ইসলাম, মানবতার কল্যাণের ধর্ম। যে ধর্ম সবধরনের মানুষকে পূর্ণাঙ্গ অধিকার দিয়েছে। প্রতিষ্ঠা করেছে মানবাধিকার। ধনী আরাম-আয়েশ করে কাটাবে, আর গরিব দুঃখে জর্জরিত হয়ে দিনাতিপাত করবে, তা মোটেও মানুষ হিসেবে মানুষের জন্য কাম্য নয়। তাই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এমন একটি বিধান নির্ধারণ করেছেন, যার দ্বারা গরিব-অসহায়দের মুখে হাসি ফুটবে। থাকবে না ভেদাভেদ গরিব-ধনীর মধ্যে। পবিত্র কুরআনুল কারিম ও হাদিসের ভাষায় যাকে বলা হয় জাকাত। জাকাত ইসলামের পঞ্চম ভিত্তির অন্যতম একটি। যেখানেই নামাজের কথা উল্লেখ রয়েছে, সেখানেই জাকাত দেয়ার তাগিদও রয়েছে। রয়েছে ৩২ বার জাকাত শব্দটি। তন্মধ্যে একটি আয়াত উল্লেখ করা যায়। ইরশাদ হচ্ছে- ‘তোমরা সালাত আদায় করো এবং জাকাত প্রদান করো। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। নিশ্চয় তোমরা যা করো আল্লাহ তা দেখছেন।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত-১১০)
জাকাত যার ওপর ফরজ (ওয়াজিব) : জাকাত, যা সাহেবে নিসাবকে আদায় করা বাধ্যতামূলক। ইসলামে এ অপরিহার্য ইবাদত মুসলিম, সুস্থ মস্তিষ্ক, আজাদ, বালেগ ও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকদের (২০০ দিরহাম বা আধুনিক হিসাবে সাড়ে ৫২ তোলা রুপা। ২০ মিসকাল বা আধুনিক হিসাবে সাড়ে সাত তোলা সোনা) জন্য প্রযোজ্য। (রুদ্দুল মুহতার দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৯৫) অনুরূপ জমিতে উৎপাদিত ফসল (পাঁচ ওয়াসাক অর্থাৎ আধুনিক হিসাবে ১৮ মণ ৩০ কেজি হলে), পালিত পশুতে (ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা ৪০টি, গরু ৩০টি এবং উট পাঁচটি। যা সায়েমা তথা যে পশু বছরের অধিকাংশ সময় নিজেই মাঠে বিচরণ করে খাদ্য গ্রহণ করে) জাকাত ফরজ হয়। (বুখারি : ১৪৮৩, ১৪৫৪, ১৪৪৭, মুসলিম : ২১৫৮, তিরমিজি-৬২৩)
সাদাকাতুল ফিতর : যা প্রত্যেক উপযুক্ত মুসলিমের ওপর ওয়াজিব। কিন্তু জাকাতের নিসাবের মতো পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। যার কাছে ঈদের দিন পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের (ঘর, কাপড়, গাড়ি ইত্যাদি) অতিরিক্ত নিসাব থাকে তাকে সাদাকাতুল ফিতর দিতে হবে। পরিবারের একজনের ওপর তা প্রযোজ্য হলে তিনি নিজের ও সবার পক্ষ থেকে এমনকি নবজাতকের পক্ষ থেকে আদায় করবেন। (আল জাওহারাতুন নিয়ারাহ প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩২)
যাদের ওপর জাকাত ফরজ নয় : সবধরনের সম্পদ ও সামগ্রীর ওপর জাকাত ফরজ হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে জাকাত ফরজ হয়। পক্ষান্তরে নিজে ও পোষ্য পরিজনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর জাকাত ফরজ নয়। তা যত উচ্চমূল্যেরই হোক না কেন? তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, যেসব বস্তুতে জাকাত আসে না, সেগুলোতে যুক্ত সোনা-রুপা (সোনা-রুপা গচ্ছিত থাকে, যা মিলিয়ে নিসাব পরিমাণ হয়ে যায়) থেকে জাকাতযোগ্য হলে জাকাত ফরজ হবে। (আত-তামহিদ, দশম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৪৯০) কিছুসংখ্যক ঋণগ্রস্ত জাকাতকে এড়িয়ে যান। তাদের ভাষ্য- ‘ঋণগ্রস্তের জাকাত হয় না’। কিন্তু ঋণের পরিমাণ যদি এমন হয়, যা বাদ দিলে তার কাছে নিসাব পরিমাণ হবে, তাহলে তাকে জাকাত দিতে হবে; আর যদি জাকাতযোগ্য না হয় তাহলে তার ওপর জাকাত ফরজ নয়। (ফতোয়া বিন বাজ, ১৫ খ-, পৃষ্ঠা-২৪২)
জাকাতের উদ্দেশ্য : সাহেবে নিসাব জাকাত না দিলে পৃথিবীর বেশির ভাগ সম্পদ অল্পসংখ্যক লোকের দখলে চলে যাবে। ফলে শত কোটি মানুষ দারিদ্র্যের দিকে ধাবিত হবে। ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পদের ভারসাম্যহীনতা দূর করে মানবিক সম্পর্কের সূত্রে পরস্পরকে আবদ্ধ করাই জাকাতের মূল লক্ষ্য। কুরআনের ভাষায়- ‘আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রাসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রাসূলের, তাঁর আত্মীয়-স্বজনের, ইয়াতিমদের, অভাবগ্রস্তদের ও মুসাফিরদের জন্য, যাতে ধনৈশ্বর্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়।’ (সূরা হাশর, আয়াত-৭) পাশাপাশি ধনীদের সম্পদে গরিব ও অভাবগ্রস্তদের পুরো হক আদায় করাও মুসলিম হিসেবে আবশ্যক। কেননা, আল্লাহর দেয়া এ সম্পদে গরিবের অধিকার রয়েছে। কুরআনের ভাষায়- ‘এবং তাদের ধনসম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বি তের হক।’ (সূরা জারিআত, আয়াত-১৯)
জাকাতের খাত : যেসব লোককে জাকাত দিতে হবে তাদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- ‘জাকাত কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত (যার কাছে অতি সামান্য মাল আছে অথবা কিছুই নেই, এমনকি এক দিনের খোরাকিও নেই) ও জাকাতের কাজে নিযুক্ত (কর্মকর্তা-কর্মচারী), যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য (যে ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্ত যে, ঋণ পরিশোধ করার পর তার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে না), আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য (কোনো ব্যক্তি নিজ বাড়িতে নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী, কিন্তু সফরে এসে অভাবে পড়ে গেছে বা মাল-সামান চুরি হয়ে গেছে। তবে এ ব্যক্তির জন্য শুধু প্রয়োজনের পরিমাণ গ্রহণ করাই জায়েজ, এর বেশি নয়)। (সূরা তাওবাহ, আয়াত-৬০) জাকাত, গরিবকে দানে পাওয়া যায় একটি সওয়াব, আর আত্মীয়-স্বজনকে দানে দু’টি সওয়াব। দান করার সওয়াব এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার সওয়াব। (সুনানে নাসায়ি-২৫৮২) আত্মীয়-স্বজনদের যারা হকদার তারা হলেন- যার ওপর জাকাত ওয়াজিব তিনি তার উসুল এবং ফুরু অর্থাৎ তার উপরের আত্মীয় যথা- বাবা-দাদা, পরদাদা প্রমুখ। দাদী, দাদীর দাদী প্রমুখ। মা, নানী প্রমুখ। সেই সাথে ফুরু তথা ছেলেমেয়ে, নাতি প্রমুখ এবং স্ত্রীকে জাকাত দেয়া যাবে না। এ ছাড়া বাকি আত্মীয়-স্বজনকে জাকাত দেয়া জায়েজ আছে। (ফতোয়ায়ে আলমগিরি, প্রথম খ-, পৃষ্ঠা : ১৮৮-১৮৯, আল বাহরুর রায়েক, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬২)