রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৯ অপরাহ্ন

পবিত্র শবে বরাত ২৫ ফেব্রুয়ারি

ইসলাম ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি রোববার দিবাগত রাতে সারা দেশে পবিত্র শবে বরাত পালিত হবে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে শাবান মাস গণনা শুরু হয়েছে। সেই হিসাবে আজ রোববার দিবাগত রাতই শবে বরাতের রাত। শবে বরাতের পরের দিন বাংলাদেশে নির্বাহী আদেশে সরকারি ছুটি। এবার এ ছুটি পড়েছে ২৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার। তবে দৈনিক পত্রিকার ছুটি আজ রোববার। শবে বরাতের পুণ্যময় রাতটি বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াতসহ ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে কাটিয়ে থাকেন। শাবান মাস শেষেই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের আনন্দ বারতা নিয়ে শুরু হয় সিয়াম সাধনার মাস রমজান।
যেভাবে এলো পবিত্র শবে বরাত: পবিত্র শব-ই-বরাত বা লাইলাতুল বরাত। শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাতকে শবে বরাতের রাত্রী বলে ঘোষণা করা হয়। শব শব্দটি ফার্সি যার অর্থ রাত আর বরাত শব্দের অর্থ ভাগ্য।
বিশেষ এ রাতে মহান আল্লাহ তায়ালা আগামী এক বছরের জন্য মানুষের রিজিক, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণসহ তার সৃষ্ট জীবের ওপর অসীম রহমত নাজিল করে থাকেন বলে এ রাতকে শবেবরাত বা ভাগ্যরজনী বলা হয়। কবি গোলাম মোস্তফার ভাষায়-‘সারা মুসলিম দুনিয়ায় আজি এসেছে নামিয়া ‘শবেবরাত’/ রুজি-রোজগার-জান-সালামৎ বণ্টন করা পুণ্য রাত/এসো বাংলার মুসলেমিন/হূতবঞ্চিত নিঃস্ব দীন/ভাগ্য-রজনী এসেছে মোদের, কর মোনাজাত-পাতো দু’হাত/বলো, কথা দাও, সাড়া দাও আজি, জবাব দাও এ প্রার্থনার/যদি নাহি দাও/খাবো না আমরা আজি এ ফিরনী-রুটি তোমার।’
এই শবেবরাত পালন নিয়ে আলেম-ওলামা ও ধর্মচিন্তাবিদদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশে ঘটা করেই পালিত হয়ে আসছে। একটি মাত্র ‘হাসান’ হাদিসে এটাকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলা হয়েছে। এই রাতকে লাইলাতুল বরায়াতও বলা হয়। বহু মুহাক্কিক আলেম ও ইসলামের বিশেষজ্ঞগণ এই রাতে বিশেষ কোনো ইবাদতের নির্দেশ নেই বলে মনে করেন।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরানসহ কয়েকটি দেশে শবেবরাত পালনের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। সৌদি আরবে শবেবরাতের কোনো অস্তিত্ব নেই। ইরানে শবেবরাত শিয়া মাজহাবের দ্বাদশ ইমাম হযরত ইমাম মাহদির জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়। এই রাতে ইরানের সর্বত্র আলোক সাজসজ্জা করা হয় ও বিশেষ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
হাদিস জগতের সবচেয়ে বিশুদ্ধতম গ্রন্থ বুখারি ও মুসলিম শরিফে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান নিয়ে কোনো হাদিস পাওয়া যায় না। তবে সিহাহ সিত্তার অন্যান্য গ্রন্থে এ সম্পর্কে একাধিক হাদিস পাওয়া যায়। যেমন ইবনে মাজাহর ১৩৮৮ নম্বর হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রজনী আসে, তখন তোমরা রাতে দ-ায়মান থাকো এবং দিবসে সিয়াম পালন করো। কারণ, ওই দিন সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিক তালাশকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব। কোনো দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে মুক্ত করব। এভাবে সুবহে সাদিক উদয় পর্যন্ত চলতে থাকে। হাদিসের ইমামদের মত অনুযায়ী, এই হাদিস অত্যন্ত দুর্বল। কিন্তু বুখারি ও মুসলিম শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমাদের প্রতিপালক প্রতি রাতের শেষ এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন, আমাকে ডাকার কেউ আছে কি? আমি তার ডাকে সাড়া দেবো। আমার কাছে চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি তাকে তা প্রদান করবো। আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো।
বুখারি ও মুসলিমের এই সহিহ হাদিস দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, মুমিনের প্রতি রাতই ফজিলতপূর্ণ। অনুরূপভাবে সিহাহ সিত্তার অন্যতম হাদিস গ্রন্থ তিরমিজি শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহে ওয়া সাল্লামকে খুঁজে পেলাম না। তখন বের হয়ে দেখি তিনি জান্নাতুল বাকিতে আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে রয়েছেন। তিনি বললেন, তুমি কি আশঙ্কা করছিলে যে আল্লাহ ও তার রাসুল তোমার ওপর অবিচার করবেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাহে ওয়া সাল্লাম আমি ধারণা করেছিলাম যে আপনি আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর নিকট গমন করছেন। অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চয়ই মহিমান্বিত পরাক্রান্ত আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। অতঃপর তিনি ‘কালব গোত্রের মেষপালের পশমের অধিক সংখ্যককে ক্ষমা করেন।’
ইমাম বুখারি (রা) ওই হাদিসটিকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ রাতের বিষয়ে চার ইমামের ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। ইমাম মালেক (র) ও তার অনুসারী ফকিহ ও ইমামগণ ওই রাতে বিশেষ ইবাদত পালন করতে নিষেধ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী (র)-এর মতে, এ রাতে ব্যক্তিগতভাবে একাকী নিজ গৃহের মধ্যে ইবাদত ও দোয়া মোনাজাতে থাকা মুস্তাহাব। ইমাম আবু হানিফা (র) ও ইমাম আহমদ (র) এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করেননি।
কিভাবে এলো শবে বরাত? ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, শবেবরাত বলে ৪০০ হিজরির আগে কিছু ছিল না। কিছু মুয়াক্কিব আলেমদের মতে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহে ওয়া সাল্লাম এর দীর্ঘ ২৩ বছরের নবুওয়াতী জীবনে, এমনকি সাহাবীদের যুগেও এই ধরনের কোনো দিবস পালনের কথা ইসলামের ইতিহাসে নেই। শবেবরাত সর্বপ্রথম চালু হয়েছিল ৪৪৮ হিজরিতে বায়তুল মুকাদ্দাসে (মাসজিদুল আকসায়)। তৎকালে সেখানকার ইমামগণ বাদশার কাছে নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করার জন্য শাবানের রাতে মসজিদে উপস্থিত লোকদের মাঝে বহু ফযিলতের ওয়াজ ও নামাযের অশেষ নেকী পাওয়ার বানোয়াট বিবরণ পেশ করতেন। যে ইমাম শবেবরাতের যত বেশি বানোয়াট ওয়াজ ও তাফসীর করতে পারতেন সে মসজিদে তত বেশি লোক জমা হতো। ইমামদের এই ভিড় বাড়ানোর উদ্দেশ্য ছিল বাদশাহর নিকট তাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করা। বাদশাহ গদির স্বার্থে জনপ্রিয় লোকদের হাতে রাখতে চাইতো। তাই ইমামদের মধ্যে জনপ্রিয়তার লড়াইয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে এই শবেবরাতকে নির্বাচিত করেছিল। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ইমামদের মর্যাদা বিচার করতো বাদশাহ। সে সময়ের বাদশা ছিলেন ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন। বাদশার সমর্থন থাকায় শবেবরাত উদযাপন আরো জাঁকজমক ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে সে যুগের হক্বপন্থি আলেমগণ এ নতুন আবিষ্কৃত ইবাদত পালনের বিরুদ্ধে নিজেদের সাধ্যানুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু সমাজের কিছু লোকেরা হক্বপন্থি আলেমদের কথা শ্রবণ না করে বিদ’আতীদের অনুসরণ করতে থাকে। কিন্তু এটি পৃথিবীতে বেশিদিন টিকতে পারেনি। সৃষ্টির পর মাত্র ৩৫২ বছর চালু ছিলো। জনপ্রিয়তা পাবার পরও একসময় তা জেরুজালেম, সিরিয়া, মিশর, ইরাকসহ প্রায় সকল দেশেই আবার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে ইরানের শিয়াদের কিছু অঞ্চলে তা চালু থেকে যায়। সেই সময় ভারতবর্ষে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ছিল। ভারতের কিছু নও-মুসলিম ইরানে বিস্তার লাভ করা এই শবেবরাত ভারতেও প্রচলন করলো। এই নও-মুসলিমরা পূর্বে ছিল হিন্দু। তারা হিন্দুদের দীপালি পূজার মতো শবেবরাতের রাতে মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালাতো। তারপর তা ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তারা সলাতুর রাগায়েব নামে চালু করে একটি নামায। এই নামায ১০০ রাকাত। এটাই শবেবরাতের নামায বলে খ্যাত।
বাংলাদেশে হালুয়া-রুটির প্রচলন যেভাবে: শবেবরাতের অন্যতম অনুষঙ্গ হালুয়া-রুটি। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন তার গবেষণায় জানাচ্ছেন, ১৯শ শতকের শেষের দিকে ঢাকার নবাবরা বেশ ঘটা করেই শবেবরাত পালন করতেন, সে সময়ে ঢাকার নবাবরা শবেবরাতের আলোকসজ্জা করতেন। এরপর পাশাপাশি মিষ্টি বিতরণ করতেন। সে সময়ে যেহেতু মিষ্টির দোকান খুব একটা প্রচলিত ছিল না, সেজন্য মিষ্টি জাতীয় খাদ্য বানানোর উপাদান দিয়ে বাড়িতে হালুয়া তৈরির প্রচলন শুরু হয়। ধীরে-ধীরে এর বিস্তার ঘটতে থাকে। মূলত সে সময়ে হিন্দুদের আধিপত্য থাকার কারণে সেটিকে মোকাবেলার জন্য ঢাকার নবাবরা শবেবরাত খুব ঘটা করে আয়োজন করতেন। সেই সিলসিলা এখনো চলছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত কর ও দিনে রোজা পালন কর। (সুনানে ইবনে মাজাহ)। এ ছাড়া প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিজের নফল রোজা তো রয়েছেই, যা আদি পিতা হজরত আদম (আ.) পালন করেছিলেন এবং আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদও (সা.) পালন করতেন, যা মূলত সুন্নত।
বর্জনীয় আমলসমূহ: * শিরকে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকা। * হিংসাত্মক কাজ না করা। * আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজ না করা। * সমবেত হয়ে ইবাদাত বন্দেগী করা থেকে বিরত থাকা। * মসজিদ, মাজার ও কবরস্থান আলোকসজ্জায় সজ্জিত না করা। * এ রাতে মৃত ব্যক্তির আত্মা তার গৃহে ফিরে আসে এমন ধারণা পোষণ না করা। * আতশবাজি ফোটানো থেকে বিরত থাকা। * রাতে ইবাদাতের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় গোসল করাকে ফজীলতপূর্ণ মনে না করা। * এ রাতকে খাওয়া দাওয়া ও উৎসবের রাতে পরিণত না করা। * এ রাতকে ভাগ্য রজনী মনে না করা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com