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। তা ছাড়া, বিলের মাঝ দিয়ে যথেচ্ছভাবে সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করায় চলনবিলকে নানা বাঁধের বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হয়েছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com