বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘আইনজীবীদের মর্যাদাও ধূলায় লুটিয়ে দিয়েছে সরকার।’
অবিলম্বে সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন বাতিল করে পুনর্র্নিবাচনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের সংগঠনও তাদের কালো থাবায় বিপর্যস্ত। এভাবে চলতে থাকলে দেশকে ভয়ানক গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া হবে। সরকারের হাতের মুঠোয় রয়েছে ধ্বংসের শক্তি।’
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ল-ভ- নির্বাচনী ব্যবস্থা ও পেশীশক্তির উন্মত্ততার হিংস্র প্রতিফলন দেশের জনগণ অবলোকন করলো সুপ্রিমকোর্ট অঙ্গনেও। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রাখতে সরকার যে সকল কূটকৌশল অবলম্বন করছে, তার সবকিছুই তারা সদ্য সমাপ্ত সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে প্রয়োগ করেছে। গত ৬ এবং ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে নজিরবিহীন ভোট জালিয়াতি, কারচুপি, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সাথে যুবলীগের হাঙ্গামা, সংঘর্ষ, অস্ত্রের মুখে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের স্ত্রী স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদ সুলতানা যুথীকে সম্পাদক পদে নির্বাচিত ঘোষণা, পরে আবার দলীয় ও মেয়র তাপসের প্রার্থীকে সম্পাদক পদে বিজয়ী ঘোষণার মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ আইনঙ্গনের আইনজীবীদের মর্যাদা ধূলায় লুটিয়ে দিয়েছে। তারা হিংসা-প্রতিহিংসার পথে দেশের রাজনীতিকে উপসংহারহীন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।’
রিজভী বলেন, ‘এই ভোট জালিয়াতি ও নিজেদের অপকর্মের ঘটনা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরাতে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলকে সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ফলাফল গণনা নাটকের নামে জালিয়াতি করে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলকে হারিয়ে দলীয় ও যুবলীগের চেয়ারম্যান পরশের আপন ভাই মেয়র তাপসের প্রার্থী শাহ মঞ্জুরুল হককে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের নির্বাচনে ভোটে যার সেক্রেটারি নির্বাচিত হওয়ার কথা তাকে পুরা হয়েছে জেলে! আর যার নিশ্চিত পরাজিত হওয়ার কথা তাকে বসানো হয়েছে সম্পাদকের চেয়ারে। ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলকে যে মামলায় আটক করা হয়েছে সেই মামলায় এক নম্বর আসামি যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের স্ত্রী নাহিদ সুলতানা যুথীকে গ্রেফতার তো দুরের কথা তার নাম নিতেও ভয় পাচ্ছে প্রশাসন।’
তিনি বলেন, ‘গতকাল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান বলেছেন যে যুথিকে খুঁজে পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অথচ মামলার পর সেই রাতেই বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার ওসমান চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আর যুথিকে খুঁজে পাবে কিভাবে? পুলিশ শুধু বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার আগেই খুঁজে গ্রেফতার করে। না পেলে বিএনপি নেতাদের মা-বাবা-স্ত্রী-সন্তান পরিবারের সদস্যদের তুলে নিয়ে যায়। ২০ জনের নামে করা এজাহারে যুথি শুধু এক নম্বর আসামিই নয়, দৃশ্যমান আক্রমণকারীদের একজন পৃষ্ঠপোষক। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে ঘটনার সবকিছু ধারণ করা আছে। অথচ মামলার পরদিন শনিবার গ্রেফতার করা হয় সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজলকে। পরশ-তাপস দু’ভাইয়ের মারামারি এবং পারিবারিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সামাল দিতে এবং সম্পাদক পদ দখলের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়েছে কাজলকে। এত সহিংস ঘটলেও বিচারপতিরা নিশ্চুপ।’
রিজভী বলেন, ‘গত ৬ এবং ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে ২০২২ ও ২০২৩ সালের সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের কলঙ্কজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে সরকার দলীয় দুর্বৃত্তরা। ব্যাপক জনপ্রিয় ও অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়ার কারণে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলকে তাদের ভয়। ২০২২ সালে নির্বাচনে সম্পাদক পদে রুহুল কুদ্দুস কাজল বিজয়ী হলেও নির্বাচনের ৪২দিন পর সমিতির তৃতীয় তলায় অবস্থিত কনফারেন্স রুম ভেঙ্গে পুলিশ ও বহিরাগতদের সহায়তায় তথাকথিত ভোট পুনঃগণনার নামে সম্পাদক পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় এবং সম্পাদক অফিস জবরদখল করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ১৫ ও ১৬ মার্চ নির্বাচনের সময়ও পুলিশ ও বহিরাগতদের দিয়ে বিএনপির প্রার্থী, ভোটার, সাংবাদিকদেরকে বেধড়ক মারধর করে ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে পুনরায় সমিতি নিজেরা জবরদখল করে রাখে।’
তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় এই যে নানা অনিয়ম ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভোট গ্রহণের পর ৮ মার্চ ভোরবেলা অডিটরিয়মের ভেতরে ঘটা নৈরাজ্যকর ঘটনা আওয়ামী লীগের দু’জন প্রার্থী শাহ মঞ্জুরুল হক ও নাহিদ সুলতানা যুথীর সমর্থকদের মধ্যে সংগঠিত হলেও উক্ত ঘটনায় জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী রুহুল কুদ্দুস কাজল ও আরো তিন আইনজীবী নেতাকে আসামি করে শাহবাগ থানায় একটি ফৌজদারী মামলা দায়ের করার পরই তাদের বাড়িতে-চেম্বারে হানা দেয়া হয়। এমন আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে যে অনেক আইনজীবী সুপ্রিমকোর্টে যেতে পারছেন না। এমন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে গত ২০২২ এবং ২০২৩ সালের সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচন ও সদ্য সমাপ্ত ঢাকা আইনজীবী সমিতি নির্বাচনের ন্যায় নিজেদের পছন্দ মতো ব্যক্তিদের নাম বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।’
রুহুল কবির রিজভী, ‘আমরা সবসময় বলে আসছি যে ক্ষমতাসীন সরকার ও তাদের ছত্র-ছায়ায় দেশের কোথাও কোনো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, জনগণের ভোটারাধিকারে বিশ্বাসী নয়, বিগত ২০১৪, ২০১৮ এবং গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় নির্বাচনে ইতোপূর্বে তা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। সর্বশেষ প্রমাণ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন। এর আগে ঢাকা আইনজীবী সমিতি নির্বাচনেও একই ধরনের প্রহসনের নির্বাচন করা হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, দেশের সাধারণ মানুষের আইনের আশ্রয় নেয়ার শেষ ভরসাস্থল বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীদের সমিতিতে তারা নগ্ন হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির পক্ষ থেকে ৬ ও ৭ মার্চ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখান করছি এবং অবিলম্বে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির তথাকথিত নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করে নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘোষণা করতে হবে। একই সাথে দলের পক্ষ থেকে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল এবং ব্যারিস্টার ওসমান চৌধুরীসহ গ্রেফতার বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের নিঃশর্ত মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রিমান্ড বাতিলের জোর আহ্বান জানাচ্ছি।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদিন, নিতাই রায় চৌধুরী, আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, বদরুদ্দোজা বাদল, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলীসহ সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী কয়েকজন প্রার্থী।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, ‘সুপ্রিমকোর্ট বার নির্বাচনের ফলাফল সরকারের পূর্বনির্ধারিত। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে এমন নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা হস্তক্ষেপ করেছে। সম্পাদক প্রার্থী রুহুল কুদ্দুস কাজল কেনো মামলার আসামি হবে? আমরা এই নির্বাচনকে প্রত্যাখান করছি এবং অবিলম্বে নতুন নির্বাচন দেয়ার দাবি জানাচ্ছি। আমাদের প্যানেলের যিনি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন তিনিও নতুন নির্বাচন চেয়েছেন।’