সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪৮ পূর্বাহ্ন

বিপদ আসার কারণ

আবদুল কাইয়ুম শেখ:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০২৪

জীবন ফুলসজ্জা নয়। জীবনযুদ্ধে বিভিন্ন বিপদাপদ, বালা-মুসিবত ও ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিকূল পরিস্থিতি ও বৈরী আবহাওয়ার মোকাবেলা করতে হয়। নানা সঙ্কট, জটিলতা ও ঝড়ঝাপটা উতরিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হয়। রকমফের কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করতে হয়। জীবনচলার পথে এগুলো সুখকর নয়। দুঃখ ও দুর্দশা কখনো মধুর হয় না। ব না ও যাতনা কখনো স্বস্তির হয় না। তাই দুর্দিন ও দুঃসময় মানুষের পছন্দ নয়। কোনো মানুষ দুরবস্থার সম্মুখীন হতে ও দুঃখ-কষ্ট স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু তারপরও দুর্দশা ও দুরবস্থা মানুষের পিছু ছাড়ে না। তাই বিপদ, সঙ্কট ও সমস্যা আসার কারণ সম্পর্কে সম্যক অবগতি থাকা দরকার।
মন্দকর্ম : মানুষের জীবনে বিপদ-আপদ নেমে আসার প্রধান কারণ হলো, মন্দকর্ম, অন্যায় ও পাপাচার। অনাচার, দুরাচার ও দুষ্কর্মের যা কিছু মানুষ করে সেগুলোর সবই অপরাধ। আর পৃথিবীতে এমন কোনো অপরাধ নেই যার প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে হয় না। অবশ্য মহান আল্লাহ যদি কাউকে ক্ষমা করে দেন, তাহলে ভিন্ন কথা। অতএব, মানুষ যখন কোনো অন্যায় ও মন্দকর্ম করে তখন তার জন্য এর প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করা অবধারিত হয়ে যায়। তার ওপর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আজাব-গজব ও বালা-মুসিবত নেমে আসে। মানবজাতির ওপর নেমে আসা বিপদাপদ তাদেরই অসৎ কর্মের ফল। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের ওপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (সূরা শূরা : ৩০)
পরীক্ষা করা : বিপদাপদ নেমে আসার অন্য আরেকটি কারণ হলো পরীক্ষা করা। কেননা মানুষ অনেক কিছুই দাবি করে। কিন্তু তার দাবি সঠিক কি না তা পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা যায়। বহু ছাত্র মনোযোগের সাথে লেখাপড়া করার দাবি করে। কিন্তু তার লেখাপড়ার দাবি সত্য কি না তা পরীক্ষার মাধ্যমে পরিষ্কার হয়। ঠিক তেমনিভাবে মানুষও ঈমানদার হওয়ার দাবি করে। কিন্তু সে প্রকৃত অর্থেই ঈমানদার কি না তা পরীক্ষা করার জন্য মহান আল্লাহ বান্দাকে বিভিন্ন বালা-মুসিবতে নিপতিত করেন। বিপদ-আপদে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরও যদি কোনো ব্যক্তি ঈমান ও আমলের ওপর অটল ও অবিচল থাকে, তাহলে সে প্রকৃত অর্থেই ঈমানদার বলে গণ্য হয়। ঈমানদার হওয়ার দাবির ক্ষেত্রে তাকে সত্যবাদী বলে ধরা হয়। পরীক্ষা করার জন্য মানুষকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বালা-মুসিবতের সম্মুখীন করা হয়। আল কুরআনে এসেছে, ‘মানুষ কি মনে করে, তারা এ কথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা বিশ্বাস করি এবং তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদেরও পরীক্ষা করেছি যারা তাদের আগে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদেরকে।’ (সূরা আনকাবুত : ২-৩) ক্ষমা করা : যদি কোনো ব্যক্তি অন্যায়, অপরাধ বা গুনাহ করে, তাহলে তার জন্য শাস্তির মুখোমুখি হওয়া অপরিহার্য হয়ে যায়। অবশ্য গুনাহ করার পর খাঁটি অন্তরে তাওবাহ করলে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দেন। তবে যদি কেউ তাওবাহ না করে বা আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা না চায়, তাহলে ইহ কিংবা পরকালে তার শাস্তি অনিবার্য হয়ে যায়। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইহকালের শাস্তির তুলনায় পরকালের শাস্তি অত্যন্ত ভয়ানক। তাই আল্লাহ তায়ালা পরকালের ভয়াবহ শাস্তি থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য বান্দাদের ওপর বিভিন্ন বালা-মুসিবত আরোপ করে জাগতিক কষ্টের বিনিময়ে তাদের ক্ষমা করে দেন। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, মুসলিম ব্যক্তির ওপর যে কষ্ট-ক্লে¬শ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে ফোটে, এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেন।’ (সহিহ বুখারি : ৫৬৪১) রোগ-বালাই মানুষকে কষ্ট দেয়। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি যথেষ্ট কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হয়। অসুস্থ ব্যক্তির অসুস্থতার কষ্টের প্রতিদান হিসেবে মহান আল্লাহ তার গুনাহখাতা মাফ করে দেন। হজরত আয়েশা রা: বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, মু’মিন ব্যক্তি রোগাক্রান্ত হলে আল্লাহ তাকে গুনাহ থেকে এমনভাবে পরিচ্ছন্ন করেন, যেমন হাপর লোহাকে পরিচ্ছন্ন করে।’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৯৯) আল কুরআনে এসেছে, ‘পরকালের আজাব অধিকতর কঠিন ও স্থায়ী।’ আর রক্ত-মাংসের মানুষের জন্য পরকালের আজাব সহ্য করার ক্ষমতা আদৌ নেই। তাই অনেকসময় আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে দয়া ও করুণা হিসেবে বান্দার ওপর দুঃখ-দুর্দশা ও বালা-মুসিবত চাপিয়ে দেয়া হয়। এসব দুঃখ-দুর্দশার পরিবর্তে পরকালের শাস্তি থেকে তাকে মুক্তি ও পরিত্রাণ দেয়া হয়। অবশ্য কারো প্রতি রুষ্ট হলে আল্লাহ তায়ালা তার শাস্তি পরকালের জন্য রেখে দেন। হজরত আনাস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা যখন তার কোনো বান্দার কল্যাণ সাধন করতে চান তখন তাড়াতাড়ি দুনিয়াতে তাকে বিপদে নিক্ষেপ করেন। আর যখন তিনি তার কোনো বান্দার অকল্যাণ সাধন করতে চান তখন তাকে তার অপরাধের শাস্তি প্রদান থেকে বিরত থাকেন। তারপর কিয়ামতের দিন তিনি তাকে পুরাপুরি শাস্তি দেন।’ (সুনানে তিরমিজি : ২৩৯৬)
প্রতিদান দেয়া : বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না’। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ও জনমানুষের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কষ্ট ও সাধনা করতে হয়। গণমানুষের কল্যাণার্থে কষ্ট করলে তাদের ভালোবাসা ও আনুকূল্য পাওয়া যায়। ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত-বন্দেগিতে কিংবা তার পক্ষ থেকে আরোপিত বালা-মুসিবতে যে ব্যক্তি যত কষ্ট করে তাকে তত প্রতিদান দেয়া হয়। দুঃখ-দুর্দশার পরিমাণ অনুযায়ী প্রতিদান বাড়ে ও কমে। দুঃখ-কষ্ট বেশি হলে প্রতিদানও বেশি পাওয়া যায়। আর দুঃখ-কষ্ট কম হলে প্রতিদানও কম দেয়া হয়। হজরত আনাস বিন মালিক রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, বিপদ যত তীব্র হবে, প্রতিদানও তদনুরূপ বিরাট হবে। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো জাতিকে ভালোবাসলে তাদের পরীক্ষা করেন। যে কেউ তাতে সন্তুষ্ট থাকে তার জন্য রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর যে কেউ তাতে অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য রয়েছে অসন্তুষ্টি।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪০৩১)
আল্লাহর ভালোবাসা : মহান আল্লাহর ভালোবাসার কারণেও মানুষ অনেকসময় বিপদাপদের সম্মুখীন হয়। তাই কেউ বালা-মুসিবত বা রোগ-ব্যাধির শিকার হলেই তাকে গুনাহগার বা অপরাধী মনে করা ঠিক নয়। আপনি নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন, বন্ধু তার একান্ত বন্ধুর আন্তরিকতার পরীক্ষা করে। এই পরীক্ষা বন্ধুত্বের নৈকট্যের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। বন্ধু যত কাছের হয় পরীক্ষাও তত কঠিন হয়। এরপর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তার প্রতি আনুকূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়। ঠিক তেমনিভাবে বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহও তার বান্দাদের পরীক্ষা করেন। এরপর যে বান্দা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তিনি তার পাপরাশি মার্জনা করে দেন। হজরত সা’দ রা: বলেন, আমি প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! মানুষের মাঝে কার বিপদের পরীক্ষা সবচেয়ে কঠিন হয়? তিনি বললেন, নবীদের বিপদের পরীক্ষা, তারপর যারা নেককার তাদের পরীক্ষা। মানুষকে তার ধর্মানুরাগের অনুপাত অনুসারে পরীক্ষা করা হয়। তুলনামূলকভাবে যে লোক বেশি ধার্মিক তার পরীক্ষাও সে অনুপাতে কঠিন হয়ে থাকে। আর যদি কেউ তার দ্বীনের ক্ষেত্রে শিথিল হয়ে থাকে, তাহলে তাকে সে মুতাবিক পরীক্ষা করা হয়। অতএব, বান্দার ওপর বিপদাপদ লেগেই থাকে, অবশেষে তা তাকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দেয় যে, সে জমিনে চলাফেরা করে অথচ তার কোনো গুনাহই থাকে না।’ (সুনানে তিরমিজি : ২৩৯৮)
মর্যাদা প্রদান : অনেকসময় আল্লাহ তায়ালা কোনো বান্দার জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান প্রস্তুত করেন। কিন্তু বান্দা উদাসীনতা ও অন্য মনস্কতার কারণে ও অসৎকর্মের দরুন সেই মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত হতে পারে না। তখন আল্লাহ তায়ালা এই বান্দাকে সেই অবস্থানে আসীন হওয়ার যোগ্য করার লক্ষ্যে একের পর এক বালা-মুসিবতের সম্মুখীন করেন। এরপর বহুমাত্রিক কষ্ট সহ্য করার পর সেই ব্যক্তি নির্ধারিত আসন ও অবস্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্য হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে উল্লিখিত ব্যক্তিকে সেই মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, কোনো ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে এমন মর্যাদা বরাদ্দ থাকে যেখানে সে তার আমলের মাধ্যমে পৌঁছতে পারে না। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা ক্রমাগতভাবে এমন সব বিপদাপদের সম্মুখীন করেন যেগুলো সে অপছন্দ করে। ফলে একসময় সে সেই মর্যাদায় পৌঁছে যায়।’ (মুসতাদরাকে হাকিম : ১২৭৪)। লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com