ব্যাপক উদ্দীপনার পাশাপাশি তীব্র বিতর্কের মধ্যেই ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের অযোধ্যায় নির্মাণাধীন মন্দিরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান দেবতা রামচন্দ্রের ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সোমবার বিশাল আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠানে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিজেপি ও সমমনা দলগুলোর নেতাকর্মী অংশ নিয়েছেন; ছিলেন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বলিউড তারকারাও। গেরুয়া রঙে ছেয়ে ছিল মন্দিরের চারপাশ। সেখানে বসে উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন আমন্ত্রিতরা। তবে অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি বিরোধী রাজনীতিকদের। তাদের দাবি, সময় ও সুযোগ বুঝে তারা রামমন্দিরে যাবেন; অন্যের (নরেন্দ্র মোদি) নির্ধারিত সময়ে নয়। তাদের অভিযোগ, নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে মোদি তড়িঘড়ি করে অসম্পূর্ণ মন্দির উদ্বোধন করেছেন। ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রায় থাকা কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে এটা বিজেপি-আরএসএসের আয়োজন। তবে সবাইকে বিস্মিত করে অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন ভারতের চার শঙ্করাচার্য। ভারতের প্রধান চার হিন্দু মঠ– দুয়ারকা (গুজরাট), জোশিমঠ (উত্তরাখ-), পুরি (উড়িষ্যা) ও স্রিঙ্গারি (কর্ণাটক) প্রধানরা উপস্থিত হননি। এগুলো অষ্টাদশ শতকে আদি শঙ্করের স্থাপন করা ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মন্দিরের কাজ শেষ না করেই ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করা হয়েছে, যা শাস্ত্রবিরোধী। আমন্ত্রিতদের মধ্যে দেশ-বিদেশের অতিথিদের পাশাপাশি অমিতাভ বচ্চন, রণবীর কাপুর, আলিয়া ভাট, অক্ষয় কুমারের মতো তারকাকে দেখা গেছে।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মোদির পাশেই ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, রাজ্যটির রাজ্যপাল আনন্দীবেন প্যাটেল, রামমন্দিরের প্রধান পুরোহিত আচার্য সত্যেন্দ্র দাস প্রমুখ। ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ নামের এ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন আগে থেকেই অযোধ্যায় নানা আয়োজন শুরু হয়। রোববার থেকে অতিথিরা প্রাচীন নগরীটিতে আসতে শুরু করেন। সোমবার উদ্বোধনের দিন সকাল থেকেই শুরু হয় সাজসাজ রব। রামমন্দির সাজানো হয়েছে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা আড়াই হাজার কুইন্টাল ফুল দিয়ে। কড়া সুরক্ষা বলয়ে ঢাকা ছিল অযোধ্যা। কড়া নজর রেখেছেন পুলিশ ও কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা, গতিবিধির ওপর নজর রাখতে মোতায়েন করা হয় স্নাইপারও। উড়তে দেখা গেছে অত্যাধুনিক নজরদারি ড্রোন। নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয় পুরো এলাকাকে। এ মন্দির নির্মাণে আনুমানিক ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর প্রাঙ্গণ ৭০ একরজুড়ে বিস্তৃত, মূল মন্দির রয়েছে ৭ দশমিক ২ একর জায়গায়।
মনোরম তিন তলা মন্দির গড়া হয়েছে গোলাপি বেলেপাথর দিয়ে; নিচের দিকে রয়েছে কালো গ্রানাইট পাথর। প্রায় ৭০ হাজার বর্গফুটজুড়ে ধবধবে সাদা মার্বেল পাথর পাতা হয়েছে। মার্বেল পাথরের বেদিতে বসানো হবে ৫১ ইঞ্চি উঁচু রামের মূর্তি। দুপুর ১২টা ২৯ মিনিট ৮ সেকেন্ড থেকে ১২টা ৩০ মিনিট ৩২ সেকেন্ডের মধ্যে গুনে গুনে ঠিক ৮৪ সেকেন্ড। এ সময়ের মধ্যেই বিগ্রহের ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করেন নরেন্দ্র মোদি। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী একে বলা হয় ‘অভিজিৎ মুহূর্ত’। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী, ভগবান রাম ওই মুহূর্তে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সারাদিনে দু’বার ‘অভিজিৎ মুহূর্ত’ আসে। শ্রীকৃষ্ণেরও জন্ম হয়েছিল মধ্যরাতের ‘অভিজিৎ মুহূর্তে’। রামমন্দির উদ্বোধনের পর রামলালার ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠার’ জন্য এ ৮৪ সেকেন্ড নির্ধারিত করা হয়েছিল। সেই নির্ঘণ্ট মেনে দুপুর ১২টা ৫ মিনিট থেকে চূড়ান্ত অনুষ্ঠান শুরু হয়। পুরো অনুষ্ঠান বিভিন্ন টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করেছে। উদ্বোধনের পর নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘বহু শতাব্দী অপেক্ষার পরে ভগবান রাম আবার আমাদের মাঝে এসেছেন। রামলালা আর অস্থায়ী গৃহে নয়, এবার দিব্য মন্দিরে থাকবেন।’ তিনি ভারতবাসীকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, ২২ জানুয়ারি এখন শুধু ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ নয়, এটি নতুন যুগের সূচনা।
বিবিসি লিখেছে, মন্দিরটি যেখানে তৈরি হয়েছে, সেটা ভারতের সব থেকে বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানগুলোর অন্যতম। ওই স্থানেই এক সময় ছিল ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি বাবরি মসজিদ। রামমন্দির ধ্বংস করে ওই মসজিদ গড়া হয়েছিল– এ দাবি তুলে হিন্দুত্ববাদীরা ১৯৯২ সালে মসজিদটি ভেঙে দেয়। তার পর ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রায় দুই হাজার মানুষ নিহত হয়। ২০১৯ সালে অযোধ্যা মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের বিতর্কিত জায়গাটি একটি ট্রাস্টকে দেওয়া যেতে পারে এবং সেখানে একটি রামমন্দির তৈরি করা যেতে পারে। একইভাবে, উত্তরপ্রদেশের সুন্নি ওয়াক্ফ বোর্ডকে বলা হয় যে, তাদের পাঁচ একর জমি দেওয়া হবে, যেখানে তারা একটি মসজিদ তৈরি করতে পারবে। রামমন্দিরের নির্মাণকাজ ২০২০ সালে শুরু হয়। তবে মসজিদের কাজ এখনও শুরু হয়নি।
তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন ‘সংহতি মিছিল’ করেন। মমতা বলেন, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। আমি সর্বধর্ম সমন্বয়ের মিছিল করছি।’ রোববার নিজের এক্স হ্যান্ডলে এক বার্তায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন, ‘মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার যাই হোক– ঘৃণা, হিংসা ও নিরীহ মানুষের মৃতদেহের ওপর তৈরি কোনো উপাসনাস্থল মেনে নিতে আমার ধর্ম আমায় শেখায়নি।’
রামমন্দির উদ্বোধন উপলক্ষে সোমবার কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা স্কুল, কলেজ ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্ধদিনের ছুটির ঘোষণা করা হয়। অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার নিয়েও বিতর্ক হয়। তামিলনাড়ুর ডিএমকে সরকার রামমন্দিরের অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচারে সম্মতি দেয়নি।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত এই সময়ের অন লাইন সংস্করণে বলা হযেছে, অযোধ্যায় রাম মন্দিরে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা জাঁকজমক পূর্ণ ভাবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উদ্বোধন করেছেন রাম মন্দিরের কালো কষ্টি পাথরের রামলালার মূর্তি বসেছে রাম মন্দিরের গর্ভগৃহে। এতদিন রামলালা পূজিত হয়েছেন অস্থায়ী তাঁবু মন্দিরে। নয়া রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার পর পুরনো সেই বিগ্রহের কী হবে? কী ভাবে-কোথা থেকে কবে ‘আবিষ্কৃত’ হয়েছিল সেই বিগ্রহ?
২২ জানুয়ারি সোমবার উদ্বোধন হয়েছে রাম মন্দিরের। রাজসূয় যজ্ঞে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। শুধু অযোধ্যাই নয়, রাম মন্দির উদ্বোধনে মাতে বিশ্বের লাখ লাখ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন। রাম মন্দির নির্মাণে নেপথ্য়ে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। ৩২ বছর আগে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ধ্বংস হয়েছিল বাবরি মসজিদ কিন্তু বাবরি মসজিদ নিয়ে বিতর্ক, গন্ডগোল যা-ই বলা হোক না কেন সব কিন্তু নয়ের দশকে শুরু হয়নি। বহু বছর আগে বিতর্কের সূত্রপাত।
নেপথ্য ইতিহাস? তখন ভারত সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার ঠিক বছর দুয়েকের মাথায় বাবরি মসজিদের অন্দরে হঠাৎ একদিন সকালে রহস্যময়ভাবে ‘রামলালা’ (শিশু রামচন্দ্র) মূর্তি পাওয়া যায়। দিনটা ছিল ২২ ডিসেম্বর, ১৯৪৯ মধ্যরাতের পর। স্থানীয় মুসলিমরা অবশ্য অভিযোগ করেন রাতের অন্ধকারে গোপনে ওই মূর্তিটি রেখে যাওয়া হয়েছে মসজিদের ভেতরে। কিন্তু ততক্ষণে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে রামলালার আবির্ভাবে-এর খবর। দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ ওই মসজিদে এসে শ্রীরামের ভজন-পূজন শুরু করে দিয়েছেন তখন। এদিকে শান্তি বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কায় সেখানে নমাজ বন্ধ রাখতে হয় কর্তৃপক্ষকে। তবে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কায় মসজিদের ভেতর থেকে সরানো যায়নি রামলালার বিগ্রহ। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৪৫ ধারা অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ গোটা কাঠামোটি বিতর্কিত স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করে প্রবেশপথে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
সেই ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৯২ সালে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা পর্যন্ত বাবরি মসজিদে আর কখনও অনুমতি দেওয়া হয়নি নমাজ পড়ার। এই ঘটনা নিয়েই কয়েক দশক ধরে চলেছে আইনি লড়াই। তৎকালীন অযোধ্যা প্রশাসন বলেছিলে মসজিদের ভিতর মূর্তি ফেলে এসেছিলেন হনুমানগড়ী মন্দিরের মোহান্ত অভিরাম দাস। পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেও সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর, ৭ ডিসেম্বর একটি জায়গায় তাঁবুর মতো একটি অস্থায়ী রাম মন্দির তৈরি করেছিলেন কর সেবকরা। পুলিশ ঘটনাস্থলে আগেই ব্যানার তৈরির কাপড় দিয়ে তাড়াহুড়ো করে ওই মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল। করসেবকরা মনে করেন সেই অস্থায়ী মন্দির তৈরি না হলে আজকের এই বিশাল মন্দির তৈরি হত না।
পুরনো বিগ্রহ কোথায় রাখা হবে?
সেই থেকে অস্থায়ী তাঁবু মন্দিরেই অধিষ্ঠিত রয়েছেন রামলালার মূর্তিটি। এখন প্রশ্ন বড় মন্দির নির্মাণের পর ওই বিগ্রহের কী হবে? রাম মন্দিরের কর্তাব্য়ক্তি ও পুরোহিতরা জানিয়েছেন, রামলালার ওই পুরনো মূর্তিটিকে স্থাপন করা হবে নতুন মন্দিরের একটি সিংহাসনে। নতুন রামলালার বিগ্রহের বিপরীতের একটি সিংহাসনে উপবিষ্ঠ হবে পুরনো বিগ্রহ। তার আগে কিছু আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে। মন্দির নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান নৃপেন্দ্র মিশ্র বলেন, ‘যে প্রভু অস্থায়ী তাঁবুতে রয়েছেন তিনিও নতুন মন্দির চলে আসবেন। কিছু আচার অনুষ্ঠানের পর পুরনো বিগ্রহকে অস্থায়ী তাঁবু থেকে নিয়ে যাওয়া হবে নতুন মন্দিরে। অস্থায়ী মন্দিরে রামলালার যে বিগ্রহটি রয়েছে সেটিও স্থাপন করা হবে গর্ভগৃহে। নব নির্মিত রাম মন্দিরের গর্ভগৃহে একই সঙ্গে অধিষ্ঠান করবে রামলালার নতুন দাঁড়ানো মূর্তিটি ও ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদের অন্দরে পাওয়া মূর্তিটি।’ সূত্র: বিবিসি,সমকাল, এই সময়