শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২১ পূর্বাহ্ন

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ১২ মে, ২০২৪

চলতি বছরের প্রথম চার মাসে রেমিট্যান্সের মাত্র ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে। চার বছর আগেও দেশের রেমিট্যান্স বাজারে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল এক-চতুর্থাংশের বেশি। সে বাজার হাতছাড়া হতে হতে এখন ১০ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে। সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহের অবস্থা একেবারেই নাজুক। তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে কেবল জনতা ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত পাঁচ বছরের রেমিট্যান্স প্রবাহের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৫৫৮ কোটি ৮২ লাখ ডলার, যা ছিল মোট রেমিট্যান্সের ২৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। এর পর থেকে এ অংশীদারত্ব ক্রমেই কমেছে। ২০২১ সালে ২২ দশমিক শূন্য ৩, ২০২২ সালে ১৭ দশমিক ১১ শতাংশ রেমিট্যান্স দেশে আনে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক। ২০২৩ সালে এ অংশীদারত্ব মাত্র ১২ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে আসে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে রেমিট্যান্সের মাত্র ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত এসব ব্যাংকের মাধ্যমে।
ডলারের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত দরে রেমিট্যান্স আনতে গিয়ে এ বিপর্যয় ঘটেছে বলে দাবি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের অভাবেই ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের বাজারে তাদের অবস্থান হারিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার বক্তব্য হলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তারা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ঘোষিত দরে ডলার পাওয়ার আশায় বসে ছিলেন। এ কারণে তারা রেমিট্যান্সের বাজার হারিয়েছেন। রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রতিযোগী মনোভাবের ছিটেফোঁটাও ছিল না।
সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে ২০২০ পঞ্জিকাবর্ষে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪৩ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। অর্থাৎ ওই বছর ব্যাংকটির মাধ্যমে প্রতি মাসে গড়ে রেমিট্যান্স এসেছিল প্রায় ১২ কোটি ডলার। এর পর থেকে ব্যাংকটির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে থাকে। ২০২১ সালে ১ হাজার ৪০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসার পর ২০২২ সালে তা ১০৮ কোটিতে নেমে আসে। ২০২৩ সালে তা আরো কমে নেমে আসে মাত্র ৫৮ কোটি ডলারে। আর চলতি ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) মোট ১০ কোটি ৪৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আনতে পেরেছে ব্যাংকটি। সে অনুযায়ী ব্যাংকটির মাধ্যমে এখন প্রতি মাসে গড়ে রেমিট্যান্স আসছে মাত্র ২ কোটি ৬১ লাখ ডলার। মাসভিত্তিক গড় বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের তুলনায় ব্যাংকটিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ৭৮ শতাংশের বেশি।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আফজাল করিম জানান, ঘোষিত দরের সঙ্গে বাজারে ডলারের দরের মধ্যে বড় ব্যবধান ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা ছিল ঘোষিত দরের চেয়ে বেশি দরে রেমিট্যান্স না কেনার। এ নির্দেশনা মেনে চলার কারণেই সোনালী ব্যাংকের রেমিট্যান্স এতটা কমে গেছে।
প্রায় দুই বছর ধরে দেশে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক এমডি আফজাল করিম বাফেদার চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন। আর ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন দায়িত্বে রয়েছেন এবিবির চেয়ারম্যান হিসেবে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের রেমিট্যান্সে বিপর্যয় হলেও এ সময়ে ব্র্যাক ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।
আফজাল করিম বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে “‍ক্রলিং পেগ” নীতির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আশা করছি, এ নীতি চর্চার ফলে ডলারের বাজারদর স্থিতিশীল হয়ে আসবে। এতে সোনালী ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়বে।’
একসময় রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর শীর্ষে ছিল অগ্রণী ব্যাংক। ২০২০ সালে ব্যাংকটির মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৪৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। ওই বছর ব্যাংকটির মাধ্যমে প্রতি মাসে গড়ে প্রবাসী আয় এসেছিল ২০ কোটি ডলারের বেশি। এর পর থেকে এ ব্যাংকেও রেমিট্যান্স প্রবাহ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০২১ সালে ২০৯ কোটি ডলার আসার পর ২০২২ সালে তা ১৪০ কোটিতে নেমে আসে। আর ২০২৩ সালে অগ্রণীর মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১১০ কোটি ডলার। ব্যাংকটি এখন রেমিট্যান্সের বাজারে শীর্ষ ২০-এর তালিকায়ও নেই। সর্বশেষ চলতি বছরের এপ্রিলে অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে মাত্র ৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলার দেশে এসেছে। সব মিলিয়ে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ব্যাংকটির মাধ্যমে মাত্র ২৬ কোটি ৩৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। মাসভিত্তিক গড় বিশ্লেষণে দেখা যায়, চার বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসার প্রবণতা কমেছে প্রায় ৬৮ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর শাখা সারা দেশে বিস্তৃত। সেবার পরিধি ও মান বাড়ানোর নামে গত কয়েক বছর প্রযুক্তি খাতে শতশত কোটি টাকা ব্যয়ও করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সসহ অন্যান্য সেবা জনগণের দৌরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারত। কিন্তু তা না করে উল্টো রেমিট্যান্সসহ ব্যবসা সংকুচিত হয়ে যাওয়াটি দুঃখজনক। এটি অবস্থাপনারই ফল।
২০২০ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৭৫ কোটি ২৯ লাখ ডলার। এর পর থেকে ব্যাংকটির রেমিট্যান্স ব্যবসা সংকুচিত হয়েছে। ২০২১ সালে ৫৭ কোটি ৪৩ লাখ ও ২০২২ সালে ৫৬ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স দেশে আনে ব্যাংকটি। এরপর ২০২৩ সালে রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমে মাত্র ২১ কোটি ৫৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ব্যাংকটির মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৭ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।
রূপালী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরও বলছেন, ‘কমপ্লায়েন্স’ মানতে গিয়ে তাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ এতটা কমে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক, বাফেদা ও এবিবির ঘোষিত দর এবং নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে রেমিট্যান্সের ডলার কিনিনি। এ কারণে রূপালী ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবাহ এতটা কমেছে। এখন রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আশা করছি, ক্রলিং পেগ নীতি বাস্তবায়নের ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে।’
সোনালী, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংক রেমিট্যান্সের বাজার থেকে ছিটকে গেলেও কিছুটা ভালো অবস্থানে আছে জনতা ব্যাংক। ২০২০ সালে ব্যাংকটির মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৯২ কোটি ডলার। এরপর এ ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবাহও কমতে শুরু করে। ২০২১ সালে ৭৯ কোটি, ২০২২ সালে ৬০ কোটি ও ২০২৩ সালে ৭৬ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স দেশে আনে জনতা ব্যাংক। তবে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ব্যাংকটির মাধ্যমে ৪২ কোটি ৮৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। সে হিসাবে চার বছর আগের তুলনায় জনতা ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবাহ এখন বেড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের এমডি মো. আবদুল জব্বার বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে আসা কর্মকর্তাদের বদলি করেছি। সেখানে তুলনামূলক নতুন ও দক্ষ কর্মীদের পদায়ন করা হয়েছে। ফলে ওইসব দেশ থেকে জনতা ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। আমরা চেয়েছি রেমিট্যান্স যেখান থেকে আসবে আর যেখানে বিতরণ হবে উভয় দিকের সেবার মান বাড়াতে। এছাড়া সরকার ঘোষিত আড়াই শতাংশ প্রণোদনার অতিরিক্ত হিসাবে আমরা ব্যাংকের পক্ষ থেকেও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিয়েছি। এসব পদক্ষেপ জনতা ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১৭৪ কোটি বা ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। এরপর ২০২১ সালে ২২ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ও ২০২২ সালে ২১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে। আর ২০২৩ সালে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ৮ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com