সাম্প্রতিক সময়ে মা-বাবার প্রতি সন্তানদের নিষ্ঠুর আচরণ বেড়ে গেছে। কী সচ্ছল, কী গরিব- সব ধরনের পরিবারে বেশির ভাগ বয়স্ক বাবা-মা এখন অবহেলার পাত্র। ব নার শিকার। অথচ তারা তাদের যৌবনে সন্তানকে মানসিক ও বৈষয়িকভাবে সক্ষম করে তুলতে কী না করেন! সেই তারা বার্ধক্যে পরিবারের কাছে হয়ে পড়ছেন মূল্যহীন। সমাজবিজ্ঞানীরা এর তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা দিতে পারবেন নিশ্চয়। আমরা যারা সাধারণ মানুষ; যাদের কাঠামোগত জ্ঞান নেই; তাদের কাছে বিষয়টি পীড়াদায়ক। সৃষ্টিজগত একটি মহাবিস্ময়। আর সেই মহাবিস্ময়ের আরেক সৃষ্টি মানবজাতি। কী আশ্চর্যভাবেই না সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টিকে প্রেরণ করেন মায়ের গর্ভে। সেখানে আলো নেই, বাতাস নেই, খাবার নেই তবুও বেড়ে ওঠে একটি জীবন। একটি রক্তপি- রূপ নেয় মানুষের। ৯টি মাস মায়ের গর্ভে থেকে পরিবর্তনের ধারায় মানুষরূপে পৃথিবীতে আসে। ৯টি মাস নিজের শরীরের রক্তের বিনিময়ে বেড়ে ওঠা সন্তান নামক জীবনটিকে পৃথিবীতে আনতে মায়ের যে কতটা যন্ত্রণা সইতে হয় তা শুধু মা-ই জানেন।
অসহনীয় সেই প্রসব বেদনা সয়ে প্রিয় সন্তানকে পৃথিবীতে আনেন মা। রাতের পর রাত জেগে, সব আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে সেই ছোট শিশুটিকে ধীরে ধীরে বড় করে তোলেন। এরপর যখন হাঁটতে শেখে, খেলতে শেখে তখন বাবা হাত ধরে হাঁটতে শেখান। চলতে শেখান। খেলতে শেখান। জীবন চলার সাহস জোগান। মায়ের কোলে থেকে পৃথিবী দেখা, বাবার হাতে হাত রেখে হাঁটতে শেখা সন্তানটি একদিন পরিপূর্ণ হয়ে বেড়ে ওঠে। জীবন আল্লাহর দান। বাবা-মা হলো সেই জীবনের একটি অংশ, অস্তিত্ব। বাবা-মা ছাড়া এই পৃথিবীতে আমাদের আসা সম্ভব হতো না। তাদের ত্যাগ ভালোবাসা ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব থাকত না। পৃথিবীতে বাবা-মায়ের মতো আপনজন, বাবা-মায়ের মতো শুভাকাক্সক্ষী আর কেউ হতে পারে না। সন্তানের পৃথিবীতে আসার পর কত স্বপ্ন কত আশা এই সন্তানকে ঘিরে থাকে বাবা-মায়ের। সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করা, লেখাপড়া শেখানো, তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ, এসব ছাড়া বাবা-মা আর কিছুই ভাবেন না নিজের জন্য। বিশেষ করে মায়ের ত্যাগ অনেক বেশি।
কথায় বলে, ‘সন্তান যত দূরেই থাকুক, সন্তান কষ্ট পেলে মায়ের মনে তা সাড়া দেয়।’ আশ্চর্য এক নাড়ির বন্ধন এটি। তাই তো মানুষ আঘাত পেলে নিজের অজান্তেই বলে ওঠে, মা। কষ্ট পেলে নিজের অজান্তে মা শব্দ বেরিয়ে আসাই প্রমাণ করে মা ও সন্তানের সম্পর্ক কতটা গভীর। বাবা-মায়ের মতো করে কেউ ভালোবাসতে পারে না। বাবা-মা আমাদের শ্রদ্ধাভাজন। আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই তো পবিত্র আল কুরআনে বাবা-মায়ের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘তোমার প্রতিপালক ফায়সালা করে দিয়েছেন যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না। মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। তোমার জীবদ্দশায় তাদের যেকোনো একজন বা উভয়েই বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের কোনো কথায় বা আচরণে বিরক্ত হয়ে উফ শব্দটিও বলো না। তাদের ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনকভাবে কথা বলবে। তাদের সামনে দয়াবনত হয়ে বিনয়ের বাহু বিছিয়ে দাও। আর তাদের জন্য এ বলে দোয়া করো, হে প্রভু! আপনি তাদের প্রতি দয়া করুন যেমন তারা আমাকে দয়া দিয়ে লালন পালন করেছেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৪)
বাবা-মায়ের প্রতি আমাদের সঠিক দায়িত্ব পালন করা উচিত। বয়সের ভারে তারা যখন কর্মহীন হয়ে পড়েন তখন মানসিকভাবে তারা ভেঙে পড়েন। তখন সন্তানের উচিত তাদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করা। সার্বক্ষণিক বাবা-মায়ের খোঁজখবর রাখা। যদিও বর্তমানে বৃদ্ধ বাবা-মা অবহেলিত থাকেন অধিকাংশ পরিবারে। সেটি অন্যায়। বাবা-মায়ের সেবায় জান্নাত মেলে। অথচ অনেককে দেখা যায়, বাবা-মায়ের খোঁজ নেই তিনি পীর ধরে পীরকে খুশি করতে ব্যস্ত। আর বৃদ্ধাশ্রম তো আছেই। অথচ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সা: একদিন তিনবার বললেন, ‘তার নাসিকা ধুলায় ধূসরিত হোক!’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কার ব্যাপারে এসব বদদোয়া করছেন? রাসূল সা: বললেন, ‘যে ব্যক্তি তার মা-বাবা উভয়কে অথবা যেকোনো একজনকে বার্ধক্যে উপনীত অবস্থায় পেল তবুও সে (তাদের খেদমত করে) জান্নাতের পথ সুগম করতে পারল না।’ (মুসলিম-২৫৫১) বাবা-মায়ের ঋণ কখনো শোধ করার নয়। তাই যত দিন তারা বেঁচে থাকেন তাদের সেবা করে যেতে হবে। বাবা-মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে কোনো ইবাদতই সফল হবে না। অন্য এক হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে- মহানবী সা: বলেছেন, ‘মা-বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং মা-বাবার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত।’ (তিরমিজি) এমনকি সে মা-বাবা যদি বিধর্মী হয় তবুও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার বজায় রাখতে হবে। আরেক হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে- আসমা বিনতে আবু বকর রা: বলেন, কুরাইশদের সাথে সন্ধির দিনে আমার মা মুশরিক অবস্থায় আমার কাছে এলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞাসা করলাম, আমি কি তার সাথে সদ্ব্যবহার করব? রাসূলুল্লাহ সা: উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ, সদ্ব্যবহার করো।’ (বুখারি) আমাদের ইহকালের সুখের জন্য মা-বাবা যেমন আজীবন চেষ্টা করেন তেমনি মা-বাবার সেবায় পরকালেও সুখ মিলবে। অন্য এক হাদিসে এভাবেই বলা হয়েছে, ‘যখন কোনো অনুগত সন্তান নিজের মা-বাবার দিকে অনুগ্রহের নজরে তাকায়, তখন আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে একটি করে কবুল হজের সওয়াব দান করেন।’ (সুনানে বায়হাকি-৪২১) সন্তানের জন্য মায়ের ত্যাগ সবচেয়ে বেশি। কারণ, প্রসব যন্ত্রণার মতো এত কঠিন যন্ত্রণা আর নেই। তাই তো মা হিসেবে ইসলামে একজন নারীর অবস্থান অনেক ঊর্ধ্বে। ইসলামে বাবার চেয়ে মায়ের মর্যাদা তিনগুণ বেশি। পবিত্র কুরআনে মায়ের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করে মাকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। একবার এক লোক এসে রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার থেকে সদাচরণ পাওয়ার সর্বাধিক অধিকার কার?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মায়ের’। তিনি আবারো একই প্রশ্ন করলেন। রাসূল সা: দ্বিতীয়বারও উত্তরে বললেন, ‘তোমার মায়ের’। তিনি আবারো একই প্রশ্ন করলেন, রাসূল সা: তৃতীয়বারের উত্তরেও বললেন, ‘তোমার মায়ের’। তিনি আবারো একই প্রশ্ন করলেন, রাসূল সা: চতুর্থবার বললেন, ‘তোমার বাবার’। (বুখারি-৫৬২৬)
আরেক হাদিসে এসেছে- হজরত আবু উমামা রা: বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞাসা করলেন, সন্তানের ওপর মা-বাবার হক কী? উত্তরে বিশ্বনবী সা: বললেন, ‘তারা উভয়েই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম’। অর্থাৎ যারা মা-বাবার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে, তারা সফল হবে। আর যারা তাদের অবাধ্যতায় লিপ্ত হবে তাদের জন্য লাঞ্ছনা। মায়ের সেবা করা, মায়ের যতœ নেয়া এবং মাকে খুশি করার গুরুত্ব বোঝাতে রাসূল সা: আরেক হাদিসে ইরশাদ করেন, ‘জান্নাত মায়ের পদতলে’। (কানজুল উম্মাল-৪৫৪৩৯) কোনো অবস্থায় কখনো আমাদের বাবা-মায়ের সাথে খারাপ ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করা উচিত নয়। আমাদের সবসময় চেষ্টা করতে হবে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে। তাদের সুখী রাখতে। বৃদ্ধাশ্রমে নয়, নিজের চোখের সামনে হাতের কাছে রেখে সেবা করতে হবে। লেখক : চিকিৎসক, কলামিস্ট