জায়নবাদী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান থিওডর হার্জল ১৮৯৬ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের উপনিবেশের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই উপনিবেশ হবে বর্বরদের বিপরীতে সভ্য সমাজের একটা ঘাঁটি। জায়নিস্ট অর্গানাইজেশনের প্রধান হাইম ওয়াইজম্যান এসেছিলেন বেলারুশ থেকে। ১৯৩৬ সালে তিনি ফিলিস্তিনিদের ‘ধ্বংসবাদী শক্তি’, ‘মরু বাহিনী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, ইহুদি ঔপনিবেশিকেরা ছিল, ‘সভ্যতা’ ও ‘সৃষ্টি’কামী। ওয়াইজম্যান পরে ইসরাইলের প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। জায়নবাদীদের ফিলিস্তিন দখল প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘এটা মরু বাহিনীর বিরুদ্ধে সভ্য জাতির পুরোনো যুদ্ধ। আমাদের কেউ থামাতে পারবে না।’
সবশেষে গত অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনে চলমান ইসরাইলি বর্রতাকে ‘অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর যুদ্ধ, পশুত্বের বিরুদ্ধে মানবিকতার যুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ভালো কথা। কিন্তু এ সংঘাতে কারা পশুত্বের ধারক আর কারা মানবতার নিপীড়িত প্রতিনিধি? ব্যাপারটি খোলাসা করবে ফিলিস্তিনে ইসরাইল গঠনের ইতিহাস। একটু সেদিকে তাকানো যাক।
হযরত মুসা (আ.) ইহুদিদের মিসর থেকে সিনাই উপত্যকা হয়ে কেনান বা ফিলিস্তিনে নিয়ে আসেন খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ১৪০০ সালে। সেখানে বসবাস করতো ভূমিপুত্র কেনানিরা। সেখানে প্রবেশ করে ইহুদিরা বেশি দিন টিকতে পারেনি। দুই হাজার বছরের বেশি আগে ৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমানরা বহিরাগত ইহুদিদের ফিলিস্তিন থেকে একেবারে তাড়িয়ে দেয়। তারপর থেকে তারা ইউরোপের নানা অঞ্চলে বসবাস করতে থাকে।
১৮৮০ সালের দিকে ইহুদিরা বেশি ছিল রাশিয়া, জার্মানি ও পোল্যান্ডে। পুরো ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে তারা ছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সব রাষ্ট্রেই কমবেশি তারা নির্যাতিত হতো। তখন পৃথিবীতে সুপার পাওয়ার ছিল ব্রিটেন ও উসমানীয় সালতানাত। নির্যাতিত ইহুদিরা এই দুই রাষ্ট্রে পালিয়ে আসতে থাকে। ব্রিটেন শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে না চাইলে সবাই একযোগে তুর্কি অঞ্চলে আসতে থাকে। তুর্কি সালতানাত তখন বিশাল। ইহুদি শরণার্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে তুর্কি সালতানাতে প্রবেশ করে এবং যার যেখানে সুবিধা সেখানে বসবাস শুরু করে।
১৮৯৬ সালে ইহুদিদের এই দুরবস্থা নিয়ে তাদের মধ্যে থাকা প-িতেরা কাজ শুরু করেন। অনেকেই কাজ করেন, তবে এর মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন থিওডর হার্জেল। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত তার পুস্তিকা ‘ডের জুডেনস্টাটে’ তিনি একটি স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখেন এবং এর জন্য তিনি স্থান নির্ধারণ করেন জেরুসালেমকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনকে। তার এই পুস্তক ইহুদিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তবে কিছু ইহুদি এর বিরোধিতা করে। তাদের ধর্মীয় বিবেচনায় তাদের রাষ্ট্রগঠন তাদের ধ্বংসের কারণ হবে। এই গ্রুপ ছোট হলেও তারা এখনো বিদ্যমান। সব বাধা উপেক্ষা করে হার্জেল তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একনিষ্ঠ ছিলেন। ১৮৯৭ সালে সর্বপ্রথম বৈশ্বিক ইহুদি সমাবেশ হয় সুইজারল্যান্ডের বাসেলে এবং তার ধারণা সবার মাঝে ছড়াতে থাকে ব্যাপকভাবে। তার এই রাষ্ট্রের পরিকল্পনা জায়নবাদ নামে পরিচিত হয়।
হিব্রু ভাষায় জায়ন হচ্ছে জেরুসালেমের এক পাহাড়ের নাম, যা জেরুসালেম শহরের প্রতিনিধিত্ব করে। শুরুতে শুধু ইহুদিরাই জায়নবাদী থাকলেও এখন যারা ইহুদি রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান করে তারা সবাই জায়নবাদী হিসেবে পরিচিত। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে চাইলে যারা মনে করে (সে যে ধর্মেরই হোক না কেন) জেরুজালেম ইহুদিদের অধিকারে থাকবে তারাই জায়নবাদী। এই জায়নবাদীদের একটি কুমিরের সাথে তুলনা করেন সাবেক তুর্কি প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকান। তিনি বলেন, জায়নবাদ হলো একটি কুমিরের মতো। এর উপরের চোয়াল হলো আমেরিকা আর নিচের চোয়াল হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর জিহ্বা আর দাঁত হলো ইসরাইল। এর শরীর ও অন্যান্য অঙ্গসমূহ হলো মুসলিমদেশসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী, মিডিয়া, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং এর সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সংগঠন। থিওডর হার্জেল ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য কলোনি বা উপনিবেশ গঠনের প্রস্তাব নিয়ে তুর্কি সুলতান আব্দুল হামিদ সানির সাথে দেখা করেন। বিনিময়ে উসমানীয় সালতানাতের একটি বড় ঋণ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন। আব্দুল হামিদ তাতে রাজি হননি এবং তাদের দেশ দখলের পরিকল্পনা বুঝতে পেরে জেরুজালেম ও তার আশে পাশে জমি বিক্রয় নিষিদ্ধ করে দেন।
১৯০২ সালের মাঝে ৩৫,০০০ ইহুদি চলে আসে ফিলিস্তিনে, যেটা এখন ইসরাইল নামে পরিচিত। তখন সেটা অবশ্য মুসলিম অধিকারে ছিল। এটাকে বলা হয় প্রথম আলিয়া, আলিয়া হলো ইহুদি পুনর্বাসন, যখন অনেক ইহুদি একসাথে সরে আসে। তখন মুসলিম প্রধান ফিলিস্তিনে দেখা গেল, জেরুজালেমের সিংহভাগই দখল করে নিচ্ছে বহিরাগত ইহুদিরা। ১৯০৪ সালে হার্জেলের মৃত্যুর পর জায়নবাদকে নেতৃত্ব দেন ইহুদি ধনকুবের ও ব্যাংক ব্যবস্থার প্রবর্তক ব্যারন রথচাইল্ড। এই পরিবার দুনিয়া জুড়ে ব্যাপক প্রভাব তৈরি করে। বিশেষত ব্রিটেন, জার্মানিসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে এবং আমেরিকায় তাদের প্রতিপত্তি নীতিনির্ধারক শক্তিতে পরিণত হয়।
এদিকে উসমানীয় সালতানাত ভাঙতে মরিয়া ছিল ব্রিটেন। মুসলিমদের ঐক্য নষ্ট করে তারা। সালতানাতের বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত করে। তাদের বুঝানো হয় অনারব তুর্কি ছোট জাত। তাদের অধিকার নেই আরব মুসলিমদের নেতৃত্ব দেওয়ার। আরবদের কাছেই নবী এসেছে তাই আরবরাই মহান। নেতৃত্বের হকদার তারা। আরব নেতাদের মুসলিম বিশ্বের শাসক বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্রিটেন। উসমানীয় ভূমি দখলের পর ভাগ বাটোয়ারা করার জন্য ফ্রান্স ও রাশিয়ার সাথে রিভাল চুক্তি করে ব্রিটেন। ইহুদিদের সাথেও চুক্তি করে জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে তাদের একটি রাষ্ট্র তৈরিতে সাহায্য করবে বলে। এই বিষয়ে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর জায়নবাদী নেতা রথচাইল্ডকে একটি পত্র দেন, যা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত।
মোটকথা ব্রিটেন আরব নিয়ে একইসাথে তিন পক্ষের সাথে তিনটি চুক্তি করে: (ক) বৃটেন আরবদেরকে আশ্বাস দিল, উসমানীয়দের পরাজিত করতে সাহায্য করলে তারা কুরাইশ বংশের শরীফ হুসেইনের মাধ্যমে আরব রাজ্যের কর্তৃত্ব পাবে। (খ) ফ্রান্স এবং বৃটেন চুক্তি করলো, ঠিক ঐ এলাকাগুলোই বৃটেন এবং ফ্রান্স ভাগ করে নেবে। সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান পাবে ফ্রান্স অন্যদিকে হেজাজ, ফিলিস্তিন, জেরুসালেমসহ বাকী আরব ব্রিটেন পাবে। (গ) জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ইহুদিদের একটি রাষ্ট্রগঠনের সুযোগ দেওয়া হবে।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফিলিস্তিনের আরব জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা ব্রিটেনকে সাপোর্ট করে। তাদের সহায়তায় ব্রিটেন ও ফ্রান্স সহজে মধ্যপ্রাচ্য দখল করে। উসমানীয় সৈন্যরা পরাজিত হয়ে চলে যায়। অন্যদিকে ইহুদিরা চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেনকে প্রযুক্তিগত, আর্থিক ও গোয়েন্দা সুবিধা দেয়। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, উসমানীয় সরকারে অনেক ইহুদি গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিল। এর ফলে রাষ্ট্রীয় তথ্য ব্রিটেনের কাছে চলে যেত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে উসমানীয় সেনাদের পরাজয়ে জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা ও ইহুদিরা ভালো ভূমিকা রাখে। তাই এই ফ্রন্টে সহজেই ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনারা জয়লাভ করে। ১৯১৪ সালের মাঝে দ্বিতীয় আলিয়া হয়ে যায়, এ সময় ৪০,০০০ ইহুদি এ এলাকায় চলে আসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিরা সমর্থন দেয় জার্মানিকে, কারণ তারা শত্রু রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছিল। খুবই আইরনিক, না? পরের বিশ্বযুদ্ধেই দেখা গেলো এই জার্মানি ইহুদিদের একদম নিশ্চিহ্ন করতে নেমে পড়েছে!
১৯১৭ সালে থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইহুদিদের কাছে ব্রিটেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ফিলিস্তিনের জমিতে তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ করে দেবে। সেজন্য ইহুদিরা কাজ করতে থাকে। সারাবিশ্ব থেকে চাঁদা তুলে ইহুদিরা ফিলিস্তিনের গরিব মুসলিমদের থেকে জমি ক্রয় করা শুরু করে। কিছু ক্ষেত্রে জোর করেও দখল নিতে থাকে। সারা পৃথিবীকে উদ্বাস্তু ইহুদিদের ফিলিস্তিনে আনা হয় ও তাদের পুনর্বাসন করা হয়। ফিলিস্তিনি জনগণের হৃদয়ে বিপ্লবী চেতনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন আমীন আল হুসাইনী। ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে তিনি তার একদল বন্ধুর সহায়তায় বায়ারিক বিপ্লবের মাধ্যমে ইহুদি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বিদ্রোহের সূচনা করেন। ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানের দিনে পতাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ফিলিস্তিনি জনগণ। সুযোগ কাজে লাগান আমীন আল হুসাইনী। সবার সামনে বক্তৃতা দিয়ে গরম করে তোলেন রক্ত, জাগিয়ে তোলেন নিজেদের অধিকার রক্ষার প্রতিজ্ঞা। মুসলিম-ইহুদি সংঘর্ষে মারা পড়ে পাঁচ ইহুদি এবং চার ফিলিস্তিনি। পাশাপাশি কয়েকজন ব্রিটিশ সেনা ছাড়াও উভয় পক্ষের দশের অধিক লোক আহত হয়। ১৯২৩ সালের মাঝে তৃতীয় আলিয়া হয়, আরো ৪০,০০০ ইহুদি আসে ফিলিস্তিনে। ১৯২৮ সালে JNC (Jewish National Council) গঠিত হয় ফিলিস্তিনে। ইহুদিরা বুরাক প্রাচীরে নিয়মিত যাতায়াত তো করতোই, এবার তল্পিতল্পা নিয়ে চলে এলো। ১৯২৮ সালে বুরাক প্রাচীর তাদের ধর্মের জন্য বিশেষ বলে দাবি করে বসলো। ক্ষোভে ফুঁসে উঠলো ফিলিস্তিনি জনতা। তাদের প্রাচীরের কাছে আসার অনুমতি দেয়া মানে তো, তাদের হয়ে যাওয়া নয়! কুদস শহরের মুফতি আমিন হুসাইনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে লিখে পাঠালেন, ইহুদিরা যেন তাদের এই অহেতুক এবং লোভাতুর দাবি থেকে ফিরে আসে। শুধু এতটুকুই নয়, তিনি বিশাল এক ইসলামি সম্মেলনের আয়োজন করলেন। সম্মেলনে তুলে ধরলেন বিভিন্ন দফা। তার মধ্যে একটি দফা হলো, ‘ইহুদিরা যে এতদিন বুরাক প্রাচীরের কাছে আসতে পেরেছে, এটা মুসলমানদের অনুগ্রহ। এই জায়গাটি সম্পূর্ণ ইসলামিক দান।’ ব্রিটিশরা প্রলোভন দেখিয়ে, ৫০ মিলিয়ন টাকা ঘুষ দিয়ে আমিন হুসাইনিকে দমাতে চাইলো, পারলো না। তিনি ফিরিয়ে দিলেন তাদের লালসার হাতছানি। ইহুদি যড়যন্ত্র ও ব্রিটিশদের অসাধু পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যক্ত করলেন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়।
ইহুদিদের বুরাক প্রাচীর দখলের বারংবার প্রচেষ্টা ১৯২৯ সালে সংঘর্ষের জন্ম দেয়। এই সংঘর্ষে ১০ জন মারা যায় এবং উভয় পক্ষ থেকে আহত হয় আরও কয়েকজন। এখানে ইহুদিদের সহায়তায় আবার নাক গলায় ব্রিটিশরা। দশজন ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে তিনজনকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। ইহুদি এবং জায়নিস্টদের আগ্রাসন এখানেই থেমে থাকে না, এগিয়ে যায়। আর ১৯২৯ সালের মাঝে চতুর্থ আলিয়া হয়। আরও ৮২,০০০ ইহুদি চলে আসে। খরচপাতিতে সাহায্য করত জ্যুইশ ন্যাশনাল ফান্ড, বিদেশি জায়োনিস্টরা এতে সাহায্য করত। সিরিয়া থেকে আসা উসমানীয় সেনা কমান্ডার ইজেদ্দিন আল কাসসাম ব্রিটেন ও ইহুদিদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ও পরে সশস্ত্র আন্দোলন করেন।
সাধারণ ফিলিস্তিনি নেতারা জানবাদী বসতিস্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু আল-কাসসাম উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াইকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। অধিকাংশ ফিলিস্তিনি নেতা ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের সমর্থক হলেও আল-কাসসাম ফিলিস্তিনের সংঘাতকে ধর্মীয় সংগ্রাম হিসেবে দেখতেন। ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসন এবং জায়নবাদীদের আধিপত্য উৎখাতের জন্য আল-কাসসাম নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক জিহাদের পক্ষে ছিলেন। তিনি মুসলিমদের জমি বিক্রয়ের ব্যাপারেও সতর্ক করেন।
যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের সময় আল-কাসসাম উন্নত চরিত্রের উপর জোর দিতেন। তাদেরকে অসহায়, অসুস্থদের সেবা, পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা এবং নিয়মিত নামাজ পড়তে বলা হতো। শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সাহসী যোদ্ধা হতে এসকল গুণের প্রয়োজন বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। পরিবার থেকে দূরে থাকা এবং ইসলামে অনৈতিক বলে বিবেচিত কাজে জড়িত থাকা হাইফার শ্রমিক বস্তির বাসিন্দাদের জন্য তিনি নৈতিক শিক্ষা প্রদানে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি বিয়েকে তরুণদের নৈতিক অধঃপতন বন্ধের উপায় হিসেবে দেখতেন। অনেক সহায়হীন সমর্থকদের বিয়েতে তিনি খরচ জুগিয়েছেন। জিহাদের প্রতি আত্মোৎসর্গের প্রতীক হিসেবে তিনি পুরুষদের দাড়ি রাখা ও সবসময় সঙ্গে কুরআন রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। তার অনেক অনুসারী নিরক্ষর হওয়ায় তিনি কুরআনের সাহায্যে তাদের পড়তে ও লিখতে শিখিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি তার যোদ্ধাদের কাদেরিয়া তরিকার বিভিন্ন চর্চা অনুশীলনের উপদেশ দিতেন।
ফিলিস্তিনে ১৯৩১ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা তাদের ব্যাপক আবাসনের অনুমতি দেয়। লেবানন, সিরিয়ার মতো বাইরের দেশে বাস করা ফিলিস্তিনি ভূ-মালিকদের থেকে ভূমি কেনার মাধ্যমে জায়নিস্টদের এই আগ্রাসন গতি পায়। এই গতি রুখতে উঠে দাঁড়ান আমীন আল হুসাইনী। তিনি ভূ-মালিকদের তাদের জমিগুলো ইসলামিক কাউন্সিলের কাছে বিক্রি করতে রাজি করান এবং ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে দান করার জন্য উৎসাহিত করেন, যেন ইহুদিরা জমিগুলো কিনতে না পারে।
তিনি এই ফতোয়াও জারি করেন: ফিলিস্তিনের জমি যারা ইহুদিদের কাছে বিক্রি করবে, তারা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে। তাদের জানাযার নামাজ পড়া হবে না, মুসলমানদের কবরে দাফন করা হবে না।
এই সময় আমীন আল হুসাইনী ইহুদিদের জমি ক্রয়ের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করার জন্য সম্মেলনের আয়োজন করেন। কুদস শহরের আশপাশের মেয়রদের বলেন, ‘ইহুদিদের কাছে অল্প কিংবা বেশি জমি বিক্রি করা, অথবা বিক্রির দালালি করা কিংবা কথায়, কাজে মধ্যস্থতা করা মানে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে খেয়ানত করা। শুধু বিক্রি নয়, বরং প্রতিবাদ না করে চুপ থাকা কিংবা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করাও খেয়ানত। বিষয়টা যেন মাথায় থাকে।’
১৯৩৩ সালের পর থেকে জার্মানির শাসক হিটলার ইহুদিদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করেন। ইতোমধ্যে জাহাজে করে সারা বিশ্ব থেকে ৫০ হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে আসতে থাকে। তখন ফিলিস্তিনি আরবরা বুঝতে পারে যে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে।
ইহুদিবাদীদের তিনটি সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল: হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং। যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে। আল কাসসাম তাদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
১৯৩৫ সালে এক খণ্ডযুদ্ধে আল কাসসামকে খুন করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। আল কাসসামের শাহদাতের মধ্য দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের টনক নড়ে। ১৯৩৫ সালে ইযযুদ্দিন কাসসামের শাহাদাত, ইহুদিদের আধিপত্য এবং কৃষকদের তাদের জমি ও ভূমি থেকে উচ্ছেদের পর, আমীন আল হুসাইনী সশস্ত্র সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ, এটা ছাড়া এখন আর কোনো গতি নাই। ১৯৩৬ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে, যখন শেখ ফারহান সাদীর নেতৃত্বে শেখ কাসসামের বন্ধু ও সহকর্মীরা তুলকর্ম ও জেরুজালেমের রাস্তায় ইহুদিদের গাড়িতে হামলা করে, কার্যত তখনই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। এই হামলায় দু’জন ইহুদি মারা যায়। এরপর কয়েকবার ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের মাঝে সংঘর্ষ হয়। ফিলিস্তিনি জনগণ শহরজুড়ে হারতাল ও অবরোধ পালন করে।
ইহুদিদের সহায়তায় মাঠে তখন তৎপর ব্রিটিশ বাহিনী। তারা একপ্রকার ইহুদিদের ঢাল হয়েই দাঁড়াত সবসময়। আমীন আল হুসাইনী স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘তারা যখন আমাকে ভয় ও প্রলোভন দেখিয়ে ব্যর্থ হলো, তখন আমাকে হত্যার হুমকি দিলো। আমাকে পাঠানো তাদের শেষ চিঠিতে তারা লিখেছিলো, ‘ইংরেজরা তাদের স্বার্থ ও সাম্রাজ্যের স্বার্থে সবকিছু করতে পারে। এমনকি নির্মমভাবে হত্যাও করতে পারে। তাই তেমাকে পরামর্শ দিচ্ছি, পরিবার পরিজন নিয়ে শান্তিতে বসবাস করো।’ ১৯৩৮ সালের মাঝে পঞ্চম আলিয়া হয়ে গেল। প্রায় আড়াই লাখ ইহুদি এলো ফিলিস্তিনে।
বরাবরের মতো ব্রিটেন আরব এবং ইহুদি- দু’ পক্ষকেই হাতে রাখতে চেয়েছে। ১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি ব্রিটেনের সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়েছিল পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য পঁচাত্তর হাজার ইহুদি অভিবাসী আসবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে। অর্থাৎ সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছিল। ব্রিটেনের এ ধরনের পরিকল্পনাকে ভালোভাবে নেয়নি ইহুদিরা। তারা একই সাথে ব্রিটেন এবং আরবদের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা করে। ১৯৪০ সালে ৩২ হাজার ইহুদি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যুক্ত ছিল। সেই ইহুদি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে ব্রিটেন এবং আরবদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটেন ইহুদিদের সব দাবি মেনে নিয়ে আপাতত বিদ্রোহ থামায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের বাহিনীর দ্বারা বহু ইহুদি হত্যাকাণ্ডের পর নতুন আরেক বাস্তবতা তৈরি হয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর যেসব ইহুদি বেঁচে ছিল তাদের জন্য জন্য কী করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তখন ফিলিস্তিনি ভূখ-ে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা আরো জোরালো হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন পৃথিবীতে তার একক কর্তৃত্ব হারায়। নতুন পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকার উত্থান হয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইসরাইল রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরেন। ট্রুম্যান চেয়েছিলেন হিটলারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া এক লক্ষ ইহুদিকে অতি দ্রুত ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে জায়গা দেয়া হোক। কিন্তু ব্রিটেন বুঝতে পারছিল যে, এতো বিপুল সংখ্যক ইহুদি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নিয়ে গেলে সেখানে গৃহযুদ্ধ হবে। ব্রিটেনের গড়িমসি দেখে ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ সৈন্যদের উপর ফিলিস্তিনের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালানো শুরু করে। তখন ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনের উদ্দেশ্যে জাহাজে বোঝাই হয়ে আসা হাজার-হাজার ইহুদিকে বাধা দেয় ব্রিটিশ বাহিনী। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। ইহুদি সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ বাহিনীর উপর তাদের আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ১৯৪৬ সালের জুলাইতে সন্ত্রাসী দল ইর্গুন কিং ডেভিড হোটেলে বিস্ফোরণ ঘটায়। সেখানে ফিলিস্তিনের British administrative headquarters ছিল। সে হামলায় মারা যায় ৯১ জন মানুষ, আর আহত হয় ৪৬ জন। ইর্গুন সন্ত্রাসীরা আরবদেশি ওয়ার্কার আর ওয়েইটার সেজে বোমা পেতে আসে। বিস্ফোরণে পুরো দক্ষিণ পাশ ভেঙে পড়ে। তখন তেল-আবিব (যেটা বর্তমানে ইসরাইলের রাজধানী) শহরে কারফিউ জারি করা হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করা, যাতে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য ব্রিটেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। তখন সমাধানের জন্য ব্রিটেনের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এরপর ব্রিটেন বিষয়টিকে জাতিসংঘে নিয়ে যায়। (অসমাপ্ত) লেখক: গবেষক ও ইসলামি চিন্তাবিদ।