ব্যক্তিগত ধারের মতো ব্যাংকের টাকাও ঋণ। সে ঋণ নিয়ে জনগণের টাকা যারা পরিশোধ না করে আত্মসাৎ করেন তাদের বিষয়ে আল্লাহর ফয়সালা বড় কঠিন। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ রা: বলেন, আমরা মসজিদ-ই-নববীর সামনে যেখানে জানাজা রাখা হতো, সেখানে বসা ছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ সা:-ও আমাদের মাঝে বসা ছিলেন। আমরা দেখলাম, তিনি আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকালেন, তারপর দৃষ্টি অবনমিত করে কপালে হাত রেখে বলেন, সুবহানাল্লাহ! কী কঠিন বিষয় অবতীর্ণ হলো! বর্ণনাকারী বলেন, আমরা এক দিন ও এক রাত চুপ থাকলাম। এ সময়ের মধ্যে ভালো ছাড়া মন্দ কিছুই দেখলাম না।
হাদিস বর্ণনাকারী মুহাম্মদ বলেন, (দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর) আমি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, কী কঠিন বিষয় অবতীর্ণ হয়েছে? রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘ঋণ সম্পর্কীয় কঠিন বিধান। সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর পথে শহীদ হয়, তারপর পুনর্জীবিত হয়ে আবার আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়, তারপর পুনর্জীবিত হয়ে আবার আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয় তথা তিনবার শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করে, আর তার অনাদায়ী ঋণ থেকে যায়, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ তার ঋণ পরিশোধ না করা হয়।’ (আবু দাউদ, মিশকাত পৃষ্ঠা-১৬৩)
সালামা ইবনু আকওয়া রা: থেকে বর্ণিত- একদিন নবী সা:-এর কাছে সালাতে জানাজা আদায়ের জন্য একটি জানাজা উপস্থিত করা হলো। তখন নবী সা: জিজ্ঞেস করলেন, তার কি কোনো ঋণ আছে? সাহাবিরা বললেন, না। তখন তিনি তার জানাজার সালাত আদায় করলেন। তারপর আরেকটি জানাজা উপস্থিত করা হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তার কি কোনো ঋণ আছে? সাহাবিরা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তোমাদের সাথীর সালাতে জানাজা তোমরাই আদায় করে নাও। আবু কাতাদাহ রা: বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তার ঋণের দায়-দায়িত্ব আমার উপর। তখন তিনি তার জানাজার সালাত আদায় করলেন। (বুখারি-২২৯৫, আধুনিক প্রকাশনী-২১৩১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-২১৪৮)
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোনো বিষয়ে জুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়, সেদিন আসার আগে যেদিন তার কোনো দিনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার জুুলুমের বিনিময় তা থেকে নেয়া হবে আর তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ থেকে সমপরিমাণ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে।’ (বুখারি-২৪৪৯)
এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘মৃতের অসিয়ত পূরণ করার পর এবং তার ঋণ পরিশোধের পর (তার সম্পত্তি বণ্টিত হবে)।’ (সূরা নিসা-১১)
ইবনে উমার রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি তার জিম্মায় এক দিনার বা এক দিরহাম পরিমাণ ঋণ রেখে মারা গেলে (কিয়ামতের দিন) তার নেক আমলের দিয়ে তা পরিশোধ করা হবে। আর সেখানে কোনো দিনারও থাকবে না, দিরহামও থাকবে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-২৪১৪, আহমাদ-৫৫১৯, বায়হাকি ফিস সুনান-৬/২১, আহকামুল জানায়িজ-৫ নং পৃষ্ঠা)
আমর ইবনে শারিদ রহ. তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ধনবান লোক যদি কর্জ আদায় করতে তালবাহানা করে, তবে তার মানহানি ঘটানো এবং তাকে শাস্তি দেয়া বৈধ হয়ে যায়।’ (নাসায়ি-৪৬৯০, ইবনে মাজাহ-২৪২৭, মিশকাত-২৯১৯)
আমর ইবনে শারিদ রহ. থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সচ্ছল ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ না করলে তার মান-সম্মানের উপর হস্তক্ষেপ করা যায় এবং তাকে শাস্তি দেয়া যায়। ইবনে মুবারক রহ. বলেন, এর অর্থ হলো- তার প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করা বৈধ এবং অর্থ তাকে আটক করা যাবে।’ (আবু দাউদ-৩৬২৮, নাসায়ি, ইবনে মাজাহ, আহমাদ)
লায়স রহ. আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘বনি ইসরাইলের কোনো এক ব্যক্তি বনি ইসরাইলের অপর এক ব্যক্তির কাছে এক হাজার দিনার ঋণ চাইল। তখন সে (ঋণদাতা) বলল, কয়েকজন সাক্ষী আনো, আমি তাদেরকে সাক্ষী রাখব। সে বলল, সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। তারপর (ঋণদাতা) বলল, তাহলে একজন জামিনদার উপস্থিত করো। সে বলল, জামিনদার হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। ঋণদাতা বলল, তুমি সত্যই বলেছ। এরপর নির্ধারিত সময়ে তাকে এক হাজার দিনার দিয়ে দিলো। তারপর ঋণগ্রহীতা সামুদ্রিক সফর করল এবং তার প্রয়োজন সমাধা করে সে যানবাহন খুঁজতে লাগল, যাতে সে নির্ধারিত সময়ের ভেতর ঋণদাতার কাছে এসে পৌঁছতে পারে। কিন্তু সে কোনো যানবাহন পেল না। তখন সে এক টুকরো কাঠ নিয়ে তা ছিদ্র করল এবং ঋণদাতার নামে একখানা পত্র ও এক হাজার দিনার তার মধ্যে ভরে ছিদ্রটি বন্ধ করে সমুদ্র তীরে এসে বলল, হে আল্লাহ! তুমি তো জানো আমি অমুকের কাছে এক হাজার দিনার ঋণ চাইলে সে আমার কাছে জামিনদার চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আল্লাহই জামিন হিসেবে যথেষ্ট। এতে সে রাজি হয়।
তারপর সে আমার কাছে সাক্ষী চেয়েছিল, আমি বলেছিলাম সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট, তাতে সে রাজি হয়ে যায়। আমি তার ঋণ (যথাসময়ে) পরিশোধের উদ্দেশে যানবাহনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু পাইনি। তাই আমি তোমার কাছে সোপর্দ করলাম, এই বলে সে কাষ্ঠখ-টি সমুদ্রে নিক্ষেপ করল। আর কাষ্ঠখ-টি সমুদ্রে প্রবেশ করল। এরপর লোকটি ফিরে গেল এবং নিজের শহরে যাওয়ার জন্য যানবাহন খুঁজতে লাগল। ওদিকে ঋণদাতা এই আশায় সমুদ্রতীরে গেল যে, হয়তো বা ঋণগ্রহীতা কোনো নৌযানে করে তার মাল নিয়ে এসেছে। তার দৃষ্টি কাষ্ঠখ-টির উপর পড়ল, যার ভেতরে মাল ছিল। সে কাষ্ঠখ-টি তার পরিবারের জ্বালানির জন্য বাড়ি নিয়ে গেল। যখন সে তা চিরল, তখন সে মাল ও পত্রটি পেয়ে গেল। কিছু দিন পর ঋণগ্রহীতা এক হাজার দিনার নিয়ে এসে হাজির হলো এবং বলল, আল্লাহর কসম! আমি আপনার মাল যথাসময়ে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশে সব সময় যানবাহনের খোঁজে ছিলাম। কিন্তু আমি যে নৌযানে এখন আসলাম, তার আগে আর কোনো নৌযান পাইনি। ঋণদাতা বলল, তুমি কি আমার কাছে কিছু পাঠিয়েছিলে? ঋণগ্রহীতা বলল, আমি তো তোমাকে বললামই যে, এর আগে আর কোনো নৌযান আমি পাইনি। সে বলল, তুমি কাঠের টুকরোর ভেতরে যা পাঠিয়েছিলে, তা আল্লাহ তোমার পক্ষ থেকে আমাকে আদায় করে দিয়েছেন। তখন সে আনন্দচিত্তে এক হাজার দিনার নিয়ে ফিরে চলে গেল।’ (বুখারি-২২৯১)
অতএব ঋণ থাকলে তা জীবিত থাকতেই তা শোধ করা চাই। আর কোনোভাবেই শোধ সম্ভব না হলে ঋণদাতার কাছ থেকে ক্ষমা করিয়ে নিতে হবে অথবা কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা সংগঠনের শরণাপন্ন হয়ে ঋণ মওকুফ বা পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনোভাবেই ঋণ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
সাথে সাথে আল্লাহর কাছে ঋণমুক্তির জন্য দোয়া করতে হবে- ‘আল্লা-হুম্মাকিফনি বিহালা-লিকা আন হারা-মিকা ওয়া আগ্নিনি বিফাদলিকা আম্মান সিওয়া-কা।’ অর্থ- হে আল্লাহ! আপনি আমাকে হারাম ছাড়া হালাল দিয়ে যথেষ্ট করুন এবং আপনার অনুগ্রহ দিয়ে আমাকে অন্যদের থেকে মুখাপেক্ষীহীন করুন! আমিন। লেখক : সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি