রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৩ অপরাহ্ন

নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে একা এবং বিচ্ছিন্ন কেন?

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪

নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী বাংলাদেশি ড. মুহাম্মদ ইউনূস কারাগারের মুখোমুখি। পহেলা জানুয়ারি, বাংলাদেশের একটি শ্রম আদালত দেশটির শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ছয় মাসের কারাদ- দেয়। ইউনূসের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, কর ফাঁকি ও দুর্নীতির অভিযোগে ১৯৮টি মামলা চলমান। জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে মুক্ত থাকায় তার জেলের মেয়াদ এখনো শুরু হয়নি।
ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, যেটি এমন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয় যারা অন্য জায়গা থেকে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার জন্য যোগ্য নন। তিনি “গরিবের ব্যাংকার” হিসেবে পরিচিত। তার ক্ষুদ্রঋণের ধারণা বিশ্বের অনেক দেশে অনুসরণ করা হচ্ছে, এর প্রতিলিপি বানানো হয়েছে। ২০০৬ সালে ইউনূস এবং তার গ্রামীণ ব্যাংককে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম’ও পেয়েছেন। সংক্ষেপে বললে, ইউনূস সম্ভবত বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে খ্যাতিমান জীবিত বাংলাদেশি।
ইউনূসের সমর্থক এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিশ্বাস, তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার প্রচারণা চালাচ্ছেন, এমনটাই তাদের অভিযোগ। কিন্তু, সরকার এমন অভিযোগ অস্বীকার করে এই যুক্তি দিচ্ছে যে বিচারিক প্রক্রিয়ার উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যদিও, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে বিচারিক কার্যক্রম নিয়মিতভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্বার্থের সাথে মিলে গেছে। বাংলাদেশের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইমরান আহমেদ ভূঁইয়া গত বছর প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাগুলো বিচারিক হয়রানির সমতুল্য। ইমরানকে দ্রুত তার পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়, যা বিচার বিভাগের ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণেরই ইঙ্গিত দেয়।
ইউনূসের বন্ধুদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তাকে রক্ষার জন্য দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালে হাসিনার কাছে লেখা এক খোলা চিঠিতে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুন এবং ১০০ জনেরও বেশি নোবেলজয়ী সহ ১৭০ জনেরও বেশি প্রভাবশালী বিশ্ব ব্যক্তিত্ব ইউনূসের বিরুদ্ধে “নিরবিচ্ছিন্ন বিচারিক হয়রানি” বন্ধ করার জন্য হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বাংলাদেশের অনেকেই ইউনূসকে সম্মান করলেও, হাসিনা মাইক্রোক্রেডিট এ দেওয়া ঋণের উপর কথিত উচ্চ হারের সুদের উল্লেখ করে ইউনূসকে “গরিবদের রক্তচোষা” বলে অভিহিত করেছেন। ইউনূসের বিরুদ্ধে হাসিনার নিরলস এই প্রচারণার ভিত্তি কী? এর কারণ ব্যাখ্যা করা জটিল। বাংলাদেশের ইতিহাস, ব্যক্তিগত শত্রুতা এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ক্রমশ অবক্ষয়ের মধ্যে এসব প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে।
হাসিনা ও ইউনূসের সম্পর্ক সবসময়ই তিক্ত ছিল না, বরং তারা এক সময় মিত্রই ছিলেন। ১৯৯৭ সালে ইউনূস এবং তার হাই-প্রোফাইল নেটওয়ার্ক ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে একটি মাইক্রোক্রেডিট সামিট আয়োজন করেছিলেন যেখানে ১০০টি দেশের ২,০০০ জনেরও বেশি লোক যোগ দিয়েছিলেন। সেই সম্মেলনে শেখ হাসিনা কেবল কো-চেয়ারই ছিলেন না, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন এবং স্পেনের রানী সোফিয়া সহ ১৮ জন হাই-প্রোফাইল বক্তাদের মধ্যে তিনি-ই ছিলেন প্রথম বক্তা। হাসিনা নিজ বক্তৃতায় ক্ষুদ্রঋণের বন্দনা করেছিলেন। ২০ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম ক্ষমতায় আসেন। উক্ত সম্মেলনের অন্যতম মূল সংগঠক ইউনূসের কারণেই সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে অনুষ্ঠিত একটি শীর্ষ সম্মেলনে তাকে বিশ্ব মে হাই-প্রোফাইল মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। হাসিনা যখন ক্ষমতার দীর্ঘ ইনিংসের শুরুতে, ইউনূস তখন ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত। ২০০৬ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল- খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং বিরোধী দল- হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নির্বাচন প্রশাসন নিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে ছিল। আ.লীগ যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছিল বিএনপি সেটা মানতে নারাজ ছিল। রাস্তায় মারাত্মক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। তখন সামরিক বাহিনী সমর্থিত বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে হাসিনা-খালেদা দুজনকেই বন্দী করে।
২০০৭ সালে হাসিনা যখন কারাগারে তখন ইউনূস নাগরিক শক্তি নামে একটি রাজনৈতিক ম তৈরি করেছিলেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত একট খোলা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন: “আপনাদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পর, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে নতুন (ধারার) রাজনীতি তৈরির জন্য আপনাদের প্রচেষ্টায় যোগ দেব। আমি রাজনীতিতে যোগ দেব এবং রাজনৈতিক দল গঠন করব”।
লক্ষণীয় যে, ইউনূস উল্লেখ করেছিলেন, তার রাজনীতি হবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বাস্তবায়িত করার রাজনীতি, যার সাথে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এজেন্ডার অনেকটাই মিল রয়েছে, যে দল নিজেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শের রক্ষক হিসেবে প্রদর্শন করে। কিন্তু, কয়েক সপ্তাহ পরই ইউনূস রাজনীতি ছেড়ে দেন। হাসিনা ও খালেদা জেল থেকে মুক্ত হন। ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে হাসিনা বড় জয় পেয়ে সরকার গঠন করেন। হাসিনা যখন কারাগারে ছিলেন তখন ইউনূসের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার ঘোষণা হয়তো হাসিনাকে আলোড়িত করেছিল, কারণ তিনি হয়তো ইউনূসের পদক্ষেপকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে উপলব্ধি করেছিলেন। হাসিনার দৃষ্টিতে তিনি রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
২০১১ সালে হাসিনার সরকার গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ইউনূসকে সরিয়ে দিলে তাদের সম্পর্ক দ্রুতই খারাপ হতে শুরু করে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণ বাতিল করে এবং এই সিদ্ধান্তের জন্য ‘ইউনূস প্রভাবিত করেছেন’ বলে হাসিনা অভিযোগ তোলেন, যে অভিযোগ ইউনূস অস্বীকার করেন। অবশ্য হাসিনা কিংবা তার সহযোগীদের পক্ষ থেকে নিজেদের এমন অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। হাসিনা গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে কি সংসদ, কি বিচার বিভাগ, কি আমলাতন্ত্র, কি নির্বাচন কমিশন- বাংলাদেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের উপর তিনি নিজ দখল শক্ত করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিকরণের পাশাপাশি তিনি বিরোধীদের, গণমাধ্যম ও সমালোচনামূলক কণ্ঠকে নীরব করেছেন। বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ জনেরও বেশি মানুষকে গুম এবং ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রায় ২,৫০০ বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও নির্যাতনের জন্য দায়ী বলে অভিযোগ রয়েছে।
হাসিনার প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা বেশ কিছু অভিযোগে কারাবরণ করেন, যেসব অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যদিও অসুস্থতার কারণে তার কারাগারের সাজা আপাতত স্থগিত করা হয়েছে, কিন্তু সেটা কঠোর শর্ত সাপেক্ষে। গত বছর নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, লাখ লাখ বিরোধী নেতাকর্মী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগের সম্মুখীন। ইউনূস এ সময়টায় আওয়াজ তোলেননি। যদি তিনি তা করতেন তবে সেটা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতি অনেক বেশি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতো কারণ তিনি একজন হাই-প্রোফাইল বাংলাদেশি। কিন্তু, তিনি আ.লীগ সরকারের কর্তৃত্ববাদী পথের বিরুদ্ধে দেশে লড়াই করার চেয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বক্তব্য প্রদানে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখায় অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। জানুয়ারিতে নিজের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতের রায়ের পরই ইউনূস মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিষয়ে নিজের নীরবতার পাশাপাশি পশ্চিমে তার বাংলাদেশের মিত্রদের ক্ষয়িষ্ণু প্রভাবে ইউনূসের অবস্থান দুর্বল হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি হাসিনা যা কিনা বাংলাদেশে দেশটির প্রভাব হ্রাসের লক্ষণ। বাংলাদেশের ‘রুলিং এস্টাবলিশমেন্ট’ ইউনূসকে আমেরিকান মিত্র বলে মনে করে। ইউনূসের কেস দিয়ে বাংলাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং বিদেশি প্রভাবের পরিবর্তনশীল প্রকৃতিকে বোঝা যায় যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা অধঃপতনে রয়েছে এবং দেশটি এখন কর্তৃত্ববাদে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। [অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক স্কলার, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষক মুবাশ্বার হাসানের লেখাটি ওয়াশিংটন ডি.সি. ভিত্তিক খ্যাতনামা ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনে ২২ মার্চ প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন তারিক চয়ন, মানবজমিন অন লাইনের সৌজন্যে]




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com