ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরানের শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন নিক্ষেপের আক্রমণ মার্কিন কর্মকর্তাদের আশঙ্কার চেয়েও কার্যকর গতকাল সোমবার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস নিউজ অ্যাজেন্সি বরাত দিয়ে এ কথা জানায় কাতার-ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে নিউজ অ্যাজেন্সিটি বলছে,অধিক পরিমাণে বাধা সত্ত্বেও ইরানের উদ্দেশ্য ছিল ‘ধ্বংস এবং হতাহত’ করা। যদি সফল হয় তবে হামলাগুলো মধ্যপ্রাচ্য-জুড়ে ‘অনিয়ন্ত্রণ’ বাড়াবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও সিনিয়র কর্মকর্তারা হোয়াইট হাউস সিচুয়েশন রুমে হামলা ও বাধা দেয়ার প্রচেষ্টা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কর্মকর্তারা জানান, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টা সফল হয়েছে দেখে তারা স্বস্তিতে ছিল। এদিকে ইসরাইলের যুদ্ধ মন্ত্রিসভা ইরানের ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার জবাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে কখন এবং কোন মাত্রায় তা হবে সে ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। শনিবার রাতের হামলার পর রোববার বিকেলে ইসরাইলের পাঁচ সদস্যের মন্ত্রিসভা এই সিদ্ধান্ত নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান, খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিনকে ‘সতর্কভাবে ও কৌশলগতভাবে চিন্তা’ করার আহ্বান জানানোর প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ মন্ত্রিসভা তার সিদ্ধান্তগুলো স্থগিত রেখেছে। তবে তারা সংক্ষিপ্ত সময়ের নোটিশেই তা কার্যকর করতে পারবে বলে চ্যানেল ১২ নিউজের খবরে বলা হয়েছে।
ইসরাইল হায়ুম দৈনিক পত্রিকা অবশ্য জানিয়েছে, ইসরাইলের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘জবাব দেয়া হবে।’ আর এনবিসি নেট্য়ার্ক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর অফিসের একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি, ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বিকল্পগুলো উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে এবং এটা পরিষ্কার যে ‘ইসরাইল জবাব দেবে।’ ইসরাইলি কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, যুদ্ধ মন্ত্রিসভা ইসরাইনের বিরুদ্ধে বদলা নেয়ার অনুকূলে। তবে জবাবের সময় এবং মাত্রা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত রয়ে গেছে।
যুদ্ধ মন্ত্রিসভার বৈঠকটি হয় ইরানি হামলার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে। শনিবার রাতে ইরান নজিরবিহীন হামলা চালায় ইসরাইলে। এ সময় তারা প্রায় ৩৫০টি ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করে ইসরাইলে। ইসরাইল দাবি করেছে, এগুলোর ৯৯ ভাগ সফলভাবে ভূপাতিত করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি হিব্রু মিডিয়ায় বলা হয়েছে, এই ব্যাপক হামলার প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ মন্ত্রিসভার সদস্য বেনি গাঞ্জট এবং তার ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টির সহকর্মী গাদি আইসেনকট (যুদ্ধ মন্ত্রিসভার পর্যবেক্ষক) উভয়ে ইরানে পাল্টা হামলার প্রস্তাব করেন। তবে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট, আইডিএফ প্রধান হারজি হ্যালেভি এবং অন্যরা প্রস্তাবটির দৃঢ় বিরোধিতা করেন। তারা মনে করেন, একইসাথে এত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে গেলে প্রচুর চাপের সৃষ্টি হবে। এদিকে পৃথক একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে চ্যানেল ১২ দাবি করেছে, ইসরাইলি হামলার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেবে না। তবে বিষয়টি তাদেরকে আগে জানাতে হবে এবং সমন্বিত হামলা চালাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য সরকারিভাবে জানিয়েছে, তারা কোনো ইসরাইলি পাল্টা হামলায় অংশ নেবে না।
চ্যানেল ১২ আরো দাবি করেছে যে ইসরাইল এখন সংযত থাকার বিনিময়ে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত চুক্তি করতে চাচ্ছে এবং তা করতে চাচ্ছে ফিলিস্তিন ইস্যুতে কোনো ধরনের প্রতিশ্রুতি না দিয়েই।
তেহরান বিমানবন্দর খুলে দিলো ইরান: ইরান তেহরানের ইমাম খোমেনি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং মেহরাবাদ বিমানবন্দর খুলে দিয়েছে। এছাড়া ইসরাইল, জর্ডান, লেবানন, ইরাকও তাদের আকাশপথ খুলে দিয়েছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রেক্ষাপটে বিমানবন্দরগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল ইরান। গত শনিবার রাতে ইসরাইলের ওপর নজিরবিহীন হামলা চালায় ইরান। এদিকে রোববার আকাশসীমা ফের খুলে দিয়েছে ইরাক৷ ইরাকের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এ কথা ঘোষণা করেছে। জর্ডান এবং লেবাননও রোববার দেশের আকাশসীমা পুনরায় খুলে দিয়েছে। ইসরাইলের দাবি, ইরানের হামলাগুলোকে ‘প্রতিহত’ করেছে তারা৷
ইরাকের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে ‘আকাশপথ ফের চালু করার’ কথা জানিয়েছে। তারা বলেছে, আর কোনো ‘বেসামরিক বিমানের নিরাপত্তা ঝুঁকি’ নেই। উত্তর ইরাকের কুর্দি মিডিয়া জানিয়েছে, শনিবার রাতভর স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি অ লের ওপর দিয়ে উড়েছে ইরানি ড্রোন। জর্ডানে, বেসামরিক বিমান চলাচল কমিশনের প্রধান হাইথাম মিস্তো সরকারি আল মামলাকা চ্যানেলকে বলেন, ‘জর্ডানের আকাশপথ ফের খুলে দেওয়া হয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েচে। ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার রয়্যাল জর্ডানিয়ান-এর সিইও সামের মাজালি রোববার বলেন, এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ‘পুনরায় শুরু হয়েছে।’ যদিও দেরি হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
শনিবার রাতে ইসরাইলে ৩০০টিরও বেশি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান। ক্ষেপণাস্ত্র এবং ধীর গতির ড্রোনগুলো যখন ইসরাযইলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন ইসরাইলের মিত্ররা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে বলে বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে। মার্কিন এবং যুক্তরাজ্যের বিমানবাহিনী এক্ষেত্রে সাহায্য করেছে বলা জানা গেছে। এছাড়াও ফ্রান্সও এই অ লে টহল দেয়ার সাথে জড়িত থাকতে পারে, যদিও ফরাসিরা গুলি চালিয়ে ড্রোন ভূপাতিত করেছে বলে নিশ্চিত করা হয়নি। জর্ডানের বিমানবাহিনীও ইসরাইলকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলো। জর্ডান ইসরাইলি এবং মার্কিন বিমানের জন্য তার আকাশসীমা উন্মুক্ত করেছে, স্পষ্টতই জর্ডানের নিজস্ব আকাশসীমা লঙ্ঘনকারী ড্রোনগুলোকে গুলি করে। লেবাননের পরিবহন মন্ত্রী আলি হামি এএফপিকে বলেছেন, ‘আমরা সকাল ৭টা (স্থানীয় সময়) থেকে ফ্লাইট ফের চালু করেছি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করচি।’ তার কথায়, বৈরুতের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ‘‘ফের কাজ চালু করেছে।” ইরানি হামলার পূর্বাভাসে রাত ১২.৩০টা (স্থানীয় সময়) থেকে আকাশসীমা বন্ধ করে রেখেছিল ইসরাইল। তারপর স্থানীয় সময় সকাল ৭.৩০টা নাগাদ আবার তা চালু হয়েছে বলে ইসরাইলি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সংস্থাগুলো কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে: ইরানের আকাশসীমা এড়াতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সংস্থা ফ্লাইট স্থগিত রেখেছে বা সময়সূচির বদল করেছে। অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইন্স রবিবার এএফপিকে বলেছে,‘মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির’ কারণে ‘ইসরাইলের তেল আবিব, ইরাকের আরবিল এবং জর্ডানের আম্মানে সমস্ত ফ্লাইট দ্রুত স্থগিত করা হয়।’ মুখপাত্র সোফি মাতকোভিৎস বলেন, ‘সোমবার পর্যন্ত তেল আবিব, আরবিল এবং আম্মান অবধি বা সেখান থেকে কোনো ফ্লাইট যাতায়াত করবে না৷’ কর্মী ও যাত্রীদের নিরাপত্তা কোম্পানির সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বলেই জানান তিনি। ইরানের তেহরানে ফ্লাইট স্থগিত থাকবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। মধ্যপ্রাচ্যের মধ্য দিয়ে যাওয়া দূরপাল্লার ফ্লাইটগুলো অন্য পথে যাবে বলে জানানো হয়েছে।
জার্মানির লুফটহানসা এয়ারলাইন্স রোববার বলেছে, ইরানের হামলার কারণে আম্মান, বৈরুত, আরবিল এবং তেল আভিভের ফ্লাইট অন্তত সোমবার পর্যন্ত স্থগিত করা হবে। রয়টার্স বার্তা সংস্থাকে দেয়া এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, লুফটহানসা, সুইস এয়ারলাইন্স বলেছে, ফ্লাইটগুলো যাতে ইসরাইল, জর্ডান এবং ইরাকের উপরের আকাশসীমা ব্যবহার না করে তারা সেটা দেখছে।
‘দায়িত্বহীন অবস্থান’ নিয়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতদের তলব ইরানের: ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোববার, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে বলেছে, তাদের দেশ হামলার বিষয়ে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন অবস্থান’ নিয়েছে। তিনটি দেশই ইরানের এই হামলার নিন্দা করে।
ইসরাইলকে লক্ষ্য করে ড্রোন ও মিসাইল হামলা চালিয়েছে ইরান৷ সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেটে হামলার প্রেক্ষাপটে ইসরাইলের বিরুদ্ধে তেহরানের প্রতিশোধের হুমকির মধ্যে এই ঘটনা ঘটে৷ ইরানের ড্রোন ও মিসাইল ছোঁড়ার তথ্য জানিয়েছে দুই পক্ষই৷
ইরানি ড্রোন ইসরাইল ও ইউক্রেনের জন্য হুমকি : ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি রোববার ইসরাইলে ইরানের ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নিন্দা করেন। হামলার সম্ভাব্য ফলাফলকে রাশিয়ার ইউক্রেনে আগ্রাসনের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, ‘ইরানের পদক্ষেপগুলো সমগ্র অ ল এবং বিশ্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে, ঠিক যেমন রাশিয়ার পদক্ষেপগুলো বৃহত্তর সংঘাতের হুমকি দেয়।’ সূত্র : আরব নিউজ, ডয়চে ভেলে,আল জাজিরা, টাইমস অব ইসরাইল এবং অন্যান্য